গ্রিসের দেউলিয়া হওয়ার পেছনে দায়ভার কার!

গ্রিস গণতন্ত্রের সূতিকাগার বটে, তবে প্রকৃত গণতন্ত্রচর্চাটা বিগত দশকে তাঁরা কমই করেছেন। একজন সাধারণ গেরস্থ যদি তাঁর আয়-ব্যয়ের সীমারেখা বোঝেন বা সীমাহীন ঋণ করে ব্যয় করাটা যে আত্মঘাতী হবে—তা বোঝেন, তবে গ্রিসের মতো আদি গণতন্ত্রের ধারক দেশ তা বুঝতে অক্ষম হলো কেন? বছরের পর বছর ঋণ করে ঘাটতি বাজেট দিয়ে দেশ চালানোর তুমুল নেশাই আজ গ্রিসের মতো দেশকে দেউলিয়া করে ছেড়েছে।
ইউরোপের ২৮টি দেশ নিয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়ন গঠিত হলেও ২০০২ সাল থেকে ১০টি দেশ নিয়ে ইউরো মুদ্রাব্যবস্থা চালু হয়েছিল। ইউরোপীয় ইউনিয়নের অর্থনীতিকে আরও স্বাবলম্বী ও মার্কিন ডলারের বিপরীতে বিশ্বমানের মুদ্রাব্যবস্থাসহ ইউরো মুদ্রাভুক্ত দেশগুলো নিজেদের আমদানি-রপ্তানিকে আরও সহজ ও অর্থবহ করার জন্যই মূলত এই উদ্যোগ। ক্রমান্বয়ে ইউরো মুদ্রা ব্যবহারকারী দেশগুলোর সংখ্যা দাঁড়ায় উনিশে এবং সদস্যভুক্ত দেশগুলোকে ইউরোজোনের অন্তর্ভুক্ত দেশ বলে অভিহিত করা হয়।
এই মুদ্রাব্যবস্থা চালুর প্রথম দিকে বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রীয় অর্থনৈতিক কাঠামোতে কী ধরনের সংকট সৃষ্টি করবে বা ধকল যাবে, তা বোঝা যায়নি। তবে সময় থাকতেই ঘাটতি বাজেট ও রাষ্ট্রীয় ঋণ কমানোর জন্য অর্থনৈতিক সংস্কার এবং ক্রমান্বয়ে সংশোধিত নীতির মধ্য দিয়ে এগোলে যে এই সংকট কাটিয়ে ওঠা যাবে, তা মোটামুটি পরিষ্কার হয়ে যায়।
আজকে গ্রিসের যে দেউলিয়া অবস্থা, সেই একই ধরনের বা কিছুটা লঘু সংকটে নিমজ্জিত হয়েছিল ইউরো জোনভুক্ত দেশ আয়ারল্যান্ড, সাইপ্রাস, ফিনল্যান্ড ও পর্তুগালের মতো ছোট দেশগুলোও। তবে দীর্ঘস্থায়ী সুফলের আশায় সংকটাপন্ন দেশগুলো ঋণ গ্রহণ করে বা তাদের ঘাটতি বাজেট ক্রমান্বয়ে কমিয়ে এনে অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা এনেছে।
তবে সেই সময় থেকেই সাধারণ জনগণ ও শ্রমিক শ্রেণি থেকে এসব নিয়মনীতি, নানা ক্ষেত্রে কর বৃদ্ধি ও কৃচ্ছ্রসাধনের বিরুদ্ধে বারবার বাধা এলেও রাজনীতিকেরা বোঝাতে সক্ষম হয়েছিলেন যে এই সংস্কার ছাড়া দেশ অর্থনৈতিকভাবে দেউলিয়া হয়ে যাবে আর আপাতত সাধারণ মানুষের ওপর ক্রমান্বয়ে চাপ পড়লেও বাজারব্যবস্থায় স্থিতি থাকলে ভবিষ্যতে দেশজ অর্থনীতিতে দীর্ঘস্থায়ী সুফল বয়ে আনবে।
গ্রিস সেই ২০০২ সাল থেকেই ইউরো মুদ্রাব্যবস্থা প্রচলনের প্রথম ১০টি দেশের একটি হলেও ইউরো জোনভুক্ত তাদের থেকে ভঙ্গুর অর্থনীতির অনেক দেশ ইউরো মুদ্রাব্যবস্থা প্রচলনের প্রাথমিক ঝুঁকি কাটিয়ে উঠেছে; অথচ গ্রিস ১৩ বছর ধরে ঘাটতি বাজেট কমাতে নানা ধরনের সংস্কার প্রক্রিয়া নিয়ে কেবল গড়িমসিই করেছে। সংস্কার প্রক্রিয়ার মূল তিনটি স্তর, রাজস্ব আদায়ের সংস্কৃতি, পেনশন দেওয়ার ক্ষেত্রে অপরিণামদর্শী নিয়ম এবং দেউলিয়া হয়ে যাওয়া জাতীয় বিভিন্ন সেবা সংস্থাকে বছরের পর বছর অযৌক্তিকভাবে ভর্তুকি দেওয়ার নীতি থেকে তারা সরে আসতে চায়নি।
