গোয়েন্দা প্রযুক্তি যখন ইসরায়েলের কূটনীতির হাতিয়ার

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ইসরায়েলের অস্ত্র বিক্রি কমেছে। কিন্তু আড়ি পাতা প্রযুক্তির রপ্তানি বেড়েছে। ইসরায়েলি গোয়েন্দা প্রযুক্তি ব্যবহার করে বিভিন্ন দেশে বিরোধী মতকে নির্মমভাবে দমনের অভিযোগ উঠছে। বিশেষ করে হংকং বিক্ষোভে চীনের বিরুদ্ধে গণহারে ইসরায়েলি আড়ি পাতার প্রযুক্তি ব্যবহারের অভিযোগ করেছেন দেশটির মানবাধিকারকর্মীরা। চীন ছাড়াও মরক্কো, ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইনসহ মানবাধিকার পরিস্থিতির চরম অবনতি হওয়া দেশগুলোতে ইসরায়েল আড়ি পাতার বা নজরদারির প্রযুক্তি বিক্রি করছে। সম্প্রতি আল–জাজিরার এক প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে যে বাংলাদেশ ইসরায়েলের কাছ থেকে গোয়েন্দা নজরদারি সরঞ্জাম কিনেছে। বাংলাদেশ অবশ্য এ অভিযোগ অস্বীকার করেছে। গণনজরদারি প্রযুক্তির রপ্তানি বন্ধে তেল আবিবের আদালতে মামলাও করেছেন দেশটির মানবাধিকারকর্মীরা।

মানবাধিকারকর্মীরা বিরোধিতা করলেও ইসরায়েলের স্পাইওয়্যার কূটনীতির সাফল্যের কথা না বললেই নয়। গোটা আরব বিশ্বকে নজরদারির প্রযুক্তি সরবরাহ করে পুরোপুরি কবজা করেছে ইসরায়েল। একসময় আরবের বিভিন্ন দেশ সাবেক সোভিয়েত রাশিয়ার আড়ি পাতার প্রযুক্তি ব্যবহার করত। গত দুই দশকে রাশিয়ার প্রযুক্তিকে হটিয়ে ইসরায়েলের প্রযুক্তি জায়গা দখল করে নিয়েছে। ইসরায়েল নির্বিচারে এমন কিছু দেশকে নজরদারির প্রযুক্তি দিয়েছে, যাদের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক নেই। এবং পরবর্তীকালে ওই সব দেশ হুটহাট করেই ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দিয়ে দিচ্ছে। ধারণা করা হচ্ছে, নজরদারি প্রযুক্তির ফাঁদে ফেলে ওই সব দেশের সরকারকে স্বীকৃতি দিতে বাধ্য করছে ইসরায়েল। ইসরায়েল এক ঢিলে দুই পাখি শিকার করছে আক্ষরিক অর্থেই—স্বীকৃতি ও বাণিজ্য।

টাইমস অব ইসরায়েল গত বছরের জুন মাসে এক প্রতিবেদনে জানিয়েছিল, ইসরায়েলের অস্ত্র বিক্রি কমেছে এবং নজরদারির প্রযুক্তির বিক্রি ঊর্ধ্বমুখী। ইসরায়েল ২০১৭ সালে ৯ দশমিক ২ বিলিয়ন এবং ২০১৮ সালে ৭ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র বিক্রি করে। ২০১৯ সালে বিক্রি হয় ৭ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলারের। ইসরায়েলি অস্ত্রের বড় ক্রেতা হচ্ছে এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলো। এরা ইসরায়েলের অস্ত্র রপ্তানির ৪১ শতাংশ সংগ্রহ করে। ইউরোপ নেয় ২৬ শতাংশ। উত্তর আমেরিকা কেনে ২৫ শতাংশ অস্ত্র। আর আফ্রিকা ও ল্যাটিনরা ৪ শতাংশ অস্ত্র নেয়। ইসরায়েলের রপ্তানি করা অস্ত্রের মধ্যে ৭ শতাংশ হচ্ছে বিভিন্ন সাইবার ও ইন্টেলিজেন্স-সংক্রান্ত যন্ত্রপাতি।

