ঘর পোড়া গরুর সিঁদুরে মেঘে ভয়

নির্বাচন কমিশন, বিশেষত আমাদের মাননীয় সিইসি বারবার আমাদের আশ্বস্ত করার চেষ্টা করছেন যে আসন্ন ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হবে। নাগরিক হিসেবে আমরাও আশ্বস্ত হতে চাই। কারণ, সাম্প্রতিক সময়ে নির্বাচনগুলো যেভাবে হয়েছে, একই কায়দায় নির্বাচন অনুষ্ঠানজাতির জন্য চরম বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে। তবে আমাদের অবস্থা হলো ঘর পোড়া গরুর মতো, যে সিঁদুরে মেঘ দেখলেও ভয় পায়। তাই বিরাজমান আস্থার সংকট কাটানোর লক্ষ্যে কমিশন জরুরি ভিত্তিতে কয়েকটি প্রশ্নের উত্তর দিতে এবং কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নিতে পারে, বিশেষত তাদের স্বচ্ছতা-জবাবদিহি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে। উল্লেখ্য, বিদ্যমান পরিস্থিতিতে সাংবিধানিকভাবে ‘স্বাধীন’ নির্বাচন কমিশনের জবাবদিহি প্রতিষ্ঠার কোনো সুস্পষ্ট ব্যবস্থা নেই।

১. অতীতে সিইসি মহোদয় একাধিকবার বলেছিলেন যে সব দল না চাইলে জাতীয় নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার করা হবে না (প্রথম আলো, ২৯ আগস্ট ২০১৮)। কিন্তু বড় রাজনৈতিক দল বিএনপিসহ অন্তত ১২টি নিবন্ধিত দলের বিরোধিতা সত্ত্বেও প্রয়োজনীয় অর্থকড়ির সংস্থান ছাড়াই তড়িঘড়ি করে প্রায় চার হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে প্রতিটি ২ লাখ ৩২ হাজার টাকায়, যা ভারতের চেয়ে প্রায় ১১ গুণ বেশি দামে কেন ইভিএম কেনার সিদ্ধান্ত নিলেন? (প্রথম আলো, ১৫ অক্টোবর ২০১৮) বিতর্ক এড়ানোর লক্ষ্যে ভারতীয় সুপ্রিম কোর্ট তাঁদের ব্যবহৃত ইভিএমে ‘ভোটার-ভেরিফাইয়েবল পেপার অডিট ট্রেইল’ (ভিভিপিএটি) রাখার নির্দেশ দিলেও আমাদের এত বেশি দামে কেনা যন্ত্রে কেন তা রাখা হলো না? (উল্লেখ্য, ভিভিপিএটি থাকলে ভোটার কোন প্রার্থীকে ভোট দিয়েছেন, তা জানতে একটি প্রিন্ট-আউট পেতে পারতেন এবং নির্বাচনের যথার্থতা যাচাইয়ের জন্য পরবর্তী সময়ে ভোট পুনর্গণনা করাও সম্ভব হতো।)

২. গত জাতীয় নির্বাচনে যে ছয়টি আসনে ইভিএম ব্যবহার করা হয়েছে, সেই আসনগুলোতে ইভিএমের কন্ট্রোল ইউনিটে ভোটারের হাতের ছাপ শনাক্ত করা না যাওয়ার কারণে কত শতাংশ ভোটারের ক্ষেত্রে নির্বাচনী কর্মকর্তা তা ওভাররাইড করেছেন? প্রসঙ্গত, বিবিসির এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২৫ শতাংশ ক্ষেত্রে তা করার সুযোগ ছিল (২৪ নভেম্বর ২০১৮)। তা যদি হয়ে থাকে, ২৫ শতাংশ ক্ষেত্রে ভোটারের অনুপস্থিতিতে নির্বাচনী কর্মকর্তার পক্ষে জাল ভোট প্রদান করা সম্ভব ছিল।