বাম ঘরানার অনেক অর্থনীতিবিদ এবং পুঁজিবাদবিরুদ্ধ অনেকেই গ্রিসের অর্থনীতির সংকট আর দেউলিয়া হয়ে যাওয়ার কারণের প্রকৃত ঘটনা না খুঁজে গ্রিসের বামপন্থী সিরজা দলকে ক্ষমতা থেকে টেনে নামানো বা গ্রিসের গণতন্ত্রে পশ্চিমাদের হামলা বলে অভিহিত করছেন। আদতে গ্রিসও পশ্চিমা বিশ্বের বা ন্যাটো সামরিক জোটের সদস্য এবং সমস্যাটা পুঁজিবাদ ও সাম্যবাদের আদর্শের লড়াই নয়, সমস্যাটা অন্যত্র।
সাম্যবাদ বা আদর্শের কথা বললে প্রথমেই আসতে হবে গ্রিসের প্রধানমন্ত্রী আলোচিত সিপ্রাসের সমাজতান্ত্রিক ধারার সিরজা দলের ক্ষমতায় আসার কথায়। সম্পূর্ণ বিপরীত ধরনের রাজনৈতিক ধারার কট্টর দক্ষিণপন্থী ইনডিপেনডেন্ট গ্রিস দলের পানোস কামেনসের সঙ্গে জোট বেঁধে ক্ষমতায় এসেছেন। ক্ষমতায় আসার আগে দুই ঘরানার দুই রাজনৈতিক দলের নির্বাচনী কর্মসূচিও ছিল পুরোপুরি ভিন্নধর্মী। আদর্শের স্বার্থে নয়, তাঁরা জোটবদ্ধ হয়েছেন শুধু ক্ষমতার স্বার্থে।

>ঋণ নিয়ে ঘাটতি বাজেট, অর্থনৈতিক খাতে চরম বিশৃঙ্খলা ও ধারাবাহিক সংস্কারের পথে না হেঁটে ইউরোজোনভুক্ত অন্য দেশগুলোর জনগণের করের অর্থ ঋণ নিয়ে না ফেরত দেওয়ার সংস্কৃতি কখনোই সমর্থনযোগ্য হতে পারে না

ক্ষমতায় আসার আগে প্রধানমন্ত্রী অ্যালেক্সিস সিপ্রাসের সিরজা দল গ্রিসের অর্থনৈতিক দায়ভার অর্থাৎ দেশটির মোট ঋণের পরিমাণ প্রায় ৩২০ বিলিয়ন ইউরো (২৭ লাখ ৮১ হাজার ৫২৭ কোটি টাকার কিছু বেশি), বেশ ভালো করেই জানতেন। এই অর্থের বেশির ভাগই ইউরোজোনের দেশগুলোর সাধারণ মানুষের রক্ত আর ঘামে অর্জিত করের পয়সা। ২৫ জানুয়ারি ২০১৫ গ্রিসের সর্বশেষ নির্বাচনের প্রাক্কালে অ্যালেক্সিস সিপ্রাসের সিরজা দল গ্রিসের জনগণের কাছে অনেক প্রতিশ্রুতিমূলক জনপ্রিয় ও বিপ্লবী কথা বলে ৩০০ আসনবিশিষ্ট পার্লামেন্টে ১৪৯টি আসনে জয়ী হলেও তাঁরা নিজেরাও জানতেন যে ক্ষমতায় এলে এই বিশাল ঋণের দায়ভারের সমস্যা সহজেই মেটানোর নয়। তবে তাঁদের প্রতিশ্রুতিগুলো ছিল গ্রিসের জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতীক, কর–ব্যবস্থায় মধ্যবিত্তদের ওপর থেকে চাপ কমিয়ে ধনীদের ওপর কর বৃদ্ধিসহ দেশে অন্য ইউরোপীয়ভুক্ত দেশগুলোতে যে কর সংস্কৃতি চালু রয়েছে, তার প্রচলনসহ নানা জনমুখী উদ্যোগ।
কিন্তু যে দেশটি ঋণের দায়ে গলা পর্যন্ত নিমজ্জিত, যে দেশটির ৬০০ ধনাঢ্য ব্যক্তি কর ফাঁকি দিয়ে তাঁদের সব অর্থ সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকে জমা রেখেছেন, যে দেশটির বিশাল বাণিজ্য জাহাজ পরিবহন খাতের অর্ধেকেই কোনো কর প্রদান করে না, যে দেশটি পৃথিবীর ১৭৪টি দেশের মধ্যে দুর্নীতির সূচকে ১১০ নম্বরে অবস্থান করছে বা ঘুষ বাণিজ্য ছাড়া যেখানে প্রশাসন চলে না, সেই দেশের সমাজ বা অর্থনীতির খোল নলচে পাল্টিয়ে দেওয়া এতটাই সহজ নয়। প্রবল প্রতিপত্তিসম্পন্ন দুর্নীতিগ্রস্ত অভিজাত রাজনীতিকদের বিরুদ্ধে লড়াই করা বা জনগণের স্বার্থে সিরজা দলের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি তাই অচিরেই বাস্তবায়িত হচ্ছে না।
