গ্রামগুলো যেন শহর না হয়!

‘ধনধান্য পুষ্পভরা আমাদের এই বসুন্ধরা’ দ্বিজেন্দ্র লাল রায়ের সেই সরব উক্তিটি আমাদের মনে করিয়ে দেয় সবুজে ভরা গ্রামবাংলার অপার প্রান্তরের কথা। কত কবি-কত সাধক এই গ্রামবাংলার ভালোবাসায় বিমোহিত হয়ে বছরের পর বছর কাটিয়ে দিয়েছেন বাংলার গ্রামগুলোতে। আজ যেন সেই অপার সবুজের হাতছানি কোথায় হারিয়ে যাচ্ছে! ছোটবেলার পাঠ্যবইয়ে আমরাও পড়েছি, ‘আমাদের ছোট নদী চলে বাঁকে বাঁকে, বৈশাখ মাসে তার হাঁটুজল থাকে’ ‘বাঁশবাগানের মাথার উপর চাঁদ উঠেছে ওই, মাগো আমার শোলক-বলা কাজলা দিদি কই’ কিংবা ‘তালগাছ এক পায়ে দাঁড়িয়ে—সব গাছ ছাড়িয়ে’। জীবনানন্দের রূপসী বাংলা আর রবিঠাকুরের সোনার বাংলা যা-ই বলি না কেন, সব ক্ষেত্রেই চোখের সামনে শুধু ভেসে আসে বাংলার সবুজ প্রকৃতি আর ফসলের প্রান্তর।

রবীন্দ্র রচনাবলি থেকেও জানতে পারা যায় রবিঠাকুর কুঠিবাড়ির দোতলায় সঙ্গীহীন উন্মুক্ত ঘরের মধ্যে বসে জানালা থেকে খালে চলমান নৌকা, অপর পারের গ্রাম, এপারের অনতিদূরের লোকালয়—তাদের জীবনযাত্রা পর্যবেক্ষণ করতেন। দেখতেন গ্রামের মানুষের আসা-যাওয়া, উপলব্ধি করতেন বটের শ্যামল ছায়া, মেঘমুক্ত আকাশ, সবুজ মাঠের সীমানা, উদাসীন প্রকৃতি আর এসবের মধ্য দিয়েই বাংলাদেশের পল্লিজীবনের সঙ্গে রবিঠাকুরের পরিচয়ের সূত্রপাত। এর পরেই পল্লিজীবনের ঘনঘটা আর মানুষের সুখ-দুঃখ তাঁর লেখার একটা বড় অংশজুড়ে রয়েছে। শেষ বয়সে তিনি নিজেই বলেছেন, ‘গল্পগুচ্ছের গল্পগুলো যেমন মানুষের প্রাত্যহিক ঘরোয়া জীবন নিয়ে গড়ে উঠেছে, আজকাল আর সে রকম হয় না। আশ্চর্য লাগে আমার, কী করে অত ডিটেইল মনে হতো, লিখতুম কি ক’রে।’ শুধু তা-ই নয়, তাঁর স্থাপত্য ভাবনায়ও সর্বত্র স্থান পেয়েছে বাংলার গ্রামগুলোর মানুষের জীবনের সরল এক বহিঃপ্রকাশ। আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর লেখা শেখ মুজিব আমার পিতা গ্রন্থে তুলে ধরেছেন তাঁর শৈশবের গ্রামজীবনের ছবি। বলেছেন, শীতের দিনে নদীর উষ্ণ জলে পা ভেজানোর কথা, কলাগাছ ফেলে সাঁতার কাটা, গামছা বিছিয়ে মাছ ধরা আর বৈশাখে কাঁচা আম কুচি কুচি করে কেটে সরষেবাটা আর কাঁচা মরিচের ঝালের কথা। তিনি ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন গ্রামকে ভালোবেসে তিনি যেন জীবনের শেষ দিনগুলোতে শহুরে কোলাহল থেকে মুক্ত হয়ে গ্রামে স্থায়ীভাবে কাটানোর কথা, আরও বলেছেন নদীর ধারে একটা ঘর তৈরির কথা। এখানে এই কথাগুলো বলার যুক্তিসংগত কারণ আছে বৈকি! দিন দিন আমরা শহরগুলোর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ধ্বংস করছি আমাদের গ্রাম্য আর মফস্বলের সরলতাকে। এই জন্য দায়ী আমরা নিজেরাই। যে গ্রামগুলো নিয়ে আমাদের এত গল্প ও আশা-ভরসা, সেই গ্রামগুলোই হারাচ্ছে সৌন্দর্য-সবুজের সমারোহ।

