গোলান থেকে সিরীয় যুদ্ধ দেখা

কর্নেল আমাকে বলেন, ‘ওই যে মসজিদটা দেখছেন, ওটা নুসরার ঘাঁটি। আর ওই যে ত্রিকোণ পাহাড় দেখছেন, ওখানে ইসরায়েলিরা রয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘আপনারা যেটাকে রাজনৈতিকভাবে কৌতূহলোদ্দীপক যুদ্ধক্ষেত্র বলেন, এটা সে রকমই। হ্যাঁ, এখানে নুসরা ও ইসরায়েলিরা সিরীয়দের লক্ষ্য করে বোমা মারে। আর সিরীয়রা বোমা মারে মূলত নুসরাকে লক্ষ্য করে। কিন্তু নুসরার আহত সেনাদের ইসরায়েলি লাইন ধরে হাইফার হাসপাতালে নেওয়া হয়।’

তাহলে ইসরায়েল কার পক্ষে? বাথ শহরটা গৃহযুদ্ধের আগের সময়ে আরও কয়েকটি শহরের সঙ্গে গড়ে তোলা হয়েছিল, যার লক্ষ্য ছিল পুরোনো কুনেইত্রা শহরকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করা। ১৯৭৩ সালের মধ্যপ্রাচ্য যুদ্ধে ইসরায়েল এই শহর দখল করেছিল। এরপর কিসিঞ্জারের চুক্তির কারণে তারা সেখান থেকে সরে আসে। কিন্তু ইসরায়েলি সেনারা বিস্ফোরক দিয়ে শহরটি একেবারে ধ্বংস করে দিয়েছিল। নুসরা এখন এই ৪৩ বছরের পুরোনো ধ্বংসস্তূপে ঘাঁটি গেড়ে বসে আছে। আর সিরীয়রা এখনো শক্তভাবে বাথ শহরের বিশ্ববিদ্যালয়, ব্যাংক, অগ্নিনির্বাপণ কার্যালয়, স্কুল, পুলিশ বাহিনী, হাসপাতাল প্রভৃতি শক্তভাবে নিয়ন্ত্রণ করছে। যদিও তাদের দুই শত্রু এর ওপর নজর রাখছে: ইসলামপন্থী নুসরা ও ইসরায়েলিরা।

বাথ শহরের সিরীয় সেনাবাহিনীর সূত্রে জানা যায়, তাদের গোয়েন্দা সংস্থার হিব্রুভাষীরা সব সময় ইসরায়েলি বাহিনীর অভ্যন্তরীণ এবং তাদের সঙ্গে নুসরাদের কথোপকথন নজরদারি করছে। তারা জানে, আহত নুসরা সেনাদের হাইফা হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। তবে ইসরায়েলও ব্যাপারটা গোপন রাখার চেষ্টা করে না। কিন্তু একবার হলো কী, ইসরায়েলি অ্যাম্বুলেন্সে করে নিয়ে যাওয়ার সময় এক নুসরা সেনাকে দ্রুজরা গাড়ি থেকে নামিয়ে হত্যা করে, যারা মূলত সিরীয় সরকারের প্রতি অনুগত। তারা নুসরাকে জাতশত্রু মনে করে। এই লোকটার হত্যার খবরের মধ্য দিয়ে বোঝা যায়, ইসরায়েল ও ইসলামপন্থীদের মধ্যকার সম্পর্কটি খুবই রহস্যময়। কথা হচ্ছে, এই ইসলামপন্থীরা নাম পরিবর্তন করলেও এটা লুকাতে পারবে না যে, তারা একসময় আল-কায়েদা ছিল।

সিরিয়ার মধ্যে দ্রুজদের যে শহর আছে এবং যেগুলো বাথ শহরের কাছে, সেই শহরগুলো সিরিয়ার সরকারের পক্ষাবলম্বন করেছে। কিন্তু এতে যুদ্ধক্ষেত্র আরও পরাবাস্তব হয়ে উঠেছে। আবার সিরীয়রা এ–ও বলে যে কুনেইত্রা ও গোলানের মধ্যে নতুন সরবরাহ রুট গড়ে তোলার জন্য ইসরায়েলি বুলডোজার ব্যবহার করা হয়েছে, অর্থাৎ সিরিয়ার সীমান্তের ভেতরে।

এসব ঘটনা থেকে এক কঠিন প্রশ্নের উদয় হয়। গোলানে সিরীয় ও ইসরায়েলি সীমান্তের ভেতরে নুসরা-অধিকৃত অঞ্চল সিরিয়ার দক্ষিণের দেরা শহর ও জর্ডান সীমান্ত পর্যন্ত বিস্তৃত। আর সেই সীমান্তের ওপারে ‘মিলিটারি অপারেশনস সেন্টার’, যাকে বলে এমওসি, যাকে ইসলামপন্থী ও সিরীয় সেনাবাহিনী উল্লেখ করে থাকে। আবার পশ্চিমা গোয়েন্দা কর্মকর্তারা সেখানে সিরিয়ার সরকারবিরোধী সেনাদের জন্য অস্ত্র সরবরাহ ডিপো তৈরি করে রেখেছে।