আড়ি পাতার প্রযুক্তি বিক্রি করে ইসরায়েলের আয় কত বা খরিদ্দার কারা, তা বিস্তারিত জানায়নি টাইমস অব ইসরায়েল। কিন্তু সম্প্রতি হংকং বিক্ষোভে চীনের গোয়েন্দাদের বিরুদ্ধে গণহারে আন্দোলনকারীদের মুঠোফোন ও ই-মেইল হ্যাক করার অভিযোগ প্রকাশিত হয়েছে। মানবাধিকারকর্মীদের অভিযোগ, বিক্ষোভকারীদের গণহারে নির্যাতন ও ধরপাকড়ে ইসরায়েলের প্রযুক্তি ব্যবহার করছে চীন। চীনের গোয়েন্দারা বিক্ষোভকারীদের মুঠোফোনের সিম হ্যাক, ট্র্যাক, ক্লোন ও ট্রেস করতে পারছে। ইতিমধ্যে কমপক্ষে চার হাজার বিক্ষোভকারীর মুঠোফোন হ্যাক করেছে চীনের গোয়েন্দারা। হংকং পুলিশ ইসরায়েলের সেলেব্রাইট (Cellebrite) কোম্পানির প্রযুক্তি ব্যবহার করে বিক্ষুব্ধ জনতার মুঠোফোন নেটওয়ার্ক সিস্টেমে প্রবেশ করেছিল।

ইসরায়েলের পাশাপাশি সারা বিশ্বের মানবাধিকারকর্মীরাই আন্দোলনকারীদের ব্যক্তিগত গোপনীয়তা লঙ্ঘনের প্রতিবাদ করছেন। শুধু হংকংই নয়, এশিয়া ও আফ্রিকার দেশগুলোতে মানবাধিকার পরিস্থিতিকে ভয়াবহ খারাপ অবস্থার দিকে নিয়ে যাচ্ছে ইসরায়েলের প্রযুক্তি। এ প্রযুক্তি ব্যবহার করে ফিলিস্তিনিদের পর এবার বিভিন্ন দেশের গণতন্ত্রপন্থীদেরও গুম করা হচ্ছে।

সাধারণত ইসরায়েল ফিলিস্তিনিদের ওপর নজরদারির জন্য এসব প্রযুক্তি ব্যবহার করে। নিয়মিতই ফিলিস্তিনিদের ফোন ও ই-মেইল হ্যাক করা হয় ইসরায়েলের নিরাপত্তার কথা বলে। এবার ফিলিস্তিনিদের বাইরে অন্যরাও এ প্রযুক্তির শিকারে পরিণত হচ্ছে। দুটি কারণে ইসরায়েল আড়ি পাতার প্রযুক্তি বিভিন্ন দেশে বিক্রি করছে। প্রথমটি অবশ্যই অর্থনৈতিক। অস্ত্র ব্যবসায় হ্রাসের কারণে প্রযুক্তি বিক্রি করে রপ্তানি আয় ধরে রাখা।