৩. একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে যে ছয়টি আসনে ইভিএম ব্যবহার করা হয়েছে, তাতে ভোটার উপস্থিতির হার ছিল ৫১ দশমিক ৪২ শতাংশ। পেপার ব্যালট ব্যবহার করা হয়েছে অন্য ২৯৪টি আসনে, এ হার ছিল ৮০ দশমিক ৮০ শতাংশ অর্থাৎ প্রায় ৩০ শতাংশ ফারাক। এর কোনটি ভোটার উপস্থিতির সঠিক হার? একটি নির্বাচনে দুটি ভোটার উপস্থিতির সঠিক হার হতে পারে না। আর এ বিরাট ফারাকের ব্যাখ্যা কী? এ ছাড়া ইভিএম ব্যবহারের ক্ষেত্রে নির্বাচনী ফলাফল সঙ্গে সঙ্গে পাওয়ার কথা। কিন্তু ইভিএম ব্যবহৃত আসনগুলোর ফলাফল ভোট গ্রহণ সম্পন্ন হওয়ার বহু ঘণ্টা পরে প্রকাশ করা হলো কেন? উপরন্তু, প্রতিযোগিতামূলক হওয়া সত্ত্বেও গত ১৩ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত চট্টগ্রাম-৮ আসনের উপনির্বাচনে যেখানে ইভিএম ব্যবহার করা হয়েছে, মাত্র ২২ দশমিক ৯৪ শতাংশ ভোট পড়ল কেন?

৪. গত জাতীয় নির্বাচনের দিন সকালে বিবিসি চট্টগ্রাম-১০ আসনে ব্যালট পেপারভর্তি ব্যালট বাক্সের ছবি দেখিয়ে আগের রাতে ভোটের অভিযোগ তুলেছে। এ গুরুতর অভিযোগ সম্পর্কে কমিশন নিশ্চয়ই তদন্ত করে দেখেছে। কমিশন তদন্ত রিপোর্টটি কি প্রকাশ করবে? বস্তুত, আগের রাতে ভোটের ব্যাপারে রাজনৈতিক দলের বাইরেও বহু নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষকের পক্ষ থেকেওঅভিযোগ উঠেছে। এমনকি সিইসির বক্তব্য থেকেও এর ইঙ্গিত পাওয়া যায়। এ ছাড়া টিআইবিও নির্বাচন নিয়ে গুরুতর অভিযোগ উত্থাপন করেছে। কমিশন এসব অভিযোগের তদন্ত করে দেখেছে কি? এ ব্যাপারে কারও বিরুদ্ধে কি কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে?

৫. কমিশনের প্রকাশিত কেন্দ্রভিত্তিক ফলাফল থেকে দেখা যায় যে ২১৩টি কেন্দ্রে শতভাগ ভোট পড়েছে। কমিশন কি তদন্ত করে দেখেছে, এসব কেন্দ্রে কতজন ভোটার ভোটের আগে মৃত্যুবরণ করেছেন এবং কতজন বিদেশে, নির্বাচনী এলাকার বাইরে দেশে-বিদেশে কর্মে নিয়োজিত, অসুস্থতা বা কারাগারে থাকার কারণে ভোট দিতে পারেননি? রিপোর্টটি কি কমিশন প্রকাশ করবে?

৬. কেন্দ্রভিত্তিক নির্বাচনী ফলাফল থেকে দেখা যায় যে ১ হাজার ১৮৫টি কেন্দ্রে বিএনপি শূন্য ভোট পেয়েছে এবং আওয়ামী লীগ দুটি কেন্দ্রে শূন্য ভোট পেয়েছে। এ ছাড়া ৫৮৬টি কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের এবং অন্য একটি কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন জোটের প্রার্থী শতভাগ ভোট পেয়েছেন, যা অবাস্তব ও অবিশ্বাসযোগ্য। উপরন্তু, চট্টগ্রাম-১০ আসনের প্রার্থী হাসান মামুন রুমী রিটার্নিং কর্মকর্তা কর্তৃক ঘোষিত ফলাফল অনুযায়ী শূন্য ভোট পান, যদিও পরবর্তী সময়ে কেন্দ্রভিত্তিক ফলাফল থেকে দেখা যায় যে তিনি ২৪৩ ভোট পেয়েছেন। এ ছাড়া বেশ কিছু আসনে কেন্দ্রভিত্তিক ফলাফলের সঙ্গে ভোটের রাতে প্রকাশিত ফলাফলের পার্থক্য রয়েছে। কমিশনের পক্ষ থেকে এসবের ব্যাখ্যা কী? এগুলো কি কমিশন তদন্ত করেছে?