এখন কথা হচ্ছে, এমওসির সঙ্গে এর পশ্চিমা সমর্থকদের সম্পর্ক কী? যারা নুসরার সঙ্গে সম্পর্ক রাখে। আবার ইসরায়েলিদের সঙ্গেই বা তাদের কী সম্পর্ক, যারা নুসরার সেনাদের হাসপাতালে চিকিৎসা করে। জর্ডানের সীমান্ত ও গোলানের ইসরায়েলি রেখার দূরত্ব খুব বেশি হলে ৭০ মাইল, যার মাঝখানের সব জমি বিরোধী সেনাদের দখলে।

৫০ বছর বয়সী কর্নেল সালেহ তিন বছর ধরে বাথ শহরের এক প্রান্তের আগাছা-আবৃত অ্যাপার্টমেন্ট ব্লক পাহারা দিয়ে আসছেন, যেখানে এখন কথা বললে প্রতিধ্বনি শোনা যায়। তিনি খুব একঘেয়েভাবে খেয়াল করে আসছেন, ইসরায়েলিরা তাঁদের সেনাবাহিনীকে হামলা করলেও নুসরাকে কখনো হামলা করে না। অথচ সাবেক আল-কায়েদা হিসেবে এদের ইসরায়েলের শত্রু হওয়া উচিত। কিন্তু তা নয়। কর্নেল বলেন, ‘আমি এখানকার প্রতিটি ইট-পাথরকে চিনি। যখন দেখি, আমাদের সামনে দিয়ে একটি গাড়ি চলে যাচ্ছে, সঙ্গে সঙ্গে বুঝতে পারি, একটি যান দুটি যান হয়ে গেছে কি না। আমরা জানি, তারা কখন হামলা করবে, তাহলে তারা আক্রমণ করার আগে বড় কামান ও মর্টারের গোলা বর্ষণ করে অগ্নিব্যূহ তৈরি করে।’

নুসরা সেনারা কখনো কখনো নিজেদের রেডিও তরঙ্গে সিরীয়দের ‘কাফের’ বা ‘অবিশ্বাসী’ বলে গালাগাল করে। কর্নেল সালেহ বলেন, ‘মন-মেজাজ ভালো থাকলে তাদের কফি পানের আমন্ত্রণ জানাই। আর মন-মেজাজ খারাপ থাকলে নিশ্চুপ থাকি। তাদের উচ্চারণ অনেকটাই জর্ডানিদের মতো। তারা জর্ডান সীমান্তের ধারে দেরা থেকে এসেছে।’

আমরা যখন কথা বলছিলাম, তখন উপত্যকার অনেকটা নিচে সিরীয় বাহিনী ও নুসরা ট্যাংক, কামান ও মর্টার দিয়ে যুদ্ধ করছিল। সিরীয়রা দাবি করে, তাদের শত্রুরা অন্তত ১৩টি গাড়ি দিয়ে একটি ব্যূহ তৈরি করে এসেছিল। তারা নুসরার এক নারী কর্মকর্তার কথা বলছিল, যাঁর নাম সৌয়াদ আল-কাতাহানি (ডাকনাম আল-নুদ)। ৩০ বছর বয়সী মেয়েটি নুসরা জেনারেল কাইস আল-ওমানির বোন, যাঁর অধীনে ১ হাজার ২০০ যোদ্ধা রয়েছেন। তাঁরা বিশেষভাবে বললেন, এই মেয়েটি আগে সিরীয় সেনাবাহিনীর ফার্স্ট লেফটেন্যান্ট ছিলেন।

বাথ শহরের বাইরে শত্রুদের সম্পর্কে সিরীয়রা আরেকটি তথ্য পেয়েছে। ব্যাপারটা হলো এই যে, নুসরা যখন ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়ে, তখন তাদের নল থেকে রকেট বেরিয়ে যাওয়ার ছবি তুলে রাখতে হয়। সম্ভবত অস্ত্র সরবরাহকারীদের কাছে তাদের জবাবদিহি করতে হয়, গোলাটা তারা অন্য কারও কাছে বিক্রি করেনি। বিশ্বাস করুন, সিরীয় যুদ্ধে অস্ত্রের ঘাটতি রয়েছে।

অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন, দ্য ইনডিপেনডেন্ট থেকে নেওয়া

রবার্ট ফিস্ক: দ্য ইনডিপেনডেন্ট-এরমধ্যপ্রাচ্য প্রতিনিধি