গুণগত শিক্ষা চাইলে বাড়াতে হবে শিক্ষকের মর্যাদা

এই লেখার শিরোনামটি যেমন আছে ঠিক তেমন নয়, কিন্তু প্রায় সমার্থক একটি স্লোগান আমি দেখেছিলাম দুবাইয়ের একটি আন্তর্জাতিক শিক্ষক সম্মেলনকক্ষের দেয়ালে—‘দ্য স্ট্যাটাস অব দ্য টিচার্স ইজ ইকুয়াল টু দ্য কোয়ালিটি অব এডুকেশন’।

অর্থাৎ একটি দেশের শিক্ষকের মর্যাদা বাড়লে সে দেশের শিক্ষার গুণগত মান যেমন বাড়ে, আবার ঠিক একইভাবে শিক্ষার গুণগত মান বাড়লেও তা শিক্ষকের মর্যাদাকে বাড়ায়। এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্র আগে শিক্ষকের মর্যাদা বাড়াবে না শিক্ষক আগে গুণগত শিক্ষাদান করবেন, সেটা নিয়ে তর্ক করলে তা অনেকটা ‘ডিম আগে না মুরগি আগে’র মতো অমীমাংসিত রয়ে যাবে। আমরা এই প্রসঙ্গে যাব, তবে তার আগে শিক্ষকের ‘মর্যাদা’ নিয়ে একটু আলোচনা করা যাক।

একটা ধারণা এ রকম প্রচলিত আছে যে একজন শিক্ষক হচ্ছেন একজন শিক্ষক। আর দশটা মানুষের মতো তিনি টাকাপয়সা, সুযোগ-সুবিধা, ক্ষমতা-প্রতিপত্তি ইত্যাদি নিয়ে মাথা ঘামাবেন না। তিনি কেবল সম্মান পাওয়ার আশায় কাজ করে যাবেন। কিন্তু বাস্তবে শিক্ষকেরা ওই সম্মানটুকুও পান না। কারণ, ন্যূনতম অর্থ-ক্ষমতা ছাড়া এ ধরনের সম্মান পাওয়াটা অন্যের দয়ার ওপর নির্ভর করে, এবং অন্যের দয়ার ওপর যে সম্মান নির্ভর করে, সেটা ঠুনকো হতে বাধ্য। আমার সঙ্গে যাঁরা দ্বিমত পোষণ করবেন, তাঁরা নিশ্চয়ই অতীতের উদাহরণ টানবেন। আগে শিক্ষিত মানুষের সংখ্যা কম ছিল বলে শুধু শিক্ষিত মানুষ হওয়ার সুবাদে শিক্ষকেরা যে একধরনের মর্যাদা পেতেন, তা ঠিক। কিন্তু কেবল শিক্ষক হিসেবে কি সৈয়দ মুজতবা আলীর ‘পাদটীকা’ গল্পের পণ্ডিতমশাইয়ের চেয়ে বেশি মর্যাদা পেতেন? গল্পটিতে এক লাট সাহেব স্কুল পরিদর্শনে এসে প্রথাগত সামান্য একটু সৌজন্য প্রকাশ করাতে পণ্ডিতমশাই একেবারে বিগলিত হয়ে পাঠকদের বুঝিয়ে দেন, শুধু অর্থাভাবে নয়, সম্মানহীনতার কারণেও কতটা বুভুক্ষু হয়ে আছেন তিনি।

‘লাট এলেন…। “হ্যালো পানডিট” বলে সাহেব হাত মেলালেন। রাজসম্মান পেয়ে পণ্ডিতমশাইয়ের সব যন্ত্রণা লাঘব হলো। বারবার ঝুঁকে সাহেবকে সেলাম করলেন—এই অনাদৃত পণ্ডিতশ্রেণি সামান্যতম গতানুগতিক সম্মান পেয়েও যে কি রকম বিগলিত হতেন, তা তাঁদের সেসময়কার চেহারা না দেখলে বিশ্বাস করার উপায় নেই।’

আরও পড়ুন

সৈয়দ মুজতবা আলী সমাজের বিবেককে প্রায় চপেটাঘাত করলেন গল্পের শেষে যখন তিনি পণ্ডিতমশাইয়ের আর্থিক অবস্থার বর্ণনা দিতে গিয়ে তাঁর পুরো পরিবারকে লাট সাহেবের কুকুরের একটি পায়ের সঙ্গে তুলনা করলেন। পণ্ডিতমশাই তাঁর শিক্ষার্থীদের গাণিতিক জ্ঞানের পরীক্ষা নেওয়ার ভান করে জিজ্ঞাসা করেন—

‘বল তো দেখি, যদি একটা কুকুরের পেছনে মাসে পঁচাত্তর টাকা খরচ হয়, আর সেই কুকুরের তিনটে ঠ্যাং হয়, তবে প্রতি ঠ্যাঙের জন্য কত খরচ হয়? …আজ্ঞে পঁচিশ টাকা।....আমি মাসে পাই পঁচিশ টাকা। এখন বল তো দেখি, এই ব্রাহ্মণ পরিবার লাট সাহেবের কুকুরের কটা ঠ্যাঙের সমান? আমি হতবাক। “বল না”। আমি মাথা নিচু করে বসে রইলাম। শুধু আমি না, সমস্ত ক্লাস নিস্তব্ধ।

