চট্টগ্রাম চলে জোয়ার-ভাটার ক্যালেন্ডারে

বৃষ্টি আগেও হয়েছে। কিন্তু এত জলাবদ্ধতা হতো না। এখন সামান্য বৃষ্টিতেই রাস্তাঘাট ভেসে যায়। গত শনিবার ২২ জুলাই বিষয়টি নিয়ে চট্টগ্রামে প্রথম আলোর গোলটেবিল বৈঠকে ভুক্তভোগীরা আফসোস করে বললেন, এখন জোয়ার–ভাটার ক্যালেন্ডার দেখে স্কুল-কলেজ চালাতে হয়। কারণ, জোয়ারের সময় শিক্ষার্থীরা স্কুলে আসতে পারে না। আবার বিকেলের দিকে জোয়ার থাকলে আগেই ছুটি দিয়ে দিতে হয়। পরীক্ষার আগে সিলেবাস শেষ করা কঠিন হবে।

খাতুনগঞ্জ ব্যবসায়ী সমিতির নেতারা বললেন, জলাবদ্ধতার জন্য তাঁদের ব্যবসায় মারাত্মক ক্ষতি হচ্ছে। অনেক পণ্য পানিতে তলিয়ে যাচ্ছে।

ঠিকভাবে খাল খনন করা হয় না। কর্ণফুলী নদীর ড্রেজিং ঠিকভাবে হয় না বলে এর তলদেশ উঁচু হয়ে গেছে। ফলে জোয়ারের পানি মহানগরের রাস্তাঘাট, ঘরবাড়িতে ঢুকে পড়ে। খাল দখল চলছে। উদ্ধারের জন্য কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া হয় না। তা ছাড়া আবর্জনা, পলিথিন ব্যাগ, বর্জ্য—সবকিছু নির্বিচারে খাল ও নদীতে ফেলা হয়। খাপছাড়াভাবে নদীর মাঝখানে হয়তো মাইলখানেক অংশ ড্রেজিং করা হয়। দুই দিন পরেই আবার ভরাট। ড্রেজিংয়ের পুরো টাকাটাই আক্ষরিক অর্থে পানিতে যায়।

এককথায় জলাবদ্ধতা দূর করার জন্য অপরিকল্পিতভাবে কাজ চলছে। সুফল পাওয়া যাচ্ছে না।

এবার জলাবদ্ধতা দূর করার জন্য বিশেষ উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। ৫ হাজার ৮০০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। সমন্বিতভাবে কাজ করলে হয়তো জলাবদ্ধতার অভিশাপ থেকে বেরিয়ে আসা যাবে।

যে মহাপরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে, তার সুষ্ঠু বাস্তবায়নের ওপর বিশেষ জোর দিতে হবে। এখানে একটা সমস্যা আছে। বাস্তবায়নের মূল দায়িত্ব কোন সংস্থার? মাথাই যদি নির্দিষ্ট না থাকে, মাথাব্যথাও কারও থাকবে না। কাজও হবে না। বরাদ্দ দেওয়া প্রায় ছয় হাজার কোটি টাকা পানিতে যাবে। আগের মতোই এলোমেলোভাবে কিছু কাজ হবে, কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হবে না।

এখন মূলত সিডিএ (চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ) মহাপরিকল্পনাটি বাস্তবায়নের দায়িত্ব পালন করছে। সবাইকে নিয়ে সুপরিকল্পিতভাবে কাজ করলে বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করা নিশ্চয়ই সম্ভব। আবার সিটি করপোরেশন একটি নির্বাচিত প্রতিষ্ঠান হিসেবে সমন্বিত উদ্যোগ নিতে পারে। এ কথাও আলোচনায় এসেছে। ওয়াসা ড্রেনেজ–ব্যবস্থার একটি মহাপরিকল্পনা করেছে। সিটি করপোরেশন সেটি বাস্তবায়নের দায়িত্ব পালন করবে। মনে রাখতে হবে, জলাবদ্ধতা দূর করার ক্ষেত্রে এই ড্রেনেজ–ব্যবস্থা একটি বড় বিষয়। পানি নিষ্কাশন ঠিকভাবে না হলে জলাবদ্ধতা লেগেই থাকবে।

তাই ড্রেনেজ–ব্যবস্থা, খাল উদ্ধার, নতুন খাল খনন, দখল বন্ধ, নদী ড্রেজিং—এসব কাজ সামগ্রিকতায় দেখার প্রয়োজন খুব বেশি। বিভিন্ন অংশের কাজ যেন সমন্বিতভাবে হয়, সেটা দেখা জরুরি।

গোলটেবিল বৈঠকে এসব বিষয় বিভিন্নভাবে আলোচনায় এসেছে। সবাই বললেন জলাবদ্ধতা দূর করা খুবই সম্ভব।

এ বিষয়ে আমরা অন্তত তিনটি বিষয়ে গুরুত্ব দিতে পারি। প্রথমত, সমন্বয়। দ্বিতীয়ত, পাহাড় কাটা বন্ধ করা। তৃতীয়ত, জলবায়ু পরিবর্তনের সম্ভাব্য প্রতিকূল প্রভাব বিবেচনায় রাখা।

