গুমের শিকারদের পরিবারের কান্না সরকার কি শোনে?

বাবা পারভেজ হোসেনকে ফিরে পেতে আকুতি জানিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়ে শিশু আদিবা ইসলাম হৃদি। ‘মায়ের ডাক’ সংগঠনের আয়োজনে স্বজনকে ফিরে পাওয়ার দাবি জানাতে আসেন স্বজনহারা পরিবারের সদস্যরা
ফাইল ছবি

আলজেরিয়ার আইনজীবী রাচিদ মেসলিকে গুম করে দিয়েছিল রাষ্ট্রীয় বাহিনী। ১৯৯২ সালে আলজেরিয়ার সামরিক শাসন জারির পর গুম হওয়া ব্যক্তির পক্ষে মামলা লড়তেন মেসলি। প্রতিদিনই মেসলির দপ্তর নিখোঁজ ব্যক্তিদের স্বজনে ভরে উঠত।

হাজারো সন্তানহারা মায়ের মিলনক্ষেত্র ছিল মেসলির অফিস। ১৯৯৬ সালের এক দুপুরে আলজেরিয়ার নিরাপত্তা বাহিনী সাদাপোশাকে মেসলিকেই ধরে নিয়ে যায়। এটা করে সবাইকে পরিষ্কার বার্তা দিয়েছিল আলজেরিয়ার সামরিক শাসক। গুম হওয়া ব্যক্তির পক্ষে কোনো কথা বলা যাবে না। এমনকি আইনি লড়াইও না।

আটকের পর মেসলির সহকারী আইনজীবী বিভিন্ন সরকারি দপ্তরে গিয়েছিলেন মেসলির খোঁজে। যথারীতি বিচার মন্ত্রণালয় থেকে মেসলিকে আটকের কথা অস্বীকার করা হয়। পরবর্তী সময়ে জানা যায় মেসলিকে কুখ্যাত এক আটককেন্দ্রে পাঠানো হয়েছিল। সেখানে মেসলিসহ গোপনে ৩৩ জনকে আটকে রেখেছিল আলজেরিয়ার আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। ওই আটককেন্দ্র থেকে তিনজন শেষ পর্যন্ত জীবিত ফিরে এলেও ৩০ জনের আর হদিস মেলেনি। আলজেরিয়ার সামরিক সরকারের আমলে সাত হাজার মানুষকে গুম করা হয়। সময়টাকে বলা হয় আলজেরিয়ার অন্ধকারের দশক।

বিশ্বব্যাপী গুমের শিকার হয়েছেন যারা তাদের স্মরণের আন্তর্জাতিক দিবস ছিল গত রোববার। ২০১১ সাল থেকে জাতিসংঘের উদ্যোগে প্রতিবছর এই দিনটি পালন করা হয়। ২০১০ সালের ২১ ডিসেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ গুমবিরোধী আন্তর্জাতিক সনদ ‘ইন্টারন্যাশনাল কনভেনশন ফর প্রোটেকশন অব অল পারসন্স অ্যাগেইনস্ট এনফোর্সড ডিজঅ্যাপিয়ারেন্স’ গ্রহণ করে। মূলত গত শতকে বিভিন্ন দেশে মহামারি আকারে গুম দেখা দেওয়ায় বিষয়টি নিয়ে আন্তর্জাতিক মহল সজাগ হতে থাকে। মানবাধিকার সংস্থাগুলোর নড়াচড়া শুরু হয়। বেরিয়ে আসতে থাকে নানা দেশের সরকার কর্তৃক নাগরিকদের গুম করে দেওয়ার রোমহর্ষক ঘটনা। এরই পরিপ্রেক্ষিতে জাতিসংঘের সনদ গ্রহণ করা হয়।

