চাপের নীতি বিপন্ন চীনের হাতিয়ার

করোনা ও আম্পানের যৌথ ঝাপটা সামালের চেষ্টার মধ্যে ভারত ও চীনের সীমান্ত সংঘাত আবারও হুট করে খবরের শিরোনামে। এ দুই দেশের উত্তেজনা মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকেও সচকিত করে তুলেছে। নইলে আগ বাড়িয়ে মধ্যস্থতার প্রস্তাব তিনি রাখতেন না।

উত্তর, পশ্চিম ও পূর্বাঞ্চলীয় প্রতিবেশীদের সঙ্গে ভারতের সীমান্ত বিরোধ জন্মাবধি। প্রতিবেশীদের সঙ্গে পাঁচ–পাঁচটি যুদ্ধও ভারতকে লড়তে হয়েছে দেশভাগের সময় থেকে। নেতৃত্বের বিচক্ষণতার দরুন এক দশক ধরে পূর্বাঞ্চলীয় প্রতিবেশী বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক অবশ্য মধুর। কিন্তু সীমান্ত অশান্তি দিন দিন বেড়ে গেছে পশ্চিম ও উত্তরের প্রতিবেশীদের সঙ্গে। এবার শুধু চীন নয়, প্রায় একই সময়ে সীমান্ত বিবাদ নিয়ে ভারতের বিরুদ্ধে ফোঁস করেছে নেপাল, যে দেশটা ক্রমেই চীনের দিকে ঢলে পড়েছে।

চীনা ফৌজিদের সঙ্গে ভারতীয় জওয়ানদের হাতাহাতি হয় দুই জায়গায়। প্রথমে ৫ মে লাদাখে প্যাংগং লেকের কাছে, ৯ মে সিকিম–তিব্বত সীমান্তের নাকু গিরিপথে দ্বিতীয় দফায়। দুই জায়গাতেই প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা বরাবর ভারতীয় সেনাদের টহলদারিতে আপত্তি জানায় চীন। এই নিয়ে বচসা, হাতাহাতি, ধাক্কাধাক্কি ও পাথর ছোড়াছুড়ি। ভারতীয় সংবাদমাধ্যমে খবর বেরোয়, চীনারা নাকি কয়েকজন ভারতীয় সৈন্যকে সাময়িকভাবে আটকে রেখেছিল, পরে ছেড়ে দিয়েছে। ভারত সরকার অবশ্য জওয়ানদের আটকের খবর অস্বীকার করেছে। সীমান্তে এমন সংঘর্ষ নতুন নয়। তবে এবারের ঘটনা জানাজানি হতেই ভারতের সেনাপ্রধান মনোজ মুকুন্দ নারভানে লাদাখের ফরোয়ার্ড ঘাঁটিতে চলে যান। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিও সর্বোচ্চ পর্যায়ের বৈঠক করেন। ভারত বলে, সেনারা তাদের অবস্থান থেকে সরবে না। অতিরিক্ত বাহিনীও পাঠানো হয়। অন্যদিকে চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং রেড আর্মিকে প্রস্তুত থাকার নির্দেশ দেন।

নেপালের অসন্তোষ প্রকাশও প্রায় ওই সময়ে। তারা একটা নতুন ম্যাপ প্রকাশ করে; যাতে কালাপানি, লিপুলেখ ও লিমপিয়াধুরার ৩৩৫ বর্গকিলোমিটার এলাকা নেপালের অংশ বলে চিহ্নিত। এই তিন অঞ্চলের দাবি জানিয়ে তারা সংসদে একটা প্রস্তাবও আনে। কালাপানি নিয়ে ভারত ও নেপালের দ্বন্দ্ব প্রাচীন। ১৮১৬ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সঙ্গে নেপালের রাজার সুগাউলি চুক্তিতে ঠিক হয়েছিল, মহাকালী নদীর পূর্বাংশ নেপালের, পশ্চিমাংশ ভারতের। পরে এ নিয়ে যাবতীয় বিরোধ দুই দেশ আলোচনার মধ্য দিয়ে মেটানোর চেষ্টা করেছে। এবারের মতো কঠোর মনোভাব নেপাল আগে দেখায়নি। নেপালের এমন প্রতিক্রিয়ার পেছনে চীনা প্ররোচনা রয়েছে কি না, তা নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে।

নেপালের ক্ষোভের অন্য একটা কারণও আছে। কালাপানির যে অংশের দাবিদার ভারত, গুরুত্বপূর্ণ লিপুলেখ গিরিপথের অবস্থান সেখানেই। এই গিরিপথই কৈলাস–মানস সরোবরের যাত্রাপথ। ধর্মপ্রাণ হিন্দুদের জন্য দুর্গম ওই যাত্রাপথ সুগম করতে লিপুলেখ পর্যন্ত ৮০ কিলোমিটার একটা পাকা রাস্তা ভারত তৈরি করেছে। ৮ মে প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং ভিডিও কনফারেন্সিং মারফত সেই রাস্তা উদ্বোধন করেন। রাস্তাটা নেপাল অনুমোদন করছে না। তাদের কাছে এটা নেপালের ‘সার্বভৌমত্বের প্রতি চ্যালেঞ্জ’। এ নিয়ে দেশজুড়ে দেখা দেয় ভারতবিরোধী বিক্ষোভ। উত্তাল হয়ে ওঠে সংসদ। অবশেষে নতুন ম্যাপ প্রকাশ। ভারত বলেছে, করোনা–সংকট কাটলে আলোচনায় বসবে।

