চাল নিয়ে রাজনৈতিক চাল আর কত দিন?

হাওরে ফসলহানির পর চালের দাম দ্রুত বাড়তে থাকে
হাওরে ফসলহানির পর চালের দাম দ্রুত বাড়তে থাকে

বাংলায় সুদিনের উদাহরণ খুঁজতে এখনো শায়েস্তা খাঁর আমলকে সামনে নিয়ে আসা হয়। সে সময় টাকায় আট মণ চাল পাওয়া যেত। আর পাকিস্তানি শাসকদের দুঃশাসন বোঝাতে পূর্ব পাকিস্তানে প্রতি মণ চাল ৫০ টাকা ও পশ্চিম পাকিস্তানে ১৮ টাকায় বিক্রি হওয়ার তথ্য হাজির করা হতো। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে, আর্থসামাজিক অবস্থার অনেক উন্নতি হয়েছে। পাকিস্তান আমলের দেড় শতাংশ প্রবৃদ্ধি বেড়ে এখন প্রায় ৭ শতাংশে উন্নীত করেছে। নিম্নমধ্য আয়ের দেশ থেকে আমরা মধ্য আয়ের দেশের স্বপ্ন দেখছি। কিন্তু চাল নিয়ে ‘রাজনৈতিক চাল’ বন্ধ হয়েছে বলে মনে হয় না।

স্বাধীনতার পর ৮০ ভাগ মানুষের তিন বেলার খাবার ছিল ভাত। এখন তা কমে ৬৫ শতাংশ হয়েছে। গত ৪০ বছরে ধানের উৎপাদন ১ কোটি টন থেকে বেড়ে ৩ কোটি ৪০ লাখ টন ছাড়িয়েছে। কিন্তু চালের রাজনীতি ঠিকই চলছে। ২০০৭-০৮ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে চালের কেজি ৪০ টাকা ছুঁয়েছিল বলে তাদের ‘শরমিন্দা’ হতে হয়েছিল।

২০০৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগ যে ইশতেহার দেয়, তাতে চালের দাম নিয়ন্ত্রণে আনা ও ২০১৩ সালের মধ্যে দেশকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ করার লক্ষ্যমাত্রা দেওয়া হয়েছিল। সেই লক্ষ্যে সরকার দুই দফা সারের দাম কমায়। এতে টানা তিন বছর ধান, আলু, সবজি ও পাটের উৎপাদন বাড়ে। সরকার ঘোষণা করে, দেশ খাদ্য বা চাল উৎপাদনে স্বাবলম্বী।

কিন্তু তার পরও এবারের ঈদে প্রায় এক কোটি গরিব মানুষকে চালের বদলে গম দেওয়া হচ্ছে। বিভিন্ন জেলা থেকে অভিযোগ এসেছে, সেই গমে পোকা পাওয়া যাচ্ছে। সরকারি গুদামে যেখানে ন্যূনতম মজুত ৬ লাখ টন থাকার কথা, সেখানে আছে ১ লাখ ৭৪ হাজার টন।

জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা জুনের দ্বিতীয় সপ্তাহে বিশ্বের খাদ্য উৎপাদনের চিত্র নিয়ে ‘ফুড আউটলুক’ নামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এতে দেখা যায়, শুধু এ বছরই নয়, চালের ঘাটতি সব সময়ই ছিল। ২০১৩ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত দেশে সাত লাখ টন চালের ঘাটতি ছিল, ২০১৬ ও ২০১৭ সালে তা দাঁড়ায় নয় লাখ টন। ওই সময়ে চালের উৎপাদন ও ভোগের পরিমাণের ফারাক থেকে এ তথ্য পাওয়া গেছে।

উৎপাদন বেড়ে যাওয়ায় ২০১২ সালে চালের দাম প্রতি কেজি ৩০ টাকার নিচে নামে। তখন খাদ্য মন্ত্রণালয় থেকে বলা হলো, দেশে ২০ থেকে ৩০ লাখ টন চাল উদ্বৃত্ত রয়েছে। চালের উৎপাদন ও ভোগের বস্তুনিষ্ঠ হিসাব বের করতে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের অর্থায়নে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস) ২০১৩ সালের জানুয়ারিতে একটি গবেষণা করে। ‘সমন্বিত ও কার্যকর খাদ্য বিতরণব্যবস্থার জন্য সূচক নির্ধারণ’ শীর্ষক ওই গবেষণায় বলা হয়, দেশে রপ্তানি করার মতো উদ্বৃত্ত চাল নেই। কিন্তু খাদ্য মন্ত্রণালয় ওই গবেষণার বরাত দিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়কে জানায়, দেশে ২৩ লাখ টন চাল উদ্বৃত্ত রয়েছে। কৃষককে ন্যায্য মূল্যে দিতে চাল রপ্তানি করতে হবে। ২০১৩-এর মে মাসে চাল রপ্তানির সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য খাদ্য মন্ত্রণালয়, কৃষি মন্ত্রণালয় ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে বৈঠক হওয়ার কথা থাকলেও তা হয়নি।

