ঘৃণা, ট্রল ও ভার্চ্যুয়াল গণপিটুনির গপ্পো

ঘৃণা প্রবহমান জিনিস। তার উৎস মানবহৃদয়, গতি নিম্নমুখী। ঘৃণা চেপে রাখলে দম আটকে মরার দশা হয়। উগরানোতেই তার উপশম। ইন্টারনেট আবিষ্কৃত হওয়ার পর ঘৃণা উগরানোর অবারিত পরিসর পাওয়া গেছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম নামক ক্যাঙ্গারু কোর্টে ঘটনার সত্যাসত্য যাচাই ছাড়াই তাৎক্ষণিক বিচার করে রায় দেওয়া এবং এর মাধ্যমে আমাদের অন্তরের অবরুদ্ধ দ্বেষাগ্নি উদ্‌গিরণের মোক্ষম একটা সুযোগ তৈরি হয়েছে।

ঘৃণা ছড়ানো বন্ধ করতে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন থাকলেও কার্যত এই ভার্চ্যুয়াল ময়দানে আলোচনা থেকে সমালোচনা, যুক্তিতর্ক থেকে তর্কাতর্কি, হুঁশিয়ারি থেকে হুমকি-ধমকি—সব চলে। ধরা যাক, আপনি বাজারে গিয়ে দেখলেন, এই ভর মৌসুমে আলুর কেজি ১০০ টাকা। আপনার পকেটে আছে ৭০ টাকা। আপনার বিরাট রাগ হলো। আপনি রাগের চোটে কাঁপতে লাগলেন। দোকানদারকে মনে মনে বললেন, ‘দাঁড়া, তোরে দেখায়ে দিতাছি!’ কিন্তু যখন দেখলেন ‘দেখায়ে দেওয়ার’ মতো কিছু আপনার কাছে নেই, তখন ফট করে পকেট থেকে মোবাইল বের করে চট করে ফেসবুকে লিখে দিলেন, ‘চিন্তা করো নুরু, দেশ আজ কোথায়! পানির দরের আলু, তারও দাম ১০০ টাকা!’

আপনার এই পোস্টে ফটাফট ‘লাইক’ পড়তে লাগল। নানাজন নানা ধরনের মন্তব্য করতে লাগলেন। এর মধ্যে দেখা গেল, বন্ধুতালিকার কেউ আপনার এই স্ট্যাটাসের মধ্যে সরকারের বিরুদ্ধে পাবলিককে খেপিয়ে তোলার উসকানি খুঁজে পেলেন। তিনি মন্তব্যের ঘরে ঢুকে ফটোশপের কারসাজিতে বিরাট বিরাট গোলআলুর সঙ্গে আপনাকে জুড়ে দেওয়া ছবি বসিয়ে আপনার আলুসংক্রান্ত দোষের প্রামাণ্য উপাখ্যান হাজির করলেন। এতে আপনি বা আপনার তৃতীয় কোনো বন্ধু আলুর ছবি দেওয়া বন্ধুর ওপর চটলেন। তর্কাতর্কি শুরু হলো। কিছুক্ষণের মধ্যেই বন্ধুতালিকার সবাই দুই ভাগে ভাগ হয়ে গেলেন। আলুর দোষ ও গুণ নিয়ে শুরু হওয়া তর্ক একপর্যায়ে বাংলাদেশের সঙ্গে পাক-ভারত উপমহাদেশের ঐতিহাসিক সম্পর্কসংক্রান্ত কূটনৈতিক তর্কে গড়াল। সেই তর্ক শেষ পর্যন্ত কে কোন দেশের দালাল, সে-সংক্রান্ত একটি অনিষ্পন্ন কুতর্কে রূপ নিল। শেষে আপনি তাঁকে বা তাঁদের অথবা তাঁরা আপনাকে বা আপনার পক্ষের লোকদের ‘আনফ্রেন্ড’ অথবা ‘ব্লক’ করলেন।

পরিস্থিতি এমন জায়গায় দাঁড়িয়েছে, কেউ ঢ্যাঁড়সের গুণ নিয়ে ফেসবুকে পোস্ট দিলে আপনি পটোলের হয়ে লড়ে যাবেন। কেউ তাঁর জমির পাকা ধানের শিষের ছবি দিলে আপনি বড় একটা মইয়ের ছবি দেবেন। আর ধর্ম বা রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে কোনো পোস্ট দিলে কখন কার সূক্ষ্ম অনুভূতি আঘাতপ্রাপ্ত হবে এবং তার প্রতিক্রিয়া মিছিল-মিটিং বা জনসমাবেশ থেকে কত দূর গড়াবে, তার কোনো ঠিক–ঠিকানা নেই।

ইতিমধ্যেই ‘ট্রল’ নামক একটি প্রপঞ্চের সঙ্গে আমরা পরিচিত হয়ে উঠেছি। কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান কিংবা যেকোনো সত্তাকে ভার্চ্যুয়ালি ‘গণপিটুনি’ দেওয়ার নাম হলো ‘ট্রল’। ট্রলে বহুসংখ্যক লোকের ঘৃণা, অবজ্ঞা, তাচ্ছিল্য, ঠাট্টা, মশকরা, তামাশা, খোঁচা ইত্যাকার অস্ত্রের সম্মিলিত সমরাস্ত্র ব্যবহৃত হয়। ঘরের খেয়ে বনের নিরীহ মোষ তাড়ানোর জন্য বিশাল বিশাল ট্রল বাহিনী চব্বিশ ঘণ্টা তৈরি আছে। বিনা মজুরিতে মতের সঙ্গে বিরুদ্ধমতের ভার্চ্যুয়াল লড়াই চালাচ্ছে এসব বাহিনী।