আলজেরিয়ার মতো অন্ধকারের দশক যুগ আফ্রিকা থেকে লাতিন আমেরিকা, এশিয়া থেকে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে নেমে এসেছিল। তবে সবাইকে ছাড়িয়ে গিয়েছে লাতিন ও পূর্ব ইউরোপের দেশগুলো। লাতিনে সন্ত্রাসী বলে মার্ক্সবাদী বিপ্লবীদের গুম করা হতো। আর এদিকে পশ্চিমাদের চর উল্লেখ করে প্রতিবাদীদের নিখোঁজ করে দেওয়া হতো পূর্ব ইউরোপে। লাতিন আমেরিকার গত শতককে গুমের শতক বললে অত্যুক্তি হবে না। এল সালভাদর, গুয়াতেমালা, চিলি, আর্জেন্টিনা, উরুগুয়ে, ব্রাজিল, বলিভিয়ার শাসকেরা যেন গুমের প্রতিযোগিতায় নেমেছিলেন। গুমের নিত্যনতুন নৃশংস পথও আবিষ্কার করেছিলেন তাঁরা। প্রথম দিকে ধরে নিয়ে গোপন কেন্দ্রে আটকে রাখা হলেও পরের দিকে এত সব ঝামেলায় আর যায়নি তারা। একসঙ্গে অনেককে ধরে নিয়ে হাত-পা বেঁধে বিমান থেকে সাগরে ফেলে দেওয়া হতো।

গুমের এসব পন্থা ও এসবে জড়িত রাষ্ট্রীয় বাহিনীকে বিভিন্ন নাম দিত ওই সব দেশের গণমাধ্যম। আলজেরিয়া বা আর্জেন্টিনায় যাঁদের সাগরে ফেলে দেওয়া হতো, তাঁদের বলা হতো ভুতুড়ে ফ্লাইটের যাত্রী। এই ফ্লাইটের যাত্রী হলে আর ফিরে আসা হয় না। মিসরে ঘাতকদের নাম ছিল ভোরের অতিথি। মিসরের গণমাধ্যমে প্রচার হতো ভোরের অতিথিরা অমুককে ধরে নিয়ে ‘সূর্যের ওপারে’ পাঠিয়ে দিয়েছে। ‘সূর্যের ওপারে’ মানে গুম। মিসরে জামাল আবদেল নাসেরের আমলে এ ধরনের ভোরের অতিথিরা ঘন ঘন বিভিন্ন বাড়িতে গিয়ে বিরোধী রাজনীতিবিদদের ধরে নিয়ে সূর্যের ওপারে পাঠিয়ে দিতেন। সেই ভোরের অতিথিরা মিসরে এখন জেনারেল ফাতাহ সিসির শাসনামলে দিনদুপুরেই আসেন। গত বছর দিনের বেলাতেই স্বামী মোহাম্মেদ হেলমিসহ গুম হয়ে যান আসমা দাবিস। মিসরের দামানহৌর শহরের একটি ক্যাফেতে স্বামী ও স্বামীর ভাইকে নিয়ে বসে ছিলেন আসমা। ওই সময় সাদাপোশাকের পুলিশ তাঁদের চোখ বেঁধে হ্যান্ডকাফ পরিয়ে নিয়ে যায়। এরপর থেকে তাঁরা নিখোঁজ।

লিবিয়ার মুয়াম্মার গাদ্দাফি, সিরিয়ার হাফিজ আল আসাদ বা ইরাকের সাদ্দাম হোসেনের আমলে গভীর রাতে কারও বাড়ি কড়া নড়ে ওঠা বা দরজায় ঠক ঠক আওয়াজ মানেই ওই বাড়ি থেকে কেউ একজন হারিয়ে যাচ্ছেন।