প্রথম বিষয়েই আসা যাক। এর আগে ইউএনডিপি ও ইউএনসিএইচএসের সহায়তায় ১৯৯৫ সালে একটি মহাপরিকল্পনা তৈরি করা হয়। সেখানে মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া দেখভালের জন্য সিপিডিএ (চট্টগ্রাম পরিকল্পনা ও উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ) গঠনের সুপারিশ করা হয়েছিল। এর লোকবল ও কার্যক্রম সম্পর্কে বিস্তৃত বিবরণও সেখানে ছিল। কিন্তু পরে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ে পাঠানোর সময় মহাপরিকল্পনাটির গুরুত্বপূর্ণ অংশ দেখভালের বিষয়ে সুপারিশটি বাদ রাখা হয়। ১৯৯৯ সালে সেই অংশ
বাদ রাখা অবস্থায়ই মহাপরিকল্পনাটি পাস হয়ে যায়। তার মানে পরিকল্পনা বাস্তবায়নের দেখভালের দায়িত্বের বিষয়টি অনির্দিষ্ট থেকে যায়।

কেন সেটা বাদ গেল, তা কেউ বলতে পারেন না। ভালো করে লক্ষ করলে দেখা যাবে, ওই অংশে বলা হয়েছে, ‘পরিকল্পনা ও উন্নয়ন’, শুধু উন্নয়ন নয়। ‘পরিকল্পনা’ কথাটি থাকলে সেই কর্তৃপক্ষের মধ্যে নগরবিদ, পরিকল্পনাবিদদের রাখতে হবে। এটা অনেকে হয়তো চাননি। ফলে সেটা বাদ দিয়েই মহাপরিকল্পনাটি গ্রহণের ব্যবস্থা করানো হয়েছে বলে অনেকে মনে করেন।

এর ফল শুভ হয়নি। উন্নয়ন কার্যক্রম চলেছে, ‘পরিকল্পনা’ নির্বাসনে গেছে।

এখন ১৯৯৫ সালের সেই মহাপরিকল্পনার সঙ্গে গত প্রায় দুই দশকের পরিবর্তনগুলো বিবেচনায় নিয়ে যে মহাপরিকল্পনা করা হয়েছে, তার সফল বাস্তবায়নের জন্য এই দিকটিতে নজর দিতে হবে। স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়নে নগর উন্নয়নবিদদের লাগবে। তাঁদের সহায়তা গ্রহণ করেই কাজ এগিয়ে নিতে হবে। সেটা সিডিএর ভেতরে রেখে হোক বা না রেখে। আর সিটি করপোরেশনের কাজ কী ও কতটুকু হবে, তা-ও সুনির্দিষ্ট করতে হবে।

দ্বিতীয়ত, পাহাড় কাটা ও বন ধ্বংসের বিষয়ে গুরুত্ব দিতে হবে। আমাদের বুঝতে হবে, শুধু যে পাহাড়ধসের বিপদ, তা-ই নয়। পাহাড় কাটলে মূল গাঁথুনি নষ্ট হয়ে মাটি আলগা হয়ে যায়। বৃষ্টিতে সেই মাটি নেমে নালা-নর্দমা ভরাট করে ফেলে। এভাবে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়। তাই পাহাড় কাটা একেবারে বন্ধ করতে হবে।

তৃতীয়ত, জলবায়ু পরিবর্তন। হয়তো এখনই সমুদ্রের পানির উচ্চতা খুব বেশি বাড়েনি। কিন্তু আমাদের দীর্ঘ মেয়াদে চিন্তা করতে হবে। পানির উচ্চতা সামান্য বাড়লেও জোয়ারের পানি শহরে ঢুকবেই। আরেকটি বিষয় মনে রাখতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বৈরী আবহাওয়ার উদ্ভব ঘটবে। এখনই তার কিছু নমুনা দেখা যায়। যেমন বর্ষার আগেই তুমুল বর্ষণ ও বন্যা। আবার কোনো বছর একেবারে শুকনা খটখটা, খরা। অসময়ে নিম্নচাপ, ঘূর্ণিঝড়। ফলে মহাপরিকল্পনায় এই দিকগুলো বিবেচনায় রাখতে হবে।

আমরা বলি চট্টগ্রাম আমাদের বাণিজ্যিক রাজধানী। এখানে জলাবদ্ধতা বছরের পর বছর চলতে পারে না। চট্টগ্রামে অনেক
নগর-পরিকল্পনাবিদ, বিশেষজ্ঞ, প্রকৌশলী ও পরিবেশবিদ আছেন। আছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। নাগরিক সমাজও খুব সচেতন। সর্বোপরি আছে নির্বাচিত সিটি করপোরেশন ও সরকারি সংস্থা সিডিএ। সবার মিলিত চেষ্টায় চট্টগ্রাম নিশ্চয়ই জলাবদ্ধতার অভিশাপ কাটিয়ে উঠবে।

আব্দুল কাইয়ুম: সাংবাদিক।