ঘুমের মধ্যে হাঁটার লক্ষণ চীনের

চীনের ক্রমবর্ধমান সামরিক সামর্থ্য দেশটির নেতাদের তাইওয়ানে বলপ্রয়োগে প্রলুব্ধ করছে
ফাইল ছবি: রয়টার্স

মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন প্রশাসন চীনের সঙ্গে প্রতিযোগিতার কৌশল সাজাচ্ছে। বিশ্লেষকেরা দুই শক্তিধর দেশের মধ্যে গভীর হতে চলা এ প্রতিদ্বন্দ্বিতাকে ঐতিহাসিক একটা রূপক দিয়ে ব্যাখ্যা করছেন। আবার অনেকে এটাকে শীতল যুদ্ধের সূত্রপাত বলে মনে করছেন, কিন্তু বাস্তব পরিস্থিতি এর থেকেও উদ্বেগজনক। ১৯১৪ সালে বিশ্বের সে সময়কার পরাশক্তিরা মনে করেছিল, তৃতীয় বলকান যুদ্ধ খুব সংক্ষিপ্ত হবে। কিন্তু এ ধারণা ভুল প্রমাণ করে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ স্থায়ী হয়েছিল চার বছর। সেই যুদ্ধে চারটি সাম্রাজ্যের পতন হয়েছিল। মারা গিয়েছিল দুই কোটির বেশি মানুষ। ব্রিটিশ ঐতিহাসিক খ্রিস্টোফার ক্লার্ক এ যুদ্ধকে ‘অগ্নিকুণ্ডের মধ্যে ঘুমিয়ে হাঁটা’র সঙ্গে তুলনা করেছিলেন।

সেই সময়ে আমরা যদি ফিরে যাই তাহলে আমরা দেখতে পাব, বৈশ্বিক বিন্যাস যে বদলে যাচ্ছে, তা নিয়ে নেতারা মোটেই সচেতন ছিলেন না। অথচ জাতীয়তাবাদী শক্তির ওপর ভর করে গুরুত্বপূর্ণ একটা পরিবর্তন ঘটছিল। পূর্ব ইউরোপে প্যান-স্যালাভিজম আন্দোলন অটোমান ও অস্ট্রো-হাঙ্গেরীয় সাম্রাজ্যের জন্য হুমকি হিসেবে দেখা দিয়েছিল। এ দুটি সাম্রাজ্যেই স্লাভিক জনগোষ্ঠীর সংখ্যা ছিল অনেক। জার্মান ইতিহাসবিদেরা মনে করেন, টিউটোনিক-স্লাভিক যুদ্ধ অনিবার্য ছিল। ইউরোপের শ্রমিকশ্রেণির সমাজতন্ত্র এবং ব্যাংকারদের পুঁজিতন্ত্রের চেয়েও জাতীয়তাবাদ শক্ত বন্ধন তৈরি করে। ইতিহাসে সেটা প্রমাণিত।

উপরন্তু শান্তি নিয়ে একটা আত্মতুষ্টি দেখা দিয়েছিল। পরাশক্তিগুলো ইউরোপে ৪০ বছর কোনো যুদ্ধে জড়ায়নি। অবশ্য সংকট যে ছিল না, তা নয়। ১৯০৫-০৬ সালে মরক্কোতে, ১৯০৬ সালে বসনিয়ায়, ১৯১১ সালে আবার মরক্কোতে, ১৯১২-১৩ সালে বলকানে যুদ্ধ বেঁধেছিল। কিন্তু সেসব যুদ্ধ সহজেই থামানো সম্ভব হয়েছিল। যুদ্ধ থামানোর কূটনৈতিক তৎপরতায় একসময় নৈরাশ্য আসে। অনেক নেতা এই ধারণা পোষণ করতে শুরু করেছিলেন, একটা বড় যুদ্ধে যদি শক্তিমান কেউ জিতে যায়, তবে সেই পরিবর্তনকে তাঁরা স্বাগত জানাবেন।

বিশ শতকের প্রথম ভাগে জার্মান নীতির কারণেও বৈশ্বিক বিন্যাসের নমনীয়তা নষ্ট হয়েছিল। জার্মান নীতি উচ্চাকাঙ্ক্ষী হলেও সেটি অনিশ্চয়তা ও দ্বিধায় ভরা ছিল। সম্রাট দ্বিতীয় ভিলহেল্মের পরাশক্তি হওয়ার বাসনা ছিল ভয়ানক আনাড়িপনায় পূর্ণ। প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের ‘চীনের স্বপ্ন’-এর সঙ্গে এর কিছুটা মিল রয়েছে। তিনি দেং জিয়াও পিংয়ের ধৈর্য ধারণের নীতি বাদ দিয়েছেন। জাতীয়তাবাদী ‘নেকড়ে যোদ্ধা’ কূটনীতি গ্রহণ করেছেন।

অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, তাইওয়ান নিয়ে আমেরিকার যে নীতি, তা এখন আর কার্যকর নয়। কেননা, চীনের ক্রমবর্ধমান সামরিক সামর্থ্য দেশটির নেতাদের তাইওয়ানে বলপ্রয়োগে প্রলুব্ধ করছে।

আজকের দিনের নীতিনির্ধারকদের চীনের জাতীয়তাবাদ এবং আমেরিকার জনতুষ্টিবাদী উগ্র স্বদেশবাদের উত্থান সম্পর্কে সজাগ হতে হবে। তাইওয়ানে চীন যে শক্তি প্রয়োগ করে, সেটা প্রতিরোধ করতে চায় আমেরিকা। আবার চীন তাইওয়ানকে পক্ষত্যাগকারী বলে মনে করে। অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, তাইওয়ান নিয়ে আমেরিকার যে নীতি, তা এখন আর কার্যকর নয়। কেননা, চীনের ক্রমবর্ধমান সামরিক সামর্থ্য দেশটির নেতাদের তাইওয়ানে বলপ্রয়োগে প্রলুব্ধ করছে।

তাইওয়ানের প্রতি সরাসরি সমর্থন কিংবা আমেরিকা তাইওয়ানকে সমর্থন দিচ্ছে, এমন কোনো ইঙ্গিত চীনকে প্ররোচিত করার জন্য যথেষ্ট। ধরা যাক, চীন সর্বাত্মক আগ্রাসনের পথে না গিয়ে তাইওয়ানে শুধু জবরদস্তিমূলক নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। কিংবা তাদের জাহাজ বা বিমান থেকে দুর্ঘটনাবশত গোলা গিয়ে সেখানে প্রাণহানি ঘটিয়েছে। এর প্রতিক্রিয়ায় আমেরিকা যদি তাদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে অথবা বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা দেয়, তাহলে দুই দেশের মধ্যকার ‘রূপক যুদ্ধ’ খুব তাড়াতাড়ি বাস্তব যুদ্ধে রূপ নেবে। ১৯১৪ সালের শিক্ষা ‘ঘুমের মধ্যে হাঁটার লক্ষণ’ সম্পর্কে আমাদের সতর্ক করে। কিন্তু সেগুলো তাইওয়ান সংকটের সমাধান নিয়ে কোনো বাস্তব ব্যবস্থাপত্র দেয় না।

ঘুমিয়ে হাঁটার লক্ষণ প্রতিরোধে একটা সফল কৌশল নিতে হবে। আমেরিকায় এ রকম একটা কৌশল চর্চা শুরু হয়েছে। প্রথমত, জবরদস্তিমূলক জোট গড়ার চেয়ে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো রক্ষা করার দিকে আমেরিকা এখন মনোযোগ দিয়েছে। দ্বিতীয়ত, আমেরিকার প্রযুক্তি খাতের বিকাশে সম্পদ বিনিয়োগ করা হচ্ছে। তৃতীয়ত, বাকি বিশ্বের জন্য আমেরিকা একটা খোলা দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করেছে। এর বাইরে প্রযুক্তিগত পরিবর্তনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আমেরিকাকে তার সেনাবাহিনীকে নতুন করে সাজাতে হবে। ন্যাটো এবং জাপান, অস্ট্রেলিয়া ও দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গে জোটগত সম্পর্ক শক্তিশালী করতে হবে। ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক বাড়াতে হবে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আমেরিকা যেমন বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা গড়ে তুলতে সহযোগিতা করেছিল, এখন সেই ভূমিকাই তাদের নিতে হবে। চীনের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বিষয়ে সহযোগিতার সম্পর্ক তাদের গড়ে তুলতে হবে। আমেরিকা চীনকে ধারণ করতে পারবে না। কিন্তু চীনকে সুযোগ করে দেয়, এমন পরিবেশ তারা সীমাবদ্ধ করে দিতে পারে।

ইংরেজি থেকে অনূদিত, স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট

জোসেফ এস নাই হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও ডু মোরালস ম্যাটার বইয়ের লেখক