গুম হওয়া ব্যক্তির স্বজনদের কাছ থেকে লিখিত নেওয়ার কারণ কী

গুম হওয়া ব্যক্তিদের স্বজনেরা অভিযোগ করেছেন, পুলিশ তাঁদের সাদা কাগজে স্বাক্ষর করতে বাধ্য করছে। তাঁদের নানাভাবে হয়রানি করা হচ্ছে। উধাও হয়ে যাওয়া ব্যক্তিরা আসলেই গুম হয়েছেন কি না, তা জানতে চাইছেন। পুলিশ নিজেদের মতো করে লিখে তাঁদের কাছ থেকে স্বাক্ষর নিয়ে রেখে দিচ্ছে। এমনকি তাঁরা গুম হননি, আত্মগোপনে চলে গিয়েছেন—এমন কিছু লিখতে বাধ্য করা হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। তবে যথারীতি পুলিশ এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছে।

এর প্রতিক্রিয়ার গুম হওয়া ব্যক্তিদের স্বজনেরাও আলোচনা সভা করে প্রকাশ্যে নিজেদের বক্তব্য তুলে ধরেছেন। স্বজনেরা অভিযোগ করেছেন, গুম হওয়ার পরই থানা-পুলিশের কাছে গিয়ে অভিযোগ দায়েরের চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু পুলিশ তাঁদের অভিযোগ গ্রহণ করেনি ওই সময়। নানা টালবাহানা করেছে। বরং এখন এসে নানাবিধ প্রশ্ন করে ও হয়রানি করে মানসিক চাপ সৃষ্টি করছে।

গুম হওয়া ব্যক্তিদের স্বজনেরা পড়েছেন বিপদে। একদিকে স্বজন হারানোর বেদনা, আরেক দিকে আইন–শৃঙ্খলা বাহিনীর হয়রানি। বোঝাই যাচ্ছে সব মিলিয়ে ভয়াবহ মানসিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক চাপের মধ্যে আছেন তাঁরা। গুম হওয়া ব্যক্তিদের স্বজনদের সংগঠন ‘মায়ের ডাক’ প্রায়ই বিভিন্ন সময়ে মানববন্ধন, সভা ও সেমিনারের আয়োজন করে থাকে। তাঁদের কান্নাজড়িত ভয়ংকর দিনযাপনের গল্প আমাদের বারবারই শুনতে হয়। গুম বন্ধ ও বিচারের দাবির মিছিলে নতুন নতুন কণ্ঠস্বর যুক্ত হচ্ছে।

হুট করে স্বজন হারানো পরিবারগুলোকে হয়রানির কারণ ধারনা করা যায়। গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সাত কর্মকর্তার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। এরপর গুম বা বিচারবহির্ভূত হত্যা না হলেও র‍্যাবের সঙ্গে ধস্তাধস্তিতে একজন নিহত হয়েছেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দিক থেকে এই নিষেধাজ্ঞা হচ্ছে সরকারের প্রতি একধরনের ‘কোমল’ চাপ। এর মধ্যে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের জন্য সরকার নানা চেষ্টা–তদবির চালিয়ে যাচ্ছে।

স্বাভাবিকভাবেই এখানে উভয়পক্ষের স্বার্থগত বিষয় নিয়ে দর-কষাকষি থাকবে। শেষমেশ যদি কোনো ধরনের সমঝোতা না হয়, তবে আরও কঠিন চাপ আসতে পারে। সরকার পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য লবিস্ট নিয়োগ করেছে বলে গণমাধ্যম থেকে আমরা জেনেছি। কিন্তু এত কিছুর পরও বিচারের জন্য আন্তর্জাতিক চাপ বৃদ্ধি পেতে পারে। যেসব বাহিনী বা বা ইউনিটের বিরুদ্ধে গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের অভিযোগ রয়েছে, তাদের বিলুপ্ত করার পরামর্শ দিতে দিয়ে থাকে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার ও পশ্চিমা শক্তিগুলো। এ ক্ষেত্রেও তেমনটা ঘটলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।

ফলে ভবিষ্যতে এমন আশঙ্কার বিষয় আঁচ করেই সম্ভবত গুম হওয়া ব্যক্তিদের পরিবারগুলোর কাছ থেকে বিভিন্ন ধরনের লিখিত নিয়ে রাখা হচ্ছে আগাম সতর্কতা হিসেবে। ভবিষ্যৎ আইনি প্রক্রিয়ার মোকাবিলায় এসব লিখিত দলিল কাজে লাগানোর চেষ্টা করা হতে পারে। এ ছাড়া হঠাৎ গুম নিয়ে পুলিশের মাঠের নামার আর কী কারণ থাকতে পারে? বরং লিখিত নিয়ে ভবিষ্যৎ পরিস্থিতি মোকাবিলায় আগাম ঢাল প্রস্তুত করা হচ্ছে। এ রকম আরও ঢাল প্রস্তুত করা হতে পারে। কিন্তু এসব ঢাল কি আদৌ কোনো কাজ লাগে?

