গ্রাম জাগবে যদি...

গ্রাম বাঁচলে বাংলাদেশ বাঁচবে আর গ্রাম দিয়ে শহর ঘেরাও—বাক্য দুটি দুই পক্ষের। কিন্তু স্লোগানগুলো আসলে শহরের লোকেরই দেওয়া। অন্যদিকে, গ্রাম কেবল রিক্তই হচ্ছে। এ অবস্থায় গ্রামের পুনরুজ্জীবন দরকার বলে জানিয়েছে ইন্টারন্যাশনাল ফুড পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (ইফপ্রি) ‘গ্লোবাল ফুড পলিসি রিপোর্ট-২০১৯’। রিপোর্টটিতে বলা হয়, বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ৪৫ দশমিক ৩ শতাংশই গ্রামে বাস করে। অতিদরিদ্র জনগোষ্ঠীর ৭০ শতাংশের বাসও গ্রামে। অথচ জলবায়ু পরিবর্তন, পরিবেশদূষণ ও বনাঞ্চল ধ্বংসের মতো বিভিন্ন কারণে হুমকির মুখে রয়েছে গ্রামীণ পরিবেশ; বাড়ছে ক্ষুধার প্রকোপ। এ অবস্থায় ক্ষুধা-দারিদ্র্য দূর করতে হলে গ্রামের পুনরুজ্জীবন জরুরি বলে মত দিয়েছে গবেষণা প্রতিষ্ঠানটি। অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ প্রসঙ্গে ইফপ্রির প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোয় এখনো বিভিন্ন ধরনের বঞ্চনা ও পরিবেশগত অবনতি, কৃষিসংক্রান্ত সংকট, তরুণ জনগোষ্ঠীর বেকারত্বসহ বিভিন্ন ধরনের চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে। এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে স্বাস্থ্যকর কর্মময় জীবনের জন্য বিনিয়োগের মাধ্যমে গ্রামকে পুনরুজ্জীবন করতে হবে। সংগঠনের প্রতিবেদনে সমাধান হিসেবে বলা হয়—বাংলাদেশের উচিত ২০৩০ সালের মধ্যে গ্রামের মানুষের জীবন–মানের উন্নয়ন করা। সেই সঙ্গে যোগাযোগ, বিদ্যুৎ ও অবকাঠামোগত উন্নয়ন, কৃষির যান্ত্রিকীকরণ ও আধুনিক বাণিজ্যিক কৃষি, নারীর ক্ষমতায়ন এবং সর্বোপরি গ্রামে কর্মসংস্থান সৃষ্টির মাধ্যমে গ্রামের মানুষের আয়ের সংস্থান জরুরি।

পুনরুজ্জীবন শব্দটার মানে একসময় জীবিত ছিল কিন্তু এখন মুমূর্ষু, এমন কিছুকে পুনরায় জীবন দান করা। নবাবি আমল এমন একটি আমল, যখন বাংলায় গ্রাম জীবিত ছিল। সে সময় বাংলার তাঁতিরা ইউরোপে এত বিপুল পরিমাণে কাপড় পাঠাতেন যে সেখানকার তাঁতিরা বেকার হয়ে যান। ব্রিটিশ লেখক ড্যানিয়েল ডিফো পর্যন্ত নিজ দেশের তাঁতিদের সপক্ষে আইন করার আন্দোলনে নেমেছেন। বাংলার তাঁতিদের উৎপাদনের জোরে প্রথম এশিয়ায়, পরে মধ্যপ্রাচ্যে ও শেষে ইউরোপের তাঁতশিল্প বিনষ্ট হওয়ার পথে। বিশ্ব ইতিহাসে এই প্রথম কোনো একটি সাধারণ পণ্য বিশ্ববাজারে একক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে। বাংলার গাঁইয়ারা কী করে এত উৎপাদন করতে সক্ষম হলেন, যা দিয়ে বিশ্ববাজার দখল ও বিশ্বের চাহিদা পূরণ করতে সক্ষম হলেন? বাংলা এই উদ্বৃত্ত চাহিদা বা বিপুল উৎপাদনের সমস্যা সামাল দিত বড় কারখানা করে নয়; কাজ বাড়িয়ে, চাষ বাড়িয়ে, কাজের মানুষ বাড়িয়ে, দক্ষ কারিগর বাড়িয়ে ও গৃহস্থ কারখানার সংখ্যা বাড়িয়ে। এই ব্যবস্থায় কোটি কোটি উৎপাদক কোটি কোটি বিক্রেতা। ফলে, কারওই হাতে অতিরিক্ত অর্থ লাভের সম্ভাবনা ছিল না। আর কয়েক ক্রোশ দূরের একেকটি বাজার ছিল স্বতন্ত্র ও অনন্য। উদ্বৃত্তটুকুই কেবল আন্তর্জাতিক বাজারে যেত। আজ ইউরোপে সেই পদ্ধতিই চালু হচ্ছে।