মানবাধিকার সংস্থা এশিয়ান হিউম্যান রাইটস কমিশনের হিসাবে বাংলাদেশে ২০০৯ সাল থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত ৫৫৩ জন গুম হয়েছেন। গুমের শিকার কেউ কেউ ফিরেছেন। কাউকে পাওয়া গেছে সীমান্তের ওপারে। কারও লাশ পাওয়া গেছে খালে, বিলে, ধানখেতে ও পথের ধারে। তবে বড় একটি অংশেরই কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। গুমের শিকারদের মধ্যে রাজনীতিবিদ থেকে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীও আছেন। যথারীতি দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও যথারীতি গুমের দায়দায়িত্ব অস্বীকার করছে অন্যান্য দেশের মতোই। নিজ দেশের নাগরিকদের গুম করার ক্ষেত্রে চীন একেবারেই ভিন্ন। অন্যান্য দেশের অন্তত হিসাব পাওয়া যায়। কিন্তু চীনে গত কয়েক দশক বিশেষ করে তিয়েনআনমেন চত্বরে ছাত্র বিক্ষোভের পর কত মানুষ গুম হয়েছেন, তার কোনো হিসাব নেই। অতি সম্প্রতি উইঘুর মুসলিমদের গুম করে দেওয়ার তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু কেউই চীনের এই অপকর্ম নিয়ে টুঁ শব্দটি করছে না।

বিভিন্ন দেশেই গুমের শিকার হচ্ছেন রাজনীতিবিদ, গণমাধ্যমকর্মী, অধিকারকর্মী, পরিবেশবাদীসহ অনেকেই। মূলত স্বৈরাচারী ও ফ্যাসিবাদী সামরিক সরকারের আমলেই গুম বেশি হয়ে থাকে। তবে আজকাল গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকারও গুম ও অপহরণ করে থাকে। অনেক ক্ষেত্রেই এসব সরকার নিজস্ব সামরিক শক্তি ও বিদেশি শক্তির সমর্থন পেয়ে থাকে। বিদেশি শক্তিকে বিভিন্ন সুবিধা প্রদান করতে গিয়ে প্রতিবাদী শক্তিকে দমন-পীড়ন শুরু করে। ওদিকে বিদেশি শক্তি নিপীড়ক সরকারের ক্ষমতায় থাকার পক্ষে আন্তর্জাতিক সমর্থন নিশ্চিত করে। গত শতকে লাতিন আমেরিকায় গুমের সঙ্গে জড়িত অনেক দেশের পক্ষে যুক্তরাষ্ট্র আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সক্রিয় ছিল। বিনিময়ে যুক্তরাষ্ট্র এসব দেশের বাজারে অবাধ প্রবেশের অনুমতি পায়। খনিজ সম্পদ আহরণ করে। আর প্রতিবাদী শক্তিকে সন্ত্রাসী, বিচ্ছিন্নতাবাদী নানা নামে উল্লেখ করে গণহারে গুম করে সরকারগুলো।

গুমের সঙ্গে জড়িত দেশগুলোতে যে চিত্রটি দেখা যায় তা হচ্ছে শুরুতে বিরোধী মত ও দলের নিচু সারির নেতা-কর্মীদের গুম করা হয়। সরকার বোঝার চেষ্টা করে সমাজে গুমের প্রতিক্রিয়া কী হতে পারে। শুরুতে দু-একটি নিখোঁজ হওয়ার ঘটনা জনসাধারণকে তেমন আলোড়িত করে না। কারণ অনেকেই মনে করেন এগুলো রাজনৈতিক দলের নিজস্ব বিষয়। জোরালো প্রতিবাদ ও প্রতিক্রিয়া না হলে পরবর্তী সময়ে গুরুত্বপূর্ণ নেতা-কর্মীদের গুম করা শুরু করে।

আমাদের দেশেও গুমের বিস্তর অভিযোগ রয়েছে। রোববার শাহবাগে গুমের শিকার ব্যক্তির ছবি নিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন স্বজনেরা। গুম হওয়া সন্তানের জন্য দীর্ঘশ্বাস ছেড়েছেন মায়েরা, স্ত্রীরা, সন্তানেরা। স্বজনদের দীর্ঘশ্বাস কি শাসকদের দোরগোড়ায় পৌঁছায়? মনে হয় না। না হলে বছর বছর গুমের সংখ্যা বাড়ে কীভাবে?

ড. মারুফ মল্লিক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক