গ্রামে ফেরা মানুষদের ধরে রাখতে হলে

কাজ হারিয়ে ঢাকা ছাড়ছে মানুষ
ছবি প্রথম আলো

করোনাভাইরাস মহামারির প্রাদুর্ভাবের আগে এক নিবন্ধে লিখেছিলাম, ঢাকা মহানগরে বসবাসের যন্ত্রণা সইতে না পেরে অনেকেই গ্রামে চলে যাচ্ছেন। করোনার ধাক্কায় সেই প্রবণতা আরও গতি পেয়েছে। মধ্যবিত্ত থেকে শুরু করে শ্রমজীবী—করোনার ধাক্কায় কে না আক্রান্ত হয়েছে। কারও কাজ গেছে, কারও আয় কমেছে, জীবন হয়ে পড়েছে অনিশ্চিত। সহকর্মীদের মধ্যে একজনের কথা বলা যায়, যাঁর স্ত্রী এপ্রিল মাস থেকেই বেতন পান না এবং একপর্যায়ে তাঁর চাকরি যখন চলে গেল, তখন তল্পিতল্পা গুটিয়ে বাড়ি চলে যাওয়া ছাড়া গত্যন্তর রইল না।
দেহের সব রক্ত মুখে জমা হলে যেমন তাকে স্বাস্থ্যের লক্ষণ বলা যায় না, তেমনি দেশের সব উন্নয়ন রাজধানীকেন্দ্রিক হলে তাকেও উন্নয়ন বলা যায় না। কথা হচ্ছে, গ্রামকে অবহেলিত রেখে উন্নয়ন সম্ভব নয়। এমনকি মফস্বল শহরগুলোর সঙ্গেও রাজধানীর ব্যবধান আকাশ-পাতাল। অথচ গ্রামে কাজের সংস্থান থাকলে জয়পুরহাটের কৃষকসন্তানকে ঢাকা বা চট্টগ্রাম শহরে গিয়ে রিকশা চালাতে এবং বস্তিতে মানবেতর জীবন যাপন করে প্রাণশক্তি ক্ষয় করতে হতো না।

শহর ছেড়ে গ্রামে গিয়ে যাঁরা কৃষি নিয়ে কাজ করছেন, তাঁদের বড় অংশই উচ্চশিক্ষিত মানুষ। তাঁদের অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে কৃষিতে বড় পরিবর্তন সূচিত হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন।

ঢাকা মহানগরে জীবনযাপন এত কঠিন হয়ে পড়েছে যে গ্রামে বা নিজের শহরে কাজের সংস্থান হলে সিংহভাগ মানুষই ঢাকা ছাড়বেন। যাঁরা এত দিন মাটি কামড়ে পড়ে ছিলেন, তাঁদের অনেকেই করোনার ধাক্কায় শেষমেশ ঢাকা ছেড়েছেন। এমনও জানা গেছে, ৩০ বছর কাজ করেও এই শহরে সম্পদ সৃষ্টি করতে পারেননি অনেকে। ফলে, এ শহর তাঁদের আপন হয়নি। পরিণামে এখন উল্টো অভিবাসন শুরু হয়েছে—শহর ছেড়ে মানুষ গ্রামে যেতে শুরু করেছে।
শহর ছেড়ে গ্রামে গিয়ে যাঁরা কৃষি নিয়ে কাজ করছেন, তাঁদের বড় অংশই উচ্চশিক্ষিত মানুষ। তাঁদের অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে কৃষিতে বড় পরিবর্তন সূচিত হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন। সম্ভাবনা যে বিপুল, তার আরেকটি প্রমাণ হলো বিদেশি বিনিয়োগকারীরাও এখন বাংলাদেশের কৃষি ও কৃষিপ্রযুক্তিতে বিনিয়োগে আগ্রহী হয়ে উঠছেন। তাই আশা করা যায়, একসময় এগ্রিকালচার থেকে ফার্মিংয়ের যুগে ঢুকবে বাংলাদেশ। সম্প্রতি আমেরিকান চেম্বারের একটি অনুষ্ঠানে এমনটাই আলোচনা হয়েছে। অন্যদিকে দেশে কৃষিবিষয়ক স্টার্টআপও গড়ে উঠতে শুরু করেছে। কৃষিপ্রযুক্তিতেও বিনিয়োগের আগ্রহ দেখা যাচ্ছে। গত বছর ইউএসএআইডির এক গবেষণায় তৈরি পোশাক খাতের যে ছয়টি খাতকে রপ্তানির সম্ভাবনাময় খাত হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে, কৃষি প্রক্রিয়াজাতকরণ তার মধ্যে একটি।

তবে প্রশাসনিক কর্মকর্তারা মনে করেন, গ্রামাঞ্চলে নীরব কৃষিবিপ্লব ঘটে যাচ্ছে। এতে প্রযুক্তি বড় ভূমিকা পালন করছে। কৃষকেরা মাঠে বসে অনেক সমস্যার সমাধান পাচ্ছেন। কৃষি, পশুপালন, খামার, পাখি, মৎস্য ইত্যাদি নিয়ে ব্যক্তি-উদ্যোগে গড়ে ওঠা ইউটিউব চ্যানেলগুলোর মাধ্যমে জ্ঞান ছড়িয়ে পড়ছে। শিক্ষিত মানুষ কৃষিতে আগ্রহ পাচ্ছেন। এখন সরবরাহ ও বাজারজাতকরণ ব্যবস্থা আরও উন্নত হলে এর সুফল আরও ভালোভাবে ভোগ করা যাবে।
গত দুই দশকে দেশের কৃষি উৎপাদন ব্যাপক হারে বেড়েছে। সবজি উৎপাদনে তৃতীয় আর চাল ও মাছ উৎপাদনে চতুর্থ স্থানে। কিন্তু মূল্য সংযোজনে এ খাত অনেক পিছিয়ে আছে। অপচয়ও হয় প্রচুর। যেমন মৌসুমি ফল উৎপাদনে বাংলাদেশ শীর্ষ ১০ দেশের তালিকায়, অথচ ফল সংগ্রহ-পরবর্তী সময়ে সংরক্ষণের সুযোগের অভাবে ৪৫ শতাংশ নষ্ট হয়। তবে সম্প্রতি প্রক্রিয়াজাত কৃষিপণ্যের রপ্তানি প্রবৃদ্ধি আশাব্যঞ্জক। চলতি বছরের জুলাই-আগস্ট মাসে এ খাতের প্রবৃদ্ধি ৩২ দশমিক ৬৪ শতাংশ।
কৃষি প্রক্রিয়াজাতকরণের সম্ভাবনা ব্যাপক বলেই মনে করেন আনিস মাহমুদ। এতে রপ্তানির সুযোগ সৃষ্টি হবে। কর্মসংস্থানও হবে। ফল সংগ্রহ-পরবর্তী পর্যায়ে যে বিপুল অপচয় হয়, তা যেমন রোধ করা যাবে, তেমনি মূল্য সংযোজনও হবে। অন্যদিকে দেশের বাজারেও ভারসাম্য আসবে। তাঁর কথা হলো, বড় বড় কিছু কোম্পানি কৃষি প্রক্রিয়াজাতকরণ করছে। তারা আরও এগিয়ে এলে দেশের বাজারেও কৃষিপণ্যের দাম বাড়বে। পাইকারদের হাত থেকে কৃষকেরা রক্ষা পাবেন।
কর্মসংস্থানের সবচেয়ে বড় খাত কৃষি, যদিও জিডিপিতে কৃষির অবদান কমছে। ফলে, কৃষি প্রক্রিয়াজাতকরণ আরও অনেক মানুষের কর্মসংস্থান করতে পারবে। সেটা হলে গ্রামের মানুষের জীবনমানের উন্নতি হবে। গড়ে উঠবে শহরের মতো পরিষেবা ব্যবস্থা। তার ফলে মানুষ গ্রামে থাকতে উৎসাহী হবে।

প্রতীক বর্ধন সাংবাদিক।