চীন ও নেপালের এই যুগপৎ ভারত বিরোধিতার ‘টাইমিং’ ও ‘ডিজাইন’ কি নিতান্তই কাকতালীয়? ভারতকে চাপে রাখতে এটা কি নতুন চীনা কৌশল? নেপালকে কাছে টানাও কি ভারতকে বাড়তি চাপে রাখার জন্য? এই প্রশ্নগুলো আলোচিত হচ্ছে। একটা ব্যাখ্যা, করোনা–পরবর্তী পৃথিবীতে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের চালচিত্র নতুন করে আঁকার যে উদ্যোগ শুরু হয়েছে, তাতে চীন বিচলিত। চীন–যুক্তরাষ্ট্র বাণিজ্য দ্বন্দ্বে জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, ভিয়েতনাম, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড ক্রমেই জড়িয়ে পড়ছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও রাশিয়া অস্বস্তিতে। কিছু বহুজাতিক সংস্থা চীন থেকে কারবার গোটানোর কথা জানিয়েছে। ভারত ‘গ্লোবাল সাপ্লাই চেন’–এর অংশীদার হতে চাইছে। প্রধানমন্ত্রী মোদি ‘স্বনির্ভর ভারত’ গড়ার ডাক দিয়েছেন। ভারতে নতুনভাবে চীনা পণ্য বয়কটের ডাক শোনা যাচ্ছে। করোনার উৎস তদন্ত ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থায় তাইওয়ানকে আবার পর্যবেক্ষকের দায়িত্বে নিয়ে আসতেও ভারত আগ্রহী। দৃশ্যত বিচলিত চীনের এই ভারতবিরোধী আচরণ আদতে এক বার্তা। একধরনের হুঁশিয়ারি। সীমান্ত বিরোধ খুঁচিয়ে তুলে ভারতকে সংযত রাখার কৌশল।

এ লড়াইয়ে নেপালকে দোসর করার অনুমানও অযৌক্তিক নয়। রাজতন্ত্রের অবসান, নতুন সংবিধান রচনা এবং অবরোধের সময় থেকে ভারত–নেপাল সম্পর্ক নিম্নগামী। দুই কমিউনিস্ট পার্টির মিলনের পর চীনের প্রতি নেপালের নির্ভরতা ও আনুগত্য প্রশ্নাতীত। এই মুহূর্তে নেপালের রাজনীতিতেও বইছে চোরা স্রোত। প্রধানমন্ত্রী খড়্গ প্রসাদ শর্মা ওলিকে সামাল দিতে হচ্ছে মাওবাদী নেতা প্রচন্ড ও মাধব নেপালের চ্যালেঞ্জ। কাঠমান্ডুর খবর, প্রধানমন্ত্রী ওলির বিরুদ্ধে তাঁরা হাত মিলিয়েছেন। এই পরিস্থিতিতে প্রধানমন্ত্রী ওলি চীনা সহায়তায় কতটা ভারত বিরোধিতার ধোঁয়ায় ধুনো দিচ্ছেন, আর চীনই–বা কতটা ওলির অসহায়তার সুযোগ নিয়ে ভারতকে চাপে রাখতে চাইছে, চলছে তারই চুলচেরা বিশ্লেষণ।

ডোকলামে ভারত কিল খেয়ে হজম করেছিল। এবার এখনো অনড়। চীনের আপত্তি অগ্রাহ্য করে প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা বরাবর প্রতিরক্ষা অবকাঠামো তৈরির কাজে গতি এনেছে। লাদাখকে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল করার পর আকসাই চীনকে ভারতীয় ভূখণ্ড বলে সংসদে বিবৃতি দিয়েছে। তাইওয়ানের প্রেসিডেন্ট সাই ইং ওয়েনের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে ভিডিও কনফারেন্সিং মারফত উপস্থিত হয়েছেন বিজেপির দুই সাংসদ মীনাক্ষী লেখি ও রাহুল কাসওয়ান। প্রেসিডেন্টকে অভিনন্দন জানিয়ে তাঁরা বার্তা পাঠিয়েছেন। গাত্রদাহ বেড়েই চলেছে চীনের।

মধ্যস্থতাকারী হতে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের বার্তাও ইঙ্গিতবাহী। যুক্তরাষ্ট্রের কাছে ভারতের গুরুত্ব কতটা, ওই বার্তা তা বুঝিয়ে দিয়েছে। সীমান্ত বিরোধের সামাল কূটনৈতিক স্তরেই দিতে হবে। চীন ইতিমধ্যে সুর নরম করেছে। নেপালও। প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা বরাবর দুর্গম অঞ্চল ভারতীয় বাহিনীর কাছে সুগম হয়ে উঠুক, চীন তা চায় না। চায় না করোনা–পরবর্তী সময়ে চীনবিরোধী জোটে ভারত শামিল হোক। চাপের নীতি চীনের হাতিয়ার। অশান্তিও তাই ঘুরেফিরে আসতে থাকবে।

সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়: প্রথম আলোর নয়াদিল্লি প্রতিনিধি