পণ্ডিতমশাই হুংকার দিয়ে বললেন “উত্তর দে”। মূর্খের মতো একবার পন্ডিতমশাইয়ের মুখের দিকে মিটমিটিয়ে তাকিয়েছিলুম। দেখি, তিনি মুখ লজ্জা, তিক্ততা, ঘৃণায় বিকৃত হয়ে গিয়েছেন।’

শিক্ষকের মর্যাদার বিষয়টি যে আসলে বায়বীয় কোনো বিষয় নয়, সৈয়দ মুজতবা আলী সম্ভবত এটাই বোঝাতে চেয়েছেন। আর্থিকভাবে নড়বড়ে একজন শিক্ষককে যে লোকদেখানো সম্মান দেখানো হয়, তা যে যেকোনো মুহূর্তে ফাটা বেলুনের মতো চুপসে যেতে পারে, পণ্ডিতমশাইয়ের ছোট ছোট ছাত্রকেও তা বোঝাতে কোনো অসুবিধা হয়নি।

আমাদের মতো সীমিত সম্পদের দেশে নীতিনির্ধারকদের অন্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বাদ দিয়ে শিক্ষায় আরও বেশি বিনিয়োগ করবেন কি-না, বা এখানে বিনিয়োগ করলে শিক্ষকেরা তার সদ্ব্যবহার করতে পারবেন কি-না, এ নিয়ে বহুবার চিন্তা করতে হয়। অন্যদিকে মুজতবা আলীর পণ্ডিতমশাইয়ের চেয়ে শিক্ষকদের অবস্থা এখন অনেক ভালো হলেও অন্যদের সঙ্গে তুলনা করলে তাঁদের হতাশা বাড়ে বৈ কমে না। শিক্ষার গুণগত মান বাড়ানোর জন্য যে প্রবল তাগিদ অনুভব করা দরকার, সংগত কারণেই সেটা দুর্বল হতে থাকে।

তবে এই দুই ক্ষেত্রেই সাম্প্রতিক সময়ে কিছুটা উন্নতি হয়েছে। এ বছর বাজেটে শিক্ষায় কিছুটা হলেও বরাদ্দ বেড়েছে। এবং অন্যদিকে গত প্রায় তিন বছর ধরে শিক্ষকেরা যখনই সুযোগ পেয়েছেন বা প্রয়োজন হয়েছে, অত্যন্ত প্রশংসনীয়ভাবে তাঁদের দায়িত্ব পালন করেছেন। ২০১৯ সালে শিক্ষকেরা দুটো বড় কাজ করেন। একটি হচ্ছে মিড ডে মিল চালু করা এবং অন্যটি শিক্ষার্থীদের দিয়ে বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধের ওপর প্রায় এক লাখ ডকুমেন্টারি তৈরি এবং প্রায় এক লাখ প্রতিবেদন লেখানো। এর সাফল্য এতটাই দৃশ্যমান ছিল যে কারিকুলাম বিশেষজ্ঞরা ওই অভিজ্ঞতার ভিত্তিতেই এখন নতুন কারিকুলাম তৈরি করছেন। কারিকুলাম তৈরিতে আমাদের শিক্ষকেরা এর আগে কখনোই এত বড় ভূমিকা পালন করেননি।

করোনার সময় যখন সবাই দিশেহারা, তখনো তাঁরা দায়িত্ব পালনে পিছপা হননি। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হওয়ার মাত্র ১৩ দিনের মাথায় টিভি ক্লাস শুরু করা, এরপর অনলাইন ক্লাস, অ্যাসাইনমেন্ট, শিক্ষার্থীদের দিয়ে গাছ লাগাতে লাগাতে তাদের পরিবেশ সম্পর্কে সচেতন করে তোলা, তাদের স্বাস্থ্য-সুরক্ষা, টিকাদান ও আয়রন ফলিক অ্যাসিড বড়ি খাওয়ানো, নিজেরা পুষ্টিবিষয়ক প্রশিক্ষণ নেওয়া, শিক্ষার্থীদের দিয়ে অন্তত ১০ হাজার একর জমিতে ধান কেটে দেওয়া ইত্যাদি ক্ষেত্রে আমাদের শিক্ষকেরা অতুলনীয় অবদান রেখেছেন। মাধ্যমিক পর্যায়ের অন্তত তিনটি গবেষণায় দেখা গেছে, করোনার কারণে যতটুকু শিখন ঘাটতি কিংবা ঝরে পড়ার আশঙ্কা করা হচ্ছিল, শিক্ষকদের আন্তরিক প্রচেষ্টায় ততটা হয়নি। কিন্তু এই অবদানের কথা কি আমরা অন্তত স্বীকার করেছি? ধন্যবাদ জানিয়েছি? প্রাপ্য মর্যাদা?

আগামী বছর শিক্ষকেরা নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নের একটা কঠিন দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিতে যাচ্ছেন এবং আমার বিশ্বাস, তা পালন করার যথাসাধ্য চেষ্টাও করবেন। তবে দুবাইয়ের সেই স্লোগান মানলে এই চেষ্টার মাত্রা কিছুটা হলেও তাঁদের আর্থিক ও সামাজিক মর্যাদার ওপর নির্ভর করবে।

  • সৈয়দ মো. গোলাম ফারুক মাউশি ও নায়েমের সাবেক মহাপরিচালক