দেশে রপ্তানি করার মতো চাল নেই—এমন হিসাব থাকা সত্ত্বেও ২০১৪ সালের জুনে খাদ্য মন্ত্রণালয় আবারও চাল
রপ্তানির তোড়জোড় শুরু করে। ওই বছরের ডিসেম্বরে শ্রীলঙ্কায় ৫০ হাজার টন চাল রপ্তানি করা হয়। দেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ, তা প্রমাণ করতেই এই রপ্তানি। কিন্তু সেই রপ্তানির সময়ও প্রতি মাসে গড়ে এক থেকে দেড় লাখ টন করে চাল আমদানি হচ্ছিল। ২০১৪ ও ২০১৫ সালে প্রায় ৩০ লাখ টন চাল আমদানি হয়।

একদিকে আমদানি ও অন্যদিকে রপ্তানি—এই তালগোল পরিস্থিতিতে ২০১৪ সাল থেকেই দেশে চালের দাম কমতে থাকে। ২০০৯-এর শুরুতে বাজারে মোটা চালের কেজি ছিল ৩৫ থেকে ৪০ টাকা। ২০১০ সালে তা ৩০ টাকার নিচে নেমে আসে। ২০১১, ২০১২, ২০১৩ ও ২০১৪ সাল পর্যন্ত চালের দাম ২৫ থেকে ৩০ টাকার মধ্যে ওঠানামা করে।

কৃষক ফসলের ন্যায্য মূল্য না পেলেও কৃষিমজুরি ২০০ টাকা থেকে বেড়ে ৩০০ থেকে ৩৫০ টাকা হয়, যা এখন ৪০০ টাকার অঙ্ক ছাড়িয়েছে। সামগ্রিকভাবে কৃষি উৎপাদনে খরচ ২০ থেকে ৩০ শতাংশ বেড়ে যায়। ২০১৫ সালে সেটি ৩০ থেকে ৪০ শতাংশে উন্নীত হয়। আর ধান-চালের দাম ৩০ শতাংশ কমে যায়। ফলে ছোট ও মাঝারি কৃষকেরা লোকসান গুনতে থাকেন। অনেকেই ধান চাষ থেকে সরে আসেন।

২০১৬ সালের মে মাসে কৃষি মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন সংস্থা বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি) ১১টি জেলার বোরো ধানের আবাদ নিয়ে একটি জরিপ করে। তাতে দেখা যায়, ২০১৪-১৫ অর্থবছর থেকে ২০১৫-১৬ অর্থবছরের মধ্যে, অর্থাৎ এক বছরে বোরো ধানের উৎপাদন সাত লাখ টন কমে গেছে। উৎপাদন কমে যাওয়ার কারণ প্রতি কেজি চালে দুই থেকে তিন টাকা লোকসান। ফলে কৃষকেরা বোরো ধানের চাষ কমিয়ে দিচ্ছেন।

২০১৬-এর মে মাসে খাদ্য মন্ত্রণালয় খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির আওতায় স্বল্প আয়ের মানুষকে ১০ টাকা কেজিতে চাল খাওয়ানোর ঘোষণা দেয়। তারা পাঁচ মাস ধরে ৫০ লাখ পরিবারকে মাসে ৩০ কেজি করে চাল সরবরাহ করে। এতে মাসে দেড় লাখ টন করে চাল প্রয়োজন হয়। এই প্রেক্ষাপটে গত বছরের শেষের দিকে চালের দাম বাড়তে থাকে। এ বছরের শুরু থেকে চালের দাম ৪০ টাকা অতিক্রম করে। মার্চের শেষে গিয়ে হাওরে বাঁধ ভেঙে ফসলডুবির পর চালের দাম দ্রুত বাড়তে থাকে।

কৃষি মন্ত্রণালয় থেকে বলা হয়, হাওরে সর্বসাকল্যে আট লাখ টন ধান নষ্ট হয়েছে। ১৬ জুন খাদ্যমন্ত্রী বিবিসিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে ২০ লাখ টন ধানের ক্ষতি হয়েছে বলে জানান। কিন্তু কৃষি মন্ত্রণালয় থেকে বলা হয়, হাওরে ফসলের ক্ষতি হলেও বোরোতে মোট উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হবে। খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতার কথা কৃষি মন্ত্রণালয় ও খাদ্য মন্ত্রণালয় থেকে বলা হলেও সরকার ভিয়েতনাম থেকে বছরে ১০ লাখ টন চাল আমদানির চুক্তি করেছে। থাইল্যান্ড ও ভারত থেকে আরও সাত লাখ টন চাল আমদানির উদ্যোগ নিতে ওই দুই দেশে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাসকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। সরকার বেসরকারি খাতে আমদানি বাড়াতে আমদানি শুল্ক কমানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