এ বিষয়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বিভিন্ন দেশে গুম ও এর পরবর্তী প্রক্রিয়া নিয়ে আলোচনা করা যেতে পারে। তৎকালীন পুরো প্রক্রিয়া পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, রাষ্ট্রীয় গুম বা বলপূর্বক নিখোঁজ করার সঙ্গে জড়িত শাসক বা দায়ী ব্যক্তিরা কমবেশি সবাই বিচারের মুখোমুখি হয়েছেন। তাঁরাও চেষ্টা করেছিলেন নানাভাবেই ঘটনাগুলো আড়াল করতে। বিভিন্ন ঢালও তাঁরা তৈরি করেছিলেন। এমনকি লাতিন আমেরিকার দেশগুলোয় কিছু কিছু আইনও পরিবর্তন করা হয়েছিল। কিন্তু আইনের যতই ফাঁকফোকর থাক না কেন, একেবারেই কেউ পার পেয়ে যায়নি।

লাতিন আমেরিকার দেশগুলোর মধ্যে আর্জেন্টিনাই প্রথম সামরিক জান্তার বিচার শুরু করে ১৯৭৬ থেকে ১৯৮৩ সাল পর্যন্ত অন্ধকার যুগে বামপন্থী কর্মী, বিরোধী মত ও সাধারণ নাগরিককে হত্যা নির্যাতন ও গুম করার অভিযোগে। ১৯৮৫ সালের ডিসেম্বর মাসে আদালত সামরিক কর্মকর্তাদের মানবতাবিরোধী অপরাধে দোষী সাব্যস্ত করেন। সামরিক জান্তা জেনারেল হোর্হে ভিদালেকে আজীবন কারাদণ্ড প্রদান করে। তবে পরবর্তী দুই প্রেসিডেন্ট সবার সাজা বাতিল করেন এবং সব সামরিক কর্মকর্তাকে বিচার থেকে অব্যাহতি দেন। ২০০৩ সালে প্রেসিডেন্ট নেস্টর ক্রিসনার আর্জেন্টিনার সুপ্রিম কোর্টের বিচারকদের পরিবর্তন করে নতুন বিচারক নিয়োগ দেন। ২০০৫ সালে সাজা মওকুফ বাতিল করেন আদালত। ২০০৭ সালে পুনরায় বিচার শুরু আদেশ দেন বিচারকেরা। ২০১২ সালে ভিদালেকে বিরোধী রাজনৈতিক নেতার সন্তান অপহরণের দায়ে ৫০ বছরের জেল প্রদান করেন। ২০১২ সালে জেলে মারা যান ভিদালে। আর্জেন্টিনা থেকে জার্মানিতে পালিয়ে আসা এক সামরিক কমান্ডারকে ফিরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে আর্জেন্টিনার সরকার।

রাষ্ট্রীয় গুম বা বলপূর্বক নিখোঁজ করার সঙ্গে জড়িত শাসক বা দায়ী ব্যক্তিরা কমবেশি সবাই বিচারের মুখোমুখি হয়েছেন। তাঁরাও চেষ্টা করেছিলেন নানাভাবেই ঘটনাগুলো আড়াল করতে। বিভিন্ন ঢালও তাঁরা তৈরি করেছিলেন। এমনকি লাতিন আমেরিকার দেশগুলোয় কিছু কিছু আইনও পরিবর্তন করা হয়েছিল। কিন্তু আইনের যতই ফাঁকফোকর থাক না কেন, একেবারেই কেউ পার পেয়ে যায়নি।

চিলির জেনারেল অগাস্তো পিনোশে নির্বিচারে বিরোধী কর্মীদের গুম করা কুখ্যাত শাসকদের একজন। পিনোশেও বিচারের মুখোমুখি হয়েছিলেন। কিন্তু মামলার রায় হাওয়ার আগেই মৃত্যুবরণ করেন। ১৯৯৮ সালে পিনোশে ব্রিটেন সফরে গেল স্পেন সরকারের অনুরোধে তাঁকে ব্রিটিশ সরকার আটক করে। পিনোশের বিরুদ্ধে স্পেনের নাগরিকদের চিলিতে নির্যাতনের অভিযোগ করে স্পেনের সরকার। পরে ব্রিটিশ আদালত তাঁকে শারীরিকভাবে অক্ষম ঘোষণা করে বিচারের অযোগ্য ঘোষণা করে। ২০০০ সালে তিনি দেশে ফেরার অনুমতি পান।