লন্ডন থেকে প্রকাশিত ১৭৫৮ সালের অ্যানুয়াল রেজিস্টারে এবং রবার্ট ওরমে তাঁর ‘হিস্ট্রি অব মিলিটারি ট্রানজাকশন ইন ইন্দোস্তান’–এ বাংলার শস্য শ্যামলিমার জন্য ধন্যবাদ দিচ্ছেন মে থেকে আগস্টের বর্ষার জলে ভেসে আসা পলিকে। বাংলার প্রধান ফসল ধান। এক ফার্দিংয়ে দুই পাউন্ড ধান পাওয়া যায়। অল্প আয়াসে যেকোনো ফসল ফলে। সর্বত্র আখের চাষ হয়। গরু-মহিষ প্রচুর। কম দুধ দেয়, কিন্তু সংখ্যায় এত বেশি যে পুষিয়ে যায়। মাছ প্রচুর। প্রচুর লবণ তৈরি হয়। অবসরে চাষিরা রেশম ও কার্পাস বোনে। বাংলায় সবচেয়ে বেশি কাপড় তৈরি হয়। কাঁচা রেশম ও কাপড় ভারতের বিভিন্ন স্থানে ও ইউরোপে চালান যায়। এ ছাড়া চাল, সুপারি, আদা, লম্বা লঙ্কা, হলুদ, অন্যান্য ভেষজ ও কৃষিজাত সামগ্রীও রপ্তানি করে। মানচিত্র তৈরি করা কোম্পানির জরিপ মাস্টার রেনেল বলেছেন, বাংলার লোকসংখ্যা এক কোটি, (ডাওয়ের মতে দেড় কোটি)। এ জনসংখ্যার বাংলা পৃথিবীর অন্যতম উর্বর সমতলভূমি এবং নদীমাতৃক বাংলার মানুষ অতিশয় পরিশ্রমী এবং তারা আরও দেড় কোটি মানুষের খাদ্য সহজেই উৎপাদন করার ক্ষমতা রাখে।

বাংলার কারিগরেরা শ্রমিক ছিলেন না। তাঁরা কারিগরি আর প্রযুক্তির জন্য নিজের দেশের কারিগরদের তৈরি হাতিয়ার আর যন্ত্রের ওপর নির্ভর করতেন, যে যন্ত্রের ওপর তাকে লুটেরা পৌনঃপুনিক পেটেন্ট কর দিতে হতো না। হয় নিজে বা তার বাড়ির পাশেই যন্ত্র বা হাতিয়ার সারানোর ব্যবস্থা থাকত। কাঁচামাল, প্রযুক্তি আর যন্ত্র চালানোর শক্তি যেহেতু নিজের আওতায়, তাই উৎপাদনের অন্য চলকগুলো তাদের নিয়ন্ত্রণ করতে অসুবিধা হয়নি। বেশি উৎপাদনের দরকারে সেসবকে কারিগর নিজ বুদ্ধি দিয়ে সামলে নিয়েছেন।

আলেক্সান্ডার ডাও বলেছেন, ‘বিশ্বে বাংলা একমাত্র পাত্র, যেখানে সোনাদানা জমত আর কণামাত্র বেরোত না।’ লন্ডনের পরিচালক সমিতি ১৭৩৫ সালে লিখছে, সারা ভারতের মধ্যে বাংলাই সবচেয়ে সস্তাগন্ডার দেশ। শুধু তা–ই নয়, সারা ভারতের মধ্যে এটাই সবচেয়ে প্রাচুর্যের দেশ।’ পলাশী–পূর্ব বাংলা আমদানি করত মূলত যুদ্ধের ঘোড়া, সোনা-রুপা-তামা-কড়ি-রত্নসহ বেশ কিছু বিলাসদ্রব্য কিন্তু রপ্তানি করত বিশ্ববাজারের প্রয়োজনীয় সবকিছু। ছিল নিট রপ্তানিকারক, বাণিজ্য-উদ্বৃত্তের দেশ, জান্নাতুল বিদা বা মর্ত্যের স্বর্গ।

মীরজাফরের শাসনামলে বাংলার ব্যবসা দখল করেছে ইউরোপীয়রা। বিকেন্দ্রীভূত সিন্ডিকেটহীন উৎপাদনব্যবস্থা, তার পণ্যের বাজার ধ্বংস করে ইউরোপের খাতকে পরিণত করেছে। পলাশীর ৭০ বছরের মধ্যেই তাঁতের, লোহার, কাঁসার বিপুল প্রযুক্তি ধ্বংস করেছে, ছোট আঁশের তুলো চাষ উঠে গেছে। কারিগরদের বিশ্ববাজার করপোরেটের কুক্ষিগত হয় তখন। সেই ধারা স্বাধীনতার ৪৮ বছর ধরে আরও বিকাশমান। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবে যে কর্মহীনতা আসছে, তা ঠেকাতে পারে একমাত্র প্রজন্মপরম্পরার জ্ঞানভিত্তিক শিল্প।

গ্রাম জাগবে কোথায়, অস্তিত্বই নাই হয়ে গেল প্রায়। বাণিজ্যিক কৃষি গ্রামকে জাগাবে কী, উল্টো নাই করে দেবে আরও। তেমনি বড় কারখানা সামনের দিনে রোবটভিত্তিক স্তরে চলে গিয়ে উল্টো বেকারত্বই সৃষ্টি করবে। সেটা ঠেকানোর উপায় কৃষকের কারিগর হয়ে ওঠার মধ্যেই। আর এপথেই গ্রামের ক্রম মুক্তি ঘটবে।

লেখক: সভাপতি, কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ, রেল-নৌ যোগাযোগ ও পরিবেশ উন্নয়ন গণকমিটি।
[email protected]