তাহলে প্রশ্ন উঠতে পারে, যদি চাল উৎপাদনে দেশ স্বয়ংসম্পূর্ণই হয়ে থাকে, তাহলে বিপুল পরিমাণে চাল আমদানি কেন? চাল উৎপাদনের মোট হিসাব ও দুর্যোগে ধানের ক্ষতির প্রকৃত হিসাব আড়াল করা হয়েছে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। সরকারি খাতে ১৭ লাখ টন চাল আমদানির উদ্যোগের পরও বেসরকারি খাতে আমদানির তোড়জোড় প্রমাণ করে দেশে চালের যথেষ্ট ঘাটতি রয়েছে।

এখন চালের দাম যখন কেজিপ্রতি ৫৬ থেকে ৫৮ টাকা, তখন কৃষি মন্ত্রণালয় ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ড থেকে বলা হয়, ধান-চালের দাম বাড়ায় কৃষক ভালো দাম পাচ্ছেন। কিন্তু আসলেই কৃষক কতটুকু দাম পাচ্ছেন, সে বিষয়ে সরকারের কাছ থেকে কিছু জানানো হয়নি। তবে একটি হিসাব পাওয়া গেল এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক ও ইন্টারন্যাশনাল ফুড পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (ইফপ্রি) ‘প্রধান খাদ্য উৎপাদনে নীরব বিপ্লব’ শীর্ষক গবেষণায়। এতে দেখা যায়, বাংলাদেশে ৬৭ শতাংশ ধানের বাজার ও দাম নিয়ন্ত্রণ করেন বড় পাইকারি ব্যবসায়ী ও চালকলের মালিকেরা। মাত্র ৩০ শতাংশ চাল কৃষক বাজারমূল্যে বিক্রি করতে পারেন। ফলে ধানের দাম বাড়লে মূলত লাভ হয় ধনী ব্যবসায়ী ও চালকলের মালিকদের।

প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক, দেশের মানুষের আয় দ্বিগুণ হওয়া সত্ত্বেও কেন চাল নিয়ে রাজনৈতিক চাল বন্ধ হচ্ছে না?  উল্লেখ্য, ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমলে ‘গোলা ভরা ধান আর পুকুর ভরা মাছ’-এর এই দেশে ১৭৭০ ও ১৯৪৩ সালে দুর্ভিক্ষ হয়েছিল। আন্তর্জাতিক খাদ্য রাজনীতির শিকার হয়ে ১৯৭৪ সালেও আরেকবার বাংলাদেশ দুর্ভিক্ষের কবলে পড়ে।

চালের এই রাজনৈতিক চালে পড়ে সবচেয়ে বেশি কষ্টে আছে দেশের দুই কোটি হতদরিদ্র মানুষ, যাদের দৈনিক আয় ১০০ টাকার কম। এই বিপুলসংখ্যক জনগোষ্ঠীকে সুলভে খাদ্য সরবরাহ করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। বাজেটের অনুন্নত খাতের সবচেয়ে বেশি বরাদ্দ তাদের জন্যই থাকা উচিত।

গরিব মানুষের কাছে সস্তায় চাল পৌঁছানো, খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত রাখতে গুদামে চাল সংরক্ষণের দায়িত্ব খাদ্য মন্ত্রণালয়ের। কিন্তু তাদের গুদামে রাখা চাল এখন ১৫ বছরের মধ্যে সর্বনিম্নে। মজুত মাত্র ১ লাখ ৮১ হাজার টন। ৯ লাখ টন খাদ্য সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে মাঠে নেমে তারা দেড় মাসে মাত্র ৩৮ হাজার টন চাল সংগ্রহ করতে পেরেছে। এই সুযোগে ব্যবসায়ীরা অতিমুনাফার সুযোগ নিচ্ছেন। সরকারি গুদামে চাল না দিয়ে তাঁরা মজুত করছেন। আবার আন্তর্জাতিক বাজার থেকে কম দামে চাল এনে তাঁদের আরেক দফা মুনাফা করার সুযোগ করে দেওয়া হলো কি না, সেই প্রশ্নও উঠেছে।

২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ যখন ক্ষমতায় আসে, তখন দেশে মাথাপিছু আয় ছিল ৮৪৩ ডলার। ২০১৭ সালের মার্চের হিসাবে তা বেড়ে ১ হাজার ৬০২ ডলার হয়েছে। আর রাজনৈতিক চালবাজির মধ্যে এখন চালের দাম ৬০-এর ঘরে।

এ অবস্থায় খাদ্য মন্ত্রণালয় সরকারি গুদামে মজুত না বাড়িয়ে বেসরকারি খাতের ওপর সওয়ার হয়ে চালের দাম কমানোর চেষ্টা করছে। এটি সফল হবে কি?

ইফতেখার মাহমুদ: সাংবাদিক।