আর দ্বিতীয় কারণটি হচ্ছে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন। চীনের সঙ্গে ইসরায়েলের কূটনৈতিক সম্পর্ক আছে। ইসরায়েল সহজেই চীনের কাছে অস্ত্র ও আড়ি পাতার প্রযুক্তি বিক্রি করতে পারে। কিন্তু ইসরায়েলের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক নেই, বিশেষ করে মুসলিম কিছু দেশ স্পাইওয়্যার কূটনীতির ফাঁদে পড়ছে। এসব দেশের সঙ্গে সরাসরি অস্ত্র বিক্রির ব্যবসা করা সম্ভব নয়। আবার বছরের পর বছর ধরে কর্তৃত্ববাদী সরকার শাসন করছে। এ সুযোগই নিচ্ছে ইসরায়েল। কর্তৃত্ববাদী শাসকদের আড়ি পাতার প্রযুক্তি ও প্রশিক্ষণ দিচ্ছে ইসরায়েল। এতে করে একদিকে কর্তৃত্ববাদী শাসকদের ক্ষমতার বিরুদ্ধে ফুঁসে ওঠা জনমতকে দমন করা যাচ্ছে, অন্যদিকে ইসরায়েলের নতুন প্রযুক্তি বাজারের সৃষ্টি হচ্ছে এবং ওই সব দেশের সরকারকে চাপে রেখে স্বীকৃতিও আদায় করে নিচ্ছে। স্বীকৃতির বিরুদ্ধে জনমত ফুঁসে উঠলে চাপে রাখার, দমন করার পন্থা ইসরায়েলই শিখিয়ে দিচ্ছে। ফলে ওই সব দেশের সরকারগুলো ইসরায়েলের ইচ্ছার বাইরে যেতে পারছে না। কারণ, ইসরায়েল থেকে গোপনে প্রযুক্তি নেওয়ার তথ্য ফাঁস হওয়ার শঙ্কা রয়েছে। গোপন চুক্তির তথ্য ফাঁস হলে গণবিক্ষোভে সরকারের পতনও হতে পারে কোনো কোনো দেশে। এসব কারণেই মরক্কো, সুদানের সরকার ক্ষমতা ধরে রাখতে জনমতের বিরুদ্ধে গিয়ে ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দিয়েছে। ইসরায়েলের স্বীকৃতি বা কর্তৃত্ববাদী শাসন—কোনো কিছুই বিরুদ্ধেই টুঁ–শব্দটি পর্যন্ত করতে পারছে না জনসাধারণ।

সম্প্রতি মরক্কো ও সুদান ছাড়াও আমিরাত ও বাহরাইন ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দিয়েছে। আগে থেকেই এসব দেশের বিরুদ্ধে ইসরায়েলের প্রযুক্তি ব্যবহার করে জনমতকে দমন করার অভিযোগ রয়েছে। তবে মরক্কোর বিষয়টি প্রমাণিত। গত বছরের জুন মাসে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল অভিযোগ করেছিল, মরক্কোর সরকার ইসরায়েলের এনএসও গ্রুপের তৈরি করা পেগাসাস নামের স্পাইওয়্যার ব্যবহার করে সাংবাদিক ওমার রাদির মুঠোফোন হ্যাক করেছিল। যদিও মরক্কোর সরকার এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছে। অভিযোগ, পাল্টা অভিযোগ, অস্বীকার—এসবের মধ্যেই গত বছরের ২০ ডিসেম্বর মরক্কো ও ইসরায়েল কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের ঘোষণা দেয়।

এভাবেই জনসাধারণকে চাপে রেখে কর্তৃত্ববাদী শাসকদের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলছে ইসরায়েল। এক ওমর রাদির গল্প প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু বিভিন্ন দেশে হাজার হাজার ওমর রাদির ফোন, ই-মেইল হ্যাক হচ্ছে ইসরায়েলি প্রযুক্তির কারণে। নাগরিকের ব্যক্তিগত গোপনীয়তা লঙ্ঘন করছে ছদ্ম ফ্যাসিবাদী শাসকেরা। রাষ্ট্রবিরোধী কাজে লিপ্ত থাকার মিথ্যা অভিযোগে গণতন্ত্রপন্থীদের ধরে নিয়ে অমানবিক নির্যাতন করছে। আর সরকারগুলো আটকে যাচ্ছে ইসরায়েলের ফাঁদে। হয় স্বীকৃতি নতুবা তথ্য ফাঁস এবং জনবিক্ষোভের মুখে বিদায়। মরক্কো, সুদান, আমিরাত বা বাহরাইনের কর্তৃত্ববাদী শাসকেরা ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে স্বীকৃতি দেওয়ার পথটিই বেছে নিয়েছে। আর ওদিকে নিষ্পেষিত হয় মুক্তিকামী জনতা।

ড. মারুফ মল্লিক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক