গ্রামে হবে সালিস, আদালত হোক উপজেলায়

৫ সেপ্টেম্বর প্রথম আলোয় ‘কার্যকর গ্রাম আদালতের প্রত‌্যাশা’ শীর্ষক একটি সম্পাদকীয় ছাপা হয়েছে। বিচার ও আইন-আদালত কোনো জনতুষ্টির (পপুলিস্ট) বিষয় নয়। এটি একটি অত‌্যন্ত স্পর্শকাতর ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ‘গ্রাম আদালত’ নামক যে প্রতিষ্ঠানকে কার্যকর ও শক্তিশালী করার জন‌্য বিদেশি সাহায‌্যপুষ্ট প্রকল্প প্রণয়ন করা হয় এবং প্রতিবার মেয়াদ শেষে কিছু কিছু সুপারিশ নিয়ে সরকারের দরজায় প্রকল্পের মেয়াদ বৃদ্ধির কড়া নাড়ানো হয়, তাতে বাংলাদেশের সংবিধান, বিদ‌্যমান ফৌজদারি ও দেওয়ানি আইনগুলো এবং গ্রামীণ সালিস-বিচার সংস্কৃতির রূপান্তরের প্রেক্ষাপট পুরোপুরি বিবেচনায় নেওয়া হয় না। এখানে তড়িঘড়ি প্রকল্পের মেয়াদ বৃদ্ধি বা নতুন প্রকল্প গ্রহণের প্রয়োজনটাই প্রধান হয়ে দাঁড়ায়। আবহমানকাল ধরে প্রকল্প ছাড়াই গ্রামে একটি ‘সালিসব‌্যবস্থা’ চলে এসেছে, এখন আর প্রকল্প ছাড়া তা কেন চলবে না। এখন গ্রাম আদালতের স্বার্থে প্রকল্প না প্রকল্পের স্বার্থে আদালত, তা বুঝতে কষ্ট হয়।

পৃথিবীর কোথাও স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আদালতকে যুক্ত করা হয় না। আদালত একটি স্বতন্ত্র ব‌্যবস্থা। ভারতের দিকে তাকিয়ে দেখুন, সেখানে পঞ্চায়েতব‌্যবস্থার সঙ্গে কোনো আনুষ্ঠানিক বিচারব‌্যবস্থা সংযুক্ত নয়। তবে কমিউনিটি পর্যায়ে সালিসপ্রথা বিদ‌্যমান আছে এবং থাকবে। ব্রিটিশ ও পাকিস্তানি আমল থেকে সে সালিসপ্রথার ধারাবাহিকতা ছিল। ১৯৭৬ সালে সামরিক সরকার ইউনিয়ন পরিষদের সঙ্গে আগের সালিসি ব‌্যবস্থাকে ‘আদালতে’ রূপান্তরিত করে। সত‌্যিকার অর্থে ‘গ্রাম আদালত’ বলতে যা বোঝায়, এখানে তা গ্রাম এবং আদালত কোনোটাই নয়। দলীয় প্রতীকে নির্বাচিত একজন জনপ্রতিনিধি, যিনি ইউনিয়ন পরিষদের ‘চেয়ারম‌্যান’ হন, তিনিই হন পদাধিকারবলে এ আদালতের প্রধান বিচারক। অন‌্য দুজন ইউনিয়ন পরিষদ সদস‌্য, তাঁরাও নির্বাচিত ব‌্যক্তি। নির্বাচিত ব‌্যক্তিরা যে কাজের জন‌্য নির্বাচিত, তাঁরা সে কাজটি ভালোভাবে করুন। তাঁরা আদালত বসিয়ে বিচারও করবেন, দেশের সংবিধান সে দায়দায়িত্ব কোনো নির্বাচিত সংস্থাকে দেয়নি। আদালতের নিয়ন্ত্রণবহির্ভূত কোনো সংস্থার নামের আগে–পিছে ‘আদালত’ লেখা যায় বলেও জানা নেই।

তা ছাড়া ‘স্থানীয় সরকার’ সংবিধানে শাসন বিভাগের অন্তর্গত বিষয়। স্থানীয় সরকারের ওপর আদালতের এখতিয়ার নেই, আদালত কার্যক্রমেও স্থানীয় সরকারের কোনোরূপ হস্তক্ষেপ থাকুক সেটি কেউ চাইতে পারে না। সংবিধান শাসন বিভাগ ও বিচার বিভাগকে স্পষ্টভাবে পৃথক করে দিয়েছে এবং এ বিধান দেশে এখন পুরোপুরি কার্যকর। কোনো প্রকল্পের গবেষণায় রাজনৈতিক দলের প্রতীকে নির্বাচিত একটি সংস্থা বিচারকার্যে অতিশয় কার্যকর প্রমাণিত হলেও নয়। তাহলে সংবিধান, দেশের ফৌজদারি ও দেওয়ানি আইন এবং দীর্ঘদিনের বিচারপ্রক্রিয়ার অনুসৃত নীতি ভঙ্গ হয়। তাঁরা উভয় পক্ষের সম্মতিতে সালিস–মীমাংসা ও এডিআর ইত‌্যাদিতে অংশ নিতে পারেন, কিন্তু আদালত বসিয়ে বিচার করতে পারেন না। গ্রাম আদালতের নামে যে আইন, তা বর্তমান সংবিধানসম্মত নয়। আদালতে এ বিষয়ে ব‌্যাখ‌্যা চাওয়া যেতে পারে।

ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম‌্যান ও সদস‌্য পদপ্রার্থী হওয়ার শর্ত হিসেবে তাঁদের আইনবিষয়ক জ্ঞান থাকা আবশ‌্যক নয়। কিন্তু নির্বাচিত হওয়ার পর তাঁরা কীভাবে বিচারক হয়ে যান? তার ফলে অনেক ন্যায়বিচারের ব্যত্যয় ঘটে (মিসক‌্যারিজ অব জাস্টিজ) হয়। এগুলো দেখার কেউ নেই। অনেকে ইউএনওদের এসব দেখার কথা বলেন। সত‌্যিকার অর্থে ইউএনওর কাজের কোনো শেষ নেই। এ বাড়তি দায়িত্ব দিয়ে বিচারকাজের প্রতি সুবিচার হবে না বা তদারকিও কার্যকরভাবে সম্ভব নয়।

বিষয়টি নিয়ে এর আগেও আমি লিখেছি (প্রথম আলো ২৫/২০/২০১২ এবং ০৬/১২/২০১৮)। উচ্চ আদালতে এ বিষয়ে মামলাও হয়েছে। আসল কথা হচ্ছে স্থায়ী ও টেকসই সমাধানের লক্ষ্যে কেউ আন্তরিকতা নিয়ে এগিয়ে আসছেন না। দেশের বিজ্ঞজনদের সুচিন্তিত অভিমত হচ্ছে পপুলিস্ট চিন্তাজাত গ্রাম আদালতের এই ভ্রান্ত ধারণা থেকে বের হয়ে জেলার নিচে বিচার প্রশাসন বিকেন্দ্রায়ণের একটি সুষ্ঠু পদক্ষেপ গ্রহণ এখন সময়ের দাবি। ১৯৮০ সালের পর সাত–আট বছর ধরে উপজেলা পর্যায়ে নিম্ন আদালত সম্প্রসারণের অভিজ্ঞতার আলোকে প্রধান বিচারপতি, আইন মন্ত্রণালয়, সামগ্রিক অর্থে সরকার বিষয়টি বিবেচনা করে দেখতে পারে। দেশের আইন কমিশন এ বিষয়টি নিয়ে কাজ করতে পারে। উপজেলা পর্যায়ে প্রায় ৩৫টি সরকারি বিভাগ ও সংস্থা কাজ করে। সেখানে বিচার বিভাগের অনুপস্থিতি দেশের মানুষের মধ্যে বিচার বৈষম‌্য সৃষ্টি করেছে। গ্রামাঞ্চলে বিচারহীনতার সংস্কৃতি স্থায়ী রূপ পেয়ে গেছে। উপজেলা পর্যায়ে বিচার বিভাগ সম্প্রসারণ করে এ বৈষম‌্য দূর করতে হবে।

গ্রামাঞ্চলে প্রথাগত সালিসপ্রথাকে নতুন আঙ্গিকে পুনর্গঠিত করতে হবে। তা অবশ‌্যই গ্রাম আদালতের আঙ্গিকে নয়। তবে সেখানে উপজেলা আদালত ও গ্রামের সালিসব‌্যবস্থার একটা সংযোগ ইউনিয়ন পরিষদের মাধ‌্যমে করা যায়। বিদ‌্যমান আইনে গ্রাম আদালতের যে এখতিয়ার, তাতে আনুষ্ঠানিকভাবে এ আদালতে বেশির ভাগ মামলার নিষ্পত্তি সম্ভব হয় না। এগুলো তথাকথিত আদালতের বাইরে মীমাংসা হয়। অনেক সময় এসব মীমাংসায় প্রভাবশালী পক্ষ দুর্বল পক্ষের ওপর তাদের মতামত জোর করে চাপিয়ে দেয়। তাই বলে গ্রাম আদালতের এখতিয়ার ও ক্ষমতা বাড়াতে হবে, এই মতের সমর্থন করা যায় না। সুপারিশ হচ্ছে গ্রামপর্যায়ে শক্তিশালী সালিসব‌্যবস্থা বজায় রেখে উপজেলা পর্যায়ে সিনিয়র সহকারী জজ (ফৌজদারি ও দেওয়ানি) আদালত প্রতিষ্ঠা। প্রচলিত গ্রাম আদালত থেকে সুবিচার প্রত‌্যাশা সুদূরপরাহত। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে হলে জেলার নিচে নিম্ন আদালতের সম্প্রসারণ সময়ের দাবি।

ড. তোফায়েল আহমেদ স্থানীয় শাসন বিশেষজ্ঞ