গৃহযুদ্ধে তছনছ বেদুইন সংস্কৃতি

প্রতীকী ছবি।
ছবি: রয়টার্স

সিরিয়ার বিভিন্ন জলাশয়ের ধারে আধা–মরু অঞ্চলে শত শত বছর ধরে বেদুইন সম্প্রদায় ভাসমান জীবন কাটিয়ে আসছে। তারা উট, দুম্বা, ভেড়া, ছাগলসহ নানা ধরনের গবাদিপশু পালন করে জীবিকা নির্বাহ করে। তারা জলাশয়সংলগ্ন এলাকার তৃণভূমিগুলোতে গবাদিপশু চরাতে চরাতে এক জায়গা থেকে তাঁবু উঠিয়ে অন্য জায়গায় তাঁবু ফেলে। পশু ও পশুর দুধ বিক্রির অর্থেই মূলত তাদের সংসার চলে। এভাবেই শত শত বছর ধরে তারা যাযাবরের জীবন কাটিয়ে আসছে। তাদের এই চির–অস্থায়ী আবাসের অভ্যাস সিরিয়ার ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিতে অনন্য বৈচিত্র্য যোগ করেছে। কিন্তু তাদের অস্তিত্ব এখন হুমকির মুখে। দেশটিতে গৃহযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে তারা চরম অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে।

প্রায় এক শ বছর আগে প্রথমে ফরাসি শাসকশ্রেণি ও পরে নতুন জাতিরাষ্ট্রের শাসকগোষ্ঠী বেদুইনদের যাযাবর জীবনযাপন বন্ধ করে এক জায়গায় থিতু হয়ে বাস করার জন্য চাপ দেয়। বেদুইনেরা পূর্বপুরুষদের মতো বেদের জীবন ছেড়ে দিয়ে সরকারের চাপে বিভিন্ন গ্রামে ও শহরের উপকণ্ঠ এলাকায় স্থায়ীভাবে বসবাস করতে থাকে। ১৯৩০ সালে যেখানে সিরিয়ায় মোট জনসংখ্যার ১৩ শতাংশ বেদুইন ছিল, রাষ্ট্রীয় চাপে পড়ে ১৯৫৩ সালে সেই সংখ্যা ৭ শতাংশে নেমে আসে। আর এখন সেই সংখ্যা মাত্র ২ থেকে ৩ শতাংশে নেমে এসেছে। এখন তারাও বাপ–দাদার ঐতিহ্যবাহী জীবনযাপন টিকিয়ে রাখার জন্য সংগ্রাম করে যাচ্ছে।

সিরিয়ার জলাশয়বর্তী আধা–মরু এলাকাগুলোকে আরবিতে বলে আল–বাদিয়া। দেশটিতে ঘাস ও লতাপাতা ভরা মোট জমি আছে প্রায় এক কোটি হেক্টর। এর ৮০ শতাংশই আল–বাদিয়া। মধ্য ও উত্তর–পূর্ব সিরিয়ার আলেপ্পো, দেইর আজ জুর, হামাহ, হোমস এবং আল রাকা থেকে শুরু করে দক্ষিণের দেরা এবং আল সুয়াদিয়া প্রদেশ পর্যন্ত এর বিস্তৃতি। এসব এলাকায় এই বেদুইনেরা গবাদিপশুর পাল চরায়। তারা মাংস, দুগ্ধ ও মাখন–পনিরের মতো দুগ্ধজাত পণ্য বিক্রি করে জীবন কাটায়। গত ১০ বছরে গৃহযুদ্ধে বেদুইনদের সেই ছন্দময় জীবন তছনছ হয়ে গেছে। সরকারি ও বিদ্রোহী বাহিনীগুলোর বোমা হামলার কারণে কোনো রকমে টিকে থাকা অল্পসংখ্যক বেদুইনের পক্ষে নির্বিঘ্নে গবাদিপশু চরানো সম্ভব হচ্ছে না। যুদ্ধের কারণে পানি ও পশুখাদ্যের সংকট প্রকট হয়েছে।

বহু বেদুইন বাপ–দাদার জীবন ছেড়ে দেশ থেকে পালিয়ে গেছে। হামা প্রদেশের আল মাওয়ালি গোত্রের খালেদ আবু আমের নামের একজন বেদুইন বলছিলেন, যুদ্ধের কারণে তাঁকে তাঁর মেষ ও ছাগলের পাল পানির দরে বেচে ইদলিব প্রদেশে পালাতে হয়েছে। বেদুইনদের জন্য সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো এরা বারবার বসতির জায়গা পরিবর্তন করে বলে সরকার বা বিদ্রোহী কোনো পক্ষেরই আস্থাভাজন হতে পারে না। উভয় পক্ষই তাদের সন্দেহের চোখে দেখে। যেমন ২০১৮ সালে পালমিরা শহরের কাছে আল ওমুর গোত্রের বেদুইন শিবিরের ওপর সরকারি বাহিনী নির্বিচার বোমা হামলা চালিয়েছিল। সরকারের বক্তব্য ছিল ওটা নাকি আইএসের ঘাঁটি ছিল। আসলে ওটা ছিল বেদুইনদের শিবির। ওই হামলায় চার শ জন বেদুইন নিহত হয়। তাদের বহু পশু ধ্বংস হয়। ঠিক একই সময় রাকা অঞ্চলে আইএস যোদ্ধারা বেদুইনদের ওপর হামলা চালিয়ে সব লুটপাট করে। তিন বছর আগে ঘুতা এলাকা সরকারি বাহিনী ঘিরে রেখেছিল। অনেক দিন আটকা পড়ে থাকার কারণে সেখানকার বেদুইনেরা খাবারসংকটে পড়েছিল।

তারা এখন মূলধন হারিয়ে দিনমজুরে পরিণত হয়েছে। বহু বেদুইন তাদের পশু ইরাক, জর্ডান, তুরস্কে পাচার করে সেখানে অপেক্ষাকৃত বেশি দামে বেচে দিচ্ছে। তারপর বেদুইনের জীবন থেকে চিরকালের মতো সরে আসছে। সিরিয়ার সংঘাত বেদুইনদের শত শত বছরের এই ঐতিহ্যবাহী জীবনকে কীভাবে বদলে দিয়েছে, তা নিয়ে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে তেমন কোনো প্রচার হয়নি। তাদের রক্ষা করতে কোনো পক্ষই উদ্যোগী হয়নি। ফলে সিরিয়ার ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ আজ বিলুপ্ত হতে চলেছে।

আল–জাজিরা থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত
ডন চ্যাট্টি: অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির ইমেরিটাস অধ্যাপক

হাইয়ান দুখান: সেন্ট্রাল ইউরোপিয়ান ইউনিভার্সিটির গবেষক