৭. জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অনেক প্রার্থীর পক্ষ থেকে, বিশেষত বিরোধী দলের প্রার্থীদের ও ভোটারদের হুমকি দেওয়ার অনেক অভিযোগ ওঠে। এ ছাড়া প্রথম আলোর (২৯ ডিসেম্বর ২০১৮) একটি তদন্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী, নির্বাচনের আগে ১৪৯ আসনে ২৫০টি সহিংস ঘটনা ঘটেছে। ডেইলি স্টার-এর (২৭ ডিসেম্বর ২০১৮) আরেকটি প্রতিবেদনে নির্বাচনী প্রচারণার সময় প্রার্থীদের ওপর ৬০টি সহিংস আক্রমণের ঘটনা ঘটেছে। এ ছাড়া ড. কামাল হোসেনসহ বিরোধী দলের নেতাদের বিরুদ্ধেও আক্রমণের অভিযোগ উঠেছে। এসব বিষয়ে এবং নির্বাচনী ফলাফল নিয়ে কমিশন ও ইলেকটোরাল ইনকোয়ারি কমিশনের কাছে অনেক লিখিত অভিযোগ পড়েছে। কমিশন এসব অভিযোগ ও এগুলোর প্রতিকারে কী ব্যবস্থা নিয়েছে, তা কি ওয়েবসাইটে প্রকাশ করবে?

৮. আমরা জেনেছি যে সংসদ নির্বাচনে প্রার্থিতা নিয়ে হাইকোর্টে যেসব মামলা হয়েছে, সেসবের কোনো ক্ষেত্রে কমিশন আপিল করেছে, আবার কোনো ক্ষেত্রে আপিল করেনি। কোন কোন মামলায় কমিশন আপিল করেছে, আর কোন মামলায় আপিল করেনি, তার একটি তালিকা সংশ্লিষ্ট উকিলের নামসহ কমিশন কি প্রকাশ করবে?

৯. আমরা শুনেছি যে সংসদ নির্বাচনের ফলাফল চ্যালেঞ্জ করে নির্বাচনী ট্রাইব্যুনালে ৭৪টি মামলা হয়েছে, গত এক বছরেও এগুলো সম্পর্কে কোনো শুনানি হয়নি। মামলাগুলোর দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য কমিশন কি কোনো উদ্যোগ নেবে? নিজেদের বিশ্বাসযোগ্যতা প্রতিষ্ঠার জন্য কমিশন কি স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে এসব আসনের ভোট পুনর্গণনা করবে?

১০. গত জাতীয় নির্বাচনের সময় নির্বাচন কমিশনার ও কমিশনের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে প্রশিক্ষণের টাকা নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করে নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। এ ব্যাপারে কমিশন কী ব্যবস্থা নিয়েছে?

১১. খুলনা ও গাজীপুর সিটি করপোরেশনে ‘নিয়ন্ত্রিত’ নির্বাচনের অভিযোগ উঠেছে। কয়েকটি গণমাধ্যমে এই নির্বাচনের নানা অনিয়মের সচিত্র প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছে। এ ব্যাপারে কমিশন কি তদন্ত করেছে? গণমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী, গাজীপুর নির্বাচনের অনিয়ম নিয়ে কমিশন একটি তদন্ত প্রতিবেদন তৈরি করেছে। কমিশন কি এটি প্রকাশ করবে?

১২. গণমাধ্যমের প্রতিবেদন থেকে আমরা জেনেছি যে ব্যাপক অনিয়মের কারণে কমিশন নির্বাচনের মাঝখানে বরিশাল সিটি নির্বাচন বন্ধ করার বিষয়টি বিবেচনা করলেও সম্ভাব্য সহিংসতা এড়াতে তা থেকে বিরত থাকে। এরপর একটি তদন্ত প্রতিবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে কমিশন ৯টি ওয়ার্ডে কমিশনার পদে পুনর্নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করে। কেন পুরো নির্বাচনটি বাতিল করা হলো না, সে সম্পর্কে কমিশন কি একটি ব্যাখ্যা দেবে? কমিশন কি তদন্ত প্রতিবেদনটি প্রকাশ করবে?

কমিশনের সাংবিধানিক দায়িত্ব সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন নিশ্চিত করা। তাই কেউ আনুষ্ঠানিক অভিযোগ না করলেও তাদের দায়িত্ব সব
অভিযোগের তদন্ত করা ও বিষয়গুলো পরিষ্কার করা। নির্বাচনী ফলাফলের গেজেট প্রকাশের পর কমিশনের আর কিছু করার থাকে না বলে যে যুক্তি দেওয়া হয়, তা সঠিক নয়। আমাদের উচ্চ আদালতের একাধিক রায় সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের খাতিরে কমিশনকে অগাধ ক্ষমতা দিয়েছে, এমনকি নির্বাচনী বিধিবিধানের সঙ্গে সংযোজনেরও [৪৫ ডিএলআর (এডি) (১৯৯৩)]। এখন এ জন্য প্রয়োজন কমিশনের সদিচ্ছা।

ড. বদিউল আলম মজুমদার: সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)–এর সম্পাদক