গোলাম হোসেন স্যারের চেয়ার

কার্টুন: তুলি
কার্টুন: তুলি

ঘর্মাক্ত শরীরে হাঁপাতে হাঁপাতে একপায়া ভাঙা ইটের ঠেকনা দেওয়া একটা চেয়ারে এসে তিনি বসতেন। হাঁটু পর্যন্ত কাদা। খালি গা। কাঁধে একটা ছিন্ন মলিন গামছা। পাঁজরের হাড়গুলো গোনা যেত। এই গণনাও আমরা তাঁর কাছেই শিখেছিলাম। তিনি গোলাম হোসেন স্যার। আমাদের অঙ্কের শিক্ষক। যদিও নিজের সংসারের অঙ্কের হিসাব তিনি মেলাতে পারতেন না। ১৯৬৩-৬৪ সালের কথা। সরকারের দেওয়া অতি নগণ্য ভাতার টাকা কালেভদ্রে স্যারের হাতে পৌঁছাত। এতে সংসারের দশ ভাগের এক ভাগ ব্যয়েরও সংকুলান হতো না। নিজের অতি সামান্য জমি আর ভাগচাষের জমিতে উদয়-অস্ত পরিশ্রম। এরই এক ফাঁকে ক্লাসে এসে বসতেন আমাদের কানসোনা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক গোলাম হোসেন স্যার। নানা দুশ্চিন্তায় মেজাজ খিটখিটে থাকত। কানে কম শুনতেন। ফলে মাঝেমধ্যেই অকারণ গালমন্দ জুটত আমাদের কপালে।
এই গোলাম হোসেন স্যারের ছাত্র আমি এখন দেশের এক সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠে পড়াই। অবসরের কাছাকাছি সময়ে চলে এসেছি। গড় আয়ু বৃদ্ধির সুবাদে স্যারের চেয়ে বেশি দিনই বেঁচে আছি। আমার স্যারদের কথা মনে হলে প্রথমে গোলাম হোসেন স্যারের কথাই মনে পড়ে। গর্ব অনুভব করি। শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়ে আসে। আমাদের আজকের দেশ-সমাজ-সংসার এঁরাই নির্মাণ করেছেন। সমাজ তাঁদের অন্য কিছু দিতে না পারলেও অন্তত শিক্ষকের মর্যাদা দিতে কুণ্ঠিত ছিল না।
আমার বাবাও শিক্ষক ছিলেন। হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় নিরাপত্তার জন্য তাঁকে এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে ছুটে বেড়াতে হতো। একপর্যায়ে পাকিস্তানি সেনাদের কাছ থেকে স্কুল খোলার চাপ আসতে থাকে। পরিস্থিত সামাল দেওয়ার জন্য বাবা স্কুল থেকে দূরের এক গ্রামে ম্যানেজিং কমিটির সদস্যদের নিয়ে সভা করে তাঁরই ছাত্র সহকারী প্রধান শিক্ষক আবদুর রশীদ সাহেবকে প্রধান শিক্ষকের পদে বসিয়ে নিজে সরে দাঁড়ান।
স্বাধীনতার পর বাহাত্তর থেকে চুয়াত্তর সাল পর্যন্ত অন্য অনেকের মতো আমাদের পরিবারের সদস্যদেরও পেট চলেছে কখনো এক বেলা কখনো বা দুই বেলা সেদ্ধ আলু আর চীনার চালের ভাত বা যুক্তরাষ্ট্রের দয়ায় পাওয়া সাদা মোটা আতপচালের ভাত খেয়ে। এই অবস্থার মধ্যেও বাবা কখনো তাঁর ছাত্র আবদুর রশীদের কাছ থেকে নিজের পদটি ফিরে পাওয়ার দাবি করেননি। এ ব্যাপারে অনেকে জোর করলে তিনি বলেছেন: ও আমার ছাত্র। আমিই তাকে ওই পদে বসিয়েছি, এটা আমার জন্য গৌরবের।