বিপরীত মতের সঙ্গে আলোচনা সূত্রে আবদ্ধ হওয়া, পারস্পরিক আদান-প্রদানের মাধ্যমে বিপ্রতীপ অবস্থানটিকে বুঝতে চেষ্টা করা এবং নিজের অবস্থানটিকে বোঝানো—এসবই শিক্ষাসাধ্য কাজ। সেই শিক্ষার আলো যেহেতু সমষ্টিগতভাবে আমরা এখনো অর্জন করে উঠতে পারিনি, সেহেতু ভিন্ন মত, ভিন্ন রুচি, ভিন্ন আদর্শের সঙ্গে যে বৈরিতা ছাড়াও সম্পর্ক হতে পারে, তা আমরা জানিও না, মানিও না।

এ কারণে অমুক নারী চিকিৎসক কেন একজন নাপিতকে বিয়ে করলেন, তমুক তরুণী কেন প্রকাশ্যে পার্কে বসে ধূমপান করলেন, অমুক সত্তরোর্ধ্ব ব্যক্তি কেন একজন অষ্টাদশীকে বিয়ে করে হানিমুনের ছবি পোস্ট করলেন, অমুক খেলোয়াড় তমুক জায়গায় গিয়ে কেন অমুকের হাতের খাবার খেলেন—এসবই এখন আমাদের বিশ্লেষণধর্মী ধারাভাষ্যের অতি উপাদেয় অনুষঙ্গ হয়ে উঠেছে। এসব নিয়ে ট্রল করে কাউকে ভার্চ্যুয়ালি গণপিটুনি দেওয়া, যে–কারও চৌদ্দগুষ্টির বস্ত্রহরণ করা, এমনকি হত্যার হুমকি দেওয়াও এখন জলভাত হয়ে দাঁড়িয়েছে।

এই ট্রলের কারণে কতজনের ঘর ভাঙছে, কতজনের দল ভাঙছে, কতজনের মন ভাঙছে, সে হিসাব করার কায়দা ফেসবুক বা টুইটারের অ্যালগরিদমে ঠিক করে দেওয়া নেই।

ভার্চ্যুয়াল প্ল্যাটফর্মে এখন দুনিয়ার তিন ভাগের এক ভাগেরও বেশি মানুষ যুক্ত থাকায় মার্শাল ম্যাকলুহানের চালু করা গ্লোবাল ভিলেজ বা বিশ্বগ্রামের ধারণা বাস্তবতা পেয়ে গেছে। আড়াই শ কোটি মানুষ ইন্টারনেটে যুক্ত থাকায় ভার্চ্যুয়াল জগতে আড়াই শ কোটি পরিপ্রেক্ষণ ভেসে বেড়াচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আমরা এখন আর শুধু তথ্যের উপভোক্তা হয়ে থাকতে রাজি নই। আমরা নিজেরাই কনটেন্ট–স্রষ্টা হয়ে গেছি। একের পর এক তথ্যের ঢেউ আমাদের মস্তিষ্কে আছড়ে পড়ছে। কোটি কোটি তথ্যের চাপে আমরা ইনফরমেশন ওভারলোডেড হয়ে অসুস্থ হয়ে পড়ছি। অসংখ্য তথ্যের সহজলভ্যতায় আমরা স্বশিক্ষিত হয়ে কীভাবে দেশ চলা উচিত আর কীভাবে উচিত না, তা স্থির করার অধিকার নিজেরাই নিয়ে নিয়েছি এবং শীত রাত্রে লেপের নিচে শুয়ে স্মার্টফোনে সেই ব্যক্তিগত ফয়সালা অন্তর্জালে ছড়িয়ে দিচ্ছি।

দেশীয় ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এখন পারসেপশন বা ধারণা সৃষ্টির লড়াই জোরালো হয়ে উঠেছে। একেকজন জননেতা বা একেকটি দলের চরিত্র কেমন, সে বিষয়ে একেকটি সাধারণ ন্যারেটিভ বা ভাষ্য গড়ে তোলার লড়াই চলছে। এই লড়াইয়ে ভাড়াটে দুর্বৃত্তদের পাশাপাশি নেটের উগ্রবাদীদের একটি বড় অংশ স্বেচ্ছাকর্মী হিসেবে কাজ করছে। এক পক্ষ সম্মিলিতভাবে ট্রল করে কিংবা নিস্পৃহ ‘বুদ্ধিজীবীসুলভ’ মিথ্যা ভাষণের মাধ্যমে প্রতিপক্ষকে কদর্য চেহারায় প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করছে। প্রতিপক্ষের ট্রল বাহিনী সেই ন্যারেটিভকে মোকাবিলা করতে একই কায়দায়, একই ভাষায় কাউন্টার ন্যারেটিভ দাঁড় করাচ্ছে।

ট্রলের মধ্যে যেহেতু একই প্যাকেজে সৃজনশীল ব্যঙ্গবিদ্রূপের মজা, অন্যকে ছোট করার স্যাডিস্টিক সুখ ও অন্যকে ধরাশায়ী করার পৈশাচিক আনন্দ—সবকিছু মেলে, সেহেতু এই জিনিসের ডিমান্ড বাড়বেই। এই বস্তু ফট করে আউট অব মার্কেট হচ্ছে না। তাতে কার ঘর ভাঙল, কার মন ভাঙল, কার দল ভাঙল—কী আসে-যায়?

সারফুদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক

ই–মেইল: [email protected]