গ্রিস সরকারের মোট ঋণ ৩২০ বিলিয়ন ইউরো, তার মধ্যে শুধু জার্মান সরকারের রয়েছে ৯০ বিলিয়ন ইউরো, যা আগামী ২০২০ সালের মধ্যে ফেরত দেওয়ার জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ছিল গ্রিস। জার্মান অর্থমন্ত্রী ভলফগ্যাং সয়েবলে বলেছেন, এই পুরো ঋণ দেওয়া অর্থটি জার্মান করদাতাদের পরিশ্রমের অর্থ, সে ক্ষেত্রে দেউলিয়া হয়ে যাওয়া গ্রিস সরকারকে আরও ঋণ দিতে হলে আমাদের জনগণের সম্মতির প্রয়োজন হবে। রুগ্ণ অর্থনৈতিক অবস্থা থেকে উঠে আসা বা দাঁড়ানোর চেষ্টায় রত ইউরোজোনের ছোট দেশগুলোর বক্তব্যও প্রায় একই, তারাও বলছে, ট্রয়কা (ইউরোপীয় কমিশন, ইউরোপীয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল-আইএমএফ) প্রেসক্রিপশন মেনে আমাদের জনগণ যদি ধৈর্য আর ত্যাগ স্বীকার করে সুদিনের আশায় নিজ দেশকে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী করতে পারে, গ্রিসের জনগণ তা পারবে না কেন?
গ্রিসের আজকের ঋণগ্রস্ত হয়ে দেউলিয়া হওয়ার পেছনে রয়েছে বিগত তিনটি নির্বাচিত সরকারের দায়ভার, যারা বিগত বছরগুলোতে জনপ্রিয়তা হারানোর ভয়ে দেশজ খাতে প্রবৃদ্ধি বাড়ানোর চেষ্টা বা ধারাবাহিক সংস্কারের পথে না হেঁটে ঋণ নিয়ে দেশ চালানোর কাজেই সচেষ্ট হয়েছে।
রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে শুরু করে ঋণের অর্থ লুণ্ঠনের যে দীর্ঘ প্রক্রিয়া, তা থেকে দেশটি মুক্ত হতে পারছে না কেন?
সতর্ক করে দেওয়া সত্ত্বেও বছরের পর বছর ঘাটতি বাজেট দিয়ে দেশ চালােনার পরিণাম যে কী হতে পারে, তা টের পাচ্ছে গ্রিসের সাধারণ জনগণ। প্রশ্নটা বারবারই আসছে বিগত ১০ বছর থেকেই, ঋণের অর্থ যাচ্ছে কোথায়? এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, দীর্ঘদিন থেকে নেওয়া এই ঋণের এক-তৃতীয়াংশের মধ্য ১ ভাগ গেছে ব্যাংকগুলোর কাছে, ১ ভাগ গেছে অভিজাত ধনাঢ্যদের আরাম-আয়েশের খাতে বৈদেশিক বাণিজ্যের ঘাটতি মেটাতে, আর ১ ভাগ অর্থ গেছে গ্রিস থেকে পুঁজি পাচারের ইন্ধন জোগাতে, যা ব্যাংক থেকে তুলে নিয়ে বিদেশে পাচার করা হয়েছে।
ঋণ নিয়ে ঘাটতি বাজেট, অর্থনৈতিক খাতে চরম বিশৃঙ্খলা ও ধারাবাহিক সংস্কারের পথে না হেঁটে ইউরো জোনভুক্ত অন্য দেশগুলোর জনগণের করের অর্থ ঋণ নিয়ে না ফেরত দেওয়ার সংস্কৃতি কখনোই সমর্থনযোগ্য হতে পারে না। তাই গ্রিসের আজকের সমস্যা গ্রিসের গণতন্ত্রের প্রতি কোনো হামলা বা পুঁজিবাদ ও সাম্যবাদের আদর্শের লড়াই নয়। লড়াইটি গ্রিসের রাজনীতিকদের সঙ্গে সে দেশের আপামর সাধারণ বঞ্চিত জনগণের বোঝাপড়ার লড়াই।
সরাফ আহমেদ: প্রথম আলোর হ্যানোভার (জার্মানি) প্রতিনিধি৷
[email protected]