বাবার ছাত্রদের মধ্যে অনেকেই ছিলেন কৃতবিদ্য। তাঁদেরই একজন সরকারি প্রশাসনের উঁচু পদের এক কর্মকর্তা বাবাকে সদ্য প্রতিষ্ঠিত পাবনার কাশিনাথপুর কলেজের অধ্যক্ষ হওয়ার আমন্ত্রণ জানান। কখনো গুরু-দক্ষিণা চাননি বাবা। কিন্তু শিষ্যের স্বপ্রণোদিত ওই আহ্বানে সাড়া না দিয়েও পারেননি। নতুন বেসরকারি কলেজ। কোনো মাসে সামান্য বেতন পাওয়া যেত, কোনো মাসে নয়। তবু তো বড় মর্যাদা। এদিকে সংসারের অবস্থা পূর্ববৎ। এরপর অন্য ছাত্রদের আমন্ত্রণে আরও দুটি কলেজের অধ্যক্ষ। এবং সব শেষে সেনাবাহিনীর উঁচু পদে কর্মরত বাবার আর এক ছাত্রের আহ্বানে সাড়া দিয়ে রংপুর ক্যান্ট পাবলিক স্কুল ও কলেজে যোগদান।
এ দেশে এই তো ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক। শিক্ষক কখনো ছাত্রের পাশে, কখনো ছাত্র শিক্ষকের। এটাই দীর্ঘদিনের পরম্পরা। শিক্ষকের ছাত্র আমলা, উকিল, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, সেনানায়ক, এমনকি শিক্ষকও। তাঁদের ছাত্ররাই তো ভাষাসৈনিক, মুক্তিযোদ্ধা। কবি, গায়ক, শিল্পী, সাংসদ, মন্ত্রী—এমন সব কৃতী তো শিক্ষকেরই ছাত্র। অন্যভাবে দেখলে যেকোনো মানুষের মধ্যে আজীবন দুটি সত্তা বর্তমান, এমনকি শিক্ষকেরও। সে সারা জীবন শেখে, সারা জীবন শেখায়—কৃষিজীবী থেকে শুরু করে বুদ্ধিজীবী, প্রজা থেকে রাজাধিরাজ। ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক তাই নিজের সঙ্গে নিজেরই সম্পর্কের মতো, নিজের এক সত্তার সঙ্গে অন্য সত্তার সম্পর্ক। যেহেতু সবাই ছাত্র এবং সবাই শিক্ষক, সেহেতু শিক্ষকতা পেশা ও এর মর্যাদা পৃথিবীব্যাপী সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র ও অনন্য এক মাত্রায় স্বীকৃত। শিক্ষককে সম্মান জানানোর অর্থ নিজেকেই সম্মানিত করা। আবার শিক্ষককে আহত করার অর্থ নিজের গায়েই আাঁচড় কাটা। এ নতুন কোনো কথা নয়।
এভাবেই তো চলে এসেছে। কখনো এ নিয়ে তর্ক ওঠেনি। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে কী এমন ঘটে গেল? আমরা এখন নিজের সঙ্গেই যেন নিজে তর্কে লিপ্ত হয়েছি। শিক্ষা নিয়ে, শিক্ষকতা নিয়ে নানা অনভিপ্রেত কথাবার্তা শুরু হয়েছে। এমন তো হওয়ার কথা ছিল না। অতীতে অনেক দুঃসময়ে, এমনকি সামরিক শাসনকালেও এসব বিষয়ে তর্ক উঠতে দেখা যায়নি। শিক্ষকদের আন্দোলন-সংগ্রাম, বেতনকাঠামো—এসব নিয়ে নানা কথা উঠতেই পারে। কিন্তু এই এখন, এই ‘সুসময়ে’ তর্কটা কি সেখানেই আটকে আছে? সমাজ কি এতটাই বদলেছে? প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপে সমস্যার আপাত একটা সমাধান হয়তো হয়েই যাবে। কিন্তু সব শিক্ষকের জন্য স্বতন্ত্র বেতন স্কেলের আসল দাবিটা কি চাপা পড়ে গেল না?