পিনোশে আটক হওয়ার পরপরই যুক্তরাষ্ট্র পিনোশের আমলে গুম ও নিখোঁজসংক্রান্ত গোপন দলিল প্রকাশ শুরু করেছে। ওই সব দলিলে অপারেশন কলম্বো ও অপারেশন কনডোরের বিস্তারিত তথ্য ছিল। ওদিকে চিলিতে তাঁর বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু হয়। কিন্তু ২০০০ সালে দেশে ফিরে তিনি সাবেক প্রেসিডেন্ট হিসেবে বিচার থেকে অব্যাহতি পান। ২০০২ সালে চিলি সুপ্রিম কোর্ট তাঁকে মানসিকভাবে অসুস্থ ঘোষণা করলে তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়। পিনোশে আজীবনের জন্য সিনেটরের আসন থেকে পদত্যাগ করেন। তবে ২০০৪ সাল ঘটনার মোড় আবার ঘুরে যায়। চিলির ন্যাশনাল কমিশন অব পলিটিক্যাল ইমপ্রিজনমেন্ট অ্যান্ড টর্চার এক প্রতিবেদনে জানায়, পিনোশের আমলে ৩৫ হাজার মানুষকে হত্যা, গুম ও নির্যাতন করা হয়েছে। চিলির সুপ্রিম কোর্ট সর্বসম্মতভাবে পিনোশের বিরুদ্ধে আর্থিক অনিয়ম ও বিচারবহির্ভূতভাবে নাগরিকদের গুম করে দেওয়ার অভিযোগ গঠন করেন। আদালত একই সঙ্গে তাঁকে বিচারের মুখোমুখি হওয়ার জন্য সুস্থ হিসেবেও ঘোষণা করেন। কিন্তু বিচার শেষ হওয়ার আগেই ২০০৫ সালে মৃত্যুবরণ করেন।

২০০০ সালে পেরুর প্রেসিডেন্ট আলবার্টো ফুজিমরি জাপান থেকেই পদত্যাগ করেন সম্ভাব্য বিচারের ভয়ে। কিন্তু ফুজিমরিকে ২০০৫ সালে চিলিতে আটক করা হয়। এর দুই বছর পর পেরুতে ফেরত পাঠানো হয়। ২০০৯ সালে পেরুর আদালতে ২৫ বছরের জেল দেওয়া হয় বেসামরিক নাগরিককে হত্যা ও গুমের অভিযোগে।

গুয়াতেমালার সাবেক প্রেসিডেন্ট এফরেইন রিউস মনট্টকে দেশটির একটি আদালত ২০১৩ সালের ৮০ বছরের জেল দেন গুম ও খুনের দায়ে। ২০১২ সালে তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ উত্থাপন করা হয়। মনট্টকে ১৯৮২ সালে ২০১ গ্রামবাসী হত্যার দায়ে অভিযুক্ত করা হয়। তবে পরে আদালত ৮৬ বছরের সাবেক প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে অভিযোগ পুনঃশুনানির আদেশ দেয়।

এসব হচ্ছে সব শীর্ষ রাজনৈতিক নেতার বিচারের উদাহরণ। এর বাইরেও বিভিন্ন বাহিনীর দায়ী ব্যক্তিদের জেলা–জরিমানা, এমনকি মৃত্যুদণ্ডও প্রদান করা হয়েছে। ফলে দেখা যাচ্ছে, চুড়ান্ত বিচারে গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যার দায় থেকে রেহাই পাওয়া মুশকিল। এমনকি বিদেশে পাড়ি দিলেও পশ্চিমারা পিনোশের মতো আটক করে আবার দেশে পাঠিয়ে দেয়। এ কারণে অভিযুক্ত ব্যক্তিরা সবাই কমবেশি বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে বাধ্য হয়েছেন।

মজার বিষয় হচ্ছে গুমের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরা সব সময়ই মনে করেন, ভবিষ্যতে তাঁদের কোনো বিচার হবে না। কঠোর দমন–পীড়ন ক্ষমতাকে আরও পোক্ত করবে; বরং বাস্তবে এর বিপরীত ঘটনাই দেখা যায়। ইউরোপ বা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো যাঁরা লাতিন আমেরিকা ও আলজেরিয়ায় গুমের ধারণা রপ্তানি করেছিল, প্রশিক্ষণ দিয়েছিল, অস্ত্র বিক্রি করেছিল, তাঁরাই সুযোগ বুঝে বিভিন্ন নথি ও দলিল–দস্তাবেজ প্রকাশ করে পিনোশের বিচারের সমস্ত আয়োজন সম্পন্ন করছে। চিলি, আর্জেন্টিনায় দোর্দণ্ড প্রতাপশালী সামরিক কমান্ডার ও কর্মকর্তাদের প্রকাশ্যে বিচার করা হয়েছে।

ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনীতির এক রূঢ় দিক হচ্ছে একসময় যাঁকে উসকে দেওয়া হয়, তাঁকেই আবার খপ করে খাঁচায় বন্দী করে ফেলা হয়। এটাই ইতিহাসের রং বদলের বহুমুখিতা। ইতিহাসে ক্ষণে ক্ষণে পরিস্থিতির বদল হয়। অনেকে মনে করেন, এই বহুমুখিতাই সময়ের ইতিহাস নির্মাণের শক্তি। কিন্তু একই সঙ্গে এটা সময় ও ইতিহাসের নির্মমতাও বটে।

ড. মারুফ মল্লিক রাজনৈতিক বিশ্লেষক, ‘গুমের রাজনীতি এবং খাসোগি’ গ্রন্থের রচয়িতা