মফস্বল শহরগুলোও এর ব্যতিক্রম নয়। যেখানে সেখানে গড়ে উঠছে নানা মানের অপরিকল্পিত স্থাপনা-অবকাঠামো। পরিকল্পনাহীনভাবে ভরে উঠছে ইট আর লোহার জঞ্জাল। কাল যেখানে ছিল অরণ্য, ছায়া-শীতল আবাসস্থল, যেখানে পাখিরাও বাস করত নির্বিঘ্নে, আজ সেখানে চিন্তাভাবনা ছাড়াই রাতারাতি গড়ে তোলা হচ্ছে ইটের দেয়াল; কাল যেখানে ছিল নদীর স্রোত, আজ সেখানে রাতের আঁধারে মাটি ভরাট করে তৈরি করা হচ্ছে দোকানপাট। অথচ আমাদের দেশের প্রতিটি গ্রাম, মফস্বল নিজস্ব কিছু বৈশিষ্ট্যে আচ্ছাদিত এবং একে অপরের থেকে স্বতন্ত্র। আছে কিছু নিজস্ব স্থাপত্য রীতিনীতি, যা অনেক আগে থেকেই প্রতিষ্ঠিত। আজ আমরা কেউই বুঝতে পারি না কোনটা রাজশাহী, কোনটা চট্টগ্রাম কিংবা কোনটা ঢাকা শহর ও তাদের অন্তর্গত কোনো গ্রাম বা মফস্বলের স্থাপনা। আরও স্পষ্ট করে বললে, এখনো আমাদের ভিন্ন ভিন্ন শহর, মফস্বল কিংবা গ্রামকেন্দ্রিক স্থাপত্যের নিজস্ব প্যাটার্ন বা রূপরেখা নেই, যা একে অপরের থেকে নিজস্ব রীতিনীতি, ভাবধারা কিংবা পরিবেশগত কারণে ভিন্নতর, যা সত্যিই অনভিপ্রেত। এভাবে চলতে থাকলে অচিরেই গ্রাম কিংবা মফস্বল নামক বস্তুর অস্তিত্ব একরকম যে বিলীন হবে, সেটি আজকের অবস্থান থেকে নির্দ্বিধায় বলা যায়! কারণ, অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যায়, আমাদের দেশের গ্রাম কিংবা মফস্বলগুলোতে যে কেউ পরিকল্পিত যাচাই-বাছাই ছাড়াই যেকোনো প্রকার ছোট-মাঝারি মানের স্থাপনা তৈরি করে ফেলতে সক্ষম। এমনকি বর্তমানে উপজেলা কিংবা পৌরসভায় স্থাপনা তৈরির প্রচলিত যে অনুমতির কথা উল্লেখ আছে, সেখানে কেবল স্থাপনার চারপাশে ও সম্মুখ রাস্তার জন্য কতটুকু জায়গাজমি ছাড়তে হবে, অবকাঠামো, ইত্যাদি ছাড়া সেই নির্দিষ্ট অঞ্চলের নিজস্ব কৃষ্টি–কালচার আর পরিবেশের কথা মোটেও চিন্তা করা হচ্ছে না নকশা অনুমোদনের ক্ষেত্রে। এমনকি দেশে বর্তমানে যে ইমারত নির্মাণ বিধিমালা শহরগুলোতে প্রচলিত, সেখানেও প্রকৃতপক্ষে জায়গাজমির হিসাবনিকাশ ছাড়া শহরের স্থান, কাল, প্রকৃতি ও পরিবেশভেদে আলাদা কোনো চিন্তাভাবনার প্রকাশভঙ্গি কিংবা বিচার-বিবেচনা-পর্যালোচনার যথেষ্ট সুযোগ নেই, যা দেশের সামগ্রিক টেকসই উন্নয়নের জন্য অতি জরুরি। 

এভাবেই দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে আমাদের গ্রাম, উপশহর আর শহরকেন্দ্রিক ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি, যা নিয়ে আমাদের ভাবতে হবে অতি শিগগিরই। নইলে গ্রাম আর মফস্বলগুলোও একদিন শহরে পরিণত হবে অপরিকল্পিতভাবে। বর্তমানে প্রচলিত আইন-নিয়মাবলি আমাদের দরকার নেই, তা মোটেই বলছি না। কিন্তু সেগুলো যদি নির্দিষ্ট স্থানের বৈশিষ্ট্য কিংবা সংস্কৃতির সঙ্গে অঞ্চলভেদে সম্পৃক্ত হয়, তাহলেই বোধ হয় আমাদের শিল্প-সংস্কৃতি কিংবা আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্য ধরে রাখা সম্ভব হবে। প্রয়োজন অঞ্চলভেদে ইমারত নির্মাণ বিধিমালার সম্পূরক অবস্থান। তবে আশার কথা এই যে বর্তমানে স্থানীয় সরকার, পল্লি উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়, স্থানীয় সরকার বিভাগ কর্তৃক উন্নয়ন কর্তৃপক্ষসমূহের আওতাবহির্ভূত সিটি করপোরেশন, পৌরসভা ও উপজেলায় স্থাপনার নকশা অনুমোদন এবং ভবনের গুণগতমান নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে দেশের সব সিটি করপোরেশন, পৌরসভা ও উপজেলা পরিষদসমূহে গঠিতব্য কমিটিগুলোতে স্থপতি, পরিকল্পনাবিদ, প্রকৌশলীসহ অন্যদের সমন্বয়ে যে কমিটির কথা বলা হয়েছে, সেটি যদি সঠিক পন্থায় নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করে তাহলে বেশ কিছু সুফল পাওয়া সম্ভব। আর এ ক্ষেত্রে যাঁরা এ কাজে নিয়োজিত থাকবেন, তাঁদের জন্য বিষয় সংশ্লিষ্ট প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। সামগ্রিক পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের মাধ্যমে এটি সফল করা সম্ভব।

সজল চৌধুরী: সহকারী অধ্যাপক, স্থাপত্য বিভাগ, চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।