আমার বাবার বন্ধু ছিলেন গৌরলাল পাল। তিনি সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়ায় আমাদের পাশের গ্রাম ঘাটিনা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন। তখন পাকিস্তান আমল। বেতন বা সম্মানী নয়, ওই যে শিক্ষকের জন্য সামান্য ভাতা, তা দেওয়া হতো পোস্ট অফিসের মাধ্যমে ছমাস-নমাস পরপর। কৃষকগঞ্জ বাজারের পোস্ট অফিসে গৌরলাল স্যারকে দিনের পর দিন ধরনা দিতে দেখেছি। তিনি শুধু আসতেন আর মলিন মুখে ফিরে যেতেন। ভাতা আর আসত না। শিক্ষা আর শিক্ষকের প্রতি রাষ্ট্রের এই দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন হয় স্বাধীনতার পর। বঙ্গবন্ধু তৎকালীন প্রায় সব প্রাথমিক বিদ্যালয়কে জাতীয়করণ করেন। বেতন তেমন বেশি নয়, তবু মাস গেলে একটা নিশ্চয়তা। শিক্ষার প্রয়োজনীয়তার ক্ষেত্রে অভূতপূর্ব এক পরিবর্তন। বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর এই পরিবর্তিত অগ্রযাত্রায় অনেকটাই ভাটা পড়ে। দীর্ঘ ২১ বছর পর আওয়ামী লীগ পুনরায় ক্ষমতায় এলে আবার শিক্ষার প্রতি ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি লক্ষ করা যায়। এরপর এখন তো শিক্ষক ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বৃদ্ধি, বিনা মূল্যে বই বিতরণ, বিনা বেতনে পাঠদানসহ নানা আয়োজনের সমারোহ। এর মধ্যেই আবার শিক্ষকদের অনাকর্ষণীয় বেতন ও শিক্ষার মান নিয়ে নানা বিতর্ক বর্তমান।
আওয়ামী লীগের রূপকল্প ২০২১-এর মধ্যে শিক্ষার প্রতি গুরুত্ব প্রদান এবং শিক্ষকদের মর্যাদা ও উচ্চতর বেতনকাঠামোর অঙ্গীকার মেলে। শিক্ষকদের জন্য স্বতন্ত্র বেতনকাঠামোসহ একই অঙ্গীকার লক্ষ করা যায় ২০১৪ সালে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে। দীর্ঘদিন পর গ্রহণযোগ্য শিক্ষানীতিতেও এসব অঙ্গীকারের উচ্চকণ্ঠ প্রতিফলন। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর প্রধানমন্ত্রী, শিক্ষামন্ত্রী ও অর্থমন্ত্রীর কণ্ঠে শিক্ষার মানোন্নয়নে শিক্ষকদের জন্য পৃথক বেতনকাঠামোর কথা একাধিকবার উচ্চারিত হয়েছে। এ ব্যাপারে তখন বরং শিক্ষক সমিতিগুলোই প্রায় নীরব ছিল।
এখনো একই সরকার ক্ষমতায়। প্রধানমন্ত্রী, শিক্ষামন্ত্রী ও অর্থমন্ত্রীর পদেও আছেন একই ব্যক্তিরা। তাহলে অষ্টম বেতনকাঠামোয় আগের প্রতিশ্রুতির প্রতিফলন নেই কেন? স্বতন্ত্র বেতনকাঠামোর কী হলো? পাওয়ার কথা ছিল স্বতন্ত্র মর্যাদা; কিন্তু তা তো নেই-ই, আগে যা ছিল সেখান থেকেও অবনমন ঘটল মর্যাদার। শুধু তা-ই নয়, কীভাবে যেন শিক্ষক আর আমলা মুখোমুখি হলেন। শিক্ষকদের সম্পর্কে ঢালাওভাবে অনেক অশোভন কথাও এখন আসছে নানা পর্যায় থেকে। মানলাম, অনেক শিক্ষক খারাপ, কিন্তু সবাই কি? এমন ঢালাও মন্তব্য কি মাথার ওপরে থুতু ছিটানোর মতো নয়? আমরা দেখছি শতকরা হারে শিক্ষা-বাজেট এখন নিম্নমুখী। শিক্ষানীতির অঙ্গীকারের তাহলে কী হবে? হঠাৎ করে কী ঘটছে এসব? কারা এর পেছনে?
গত জুনে সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় বেড়াতে গিয়ে সেখানকার জাতিসংঘ দপ্তরের মূল ফটকের সামনে দেখেছিলাম একটা কাঠের ভাস্কর্য: ৩৯ ফুট উঁচু এক চেয়ার, যার একটা পায়া ভাঙা। ভূমি-মাইন ও ক্লাস্টার বোমা ব্যবহারের বিরুদ্ধে এক স্থাপত্যশিল্পীর প্রতিবাদের প্রতীক হিসেবে দাঁড়িয়ে থাকা ওই চেয়ারটি দেখে সে সময় আমার শিক্ষক গোলাম হোসেন স্যারের তিনপায়া চেয়ারের কথা মনে আসেনি। কিন্তু আজ শিক্ষানীতির অঙ্গীকার আর শিক্ষক আন্দোলনের মাঝামাঝি দাঁড়িয়ে গোলাম হোসেন স্যারের একপায়া ভাঙা চেয়ারটির কথা মনে পড়ছে। পাশাপাশি মনে পড়ছে আমার স্যারের পিতৃপ্রদত্ত ‘গোলাম হোসেন’ নামটি।
মলয় ভৌমিক: অধ্যাপক, ব্যবস্থাপনা বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, নাট্যকার।