চালের দাম কীভাবে কমানো সম্ভব

প্রতীকী ছবি।

খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার বলেছেন, চাল নিয়ে কোনো ধরনের কারসাজি সরকার বরদাশত করবে না। সংবাদপত্রের প্রতিবেদনে জানা যায়, গত ২৯ সেপ্টেম্বর খাদ্য ভবনে অনুষ্ঠিত দেশের চালকলমালিক, পাইকারি ও খুচরা চাল ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলোচনা বৈঠকে নাকি তিনিই আবার আক্ষেপ করে বলেছেন, একশ্রেণির অসাধু চালকলমালিক অবৈধভাবে ধান ও চাল মজুত করে রাখায় চালের বাজার অস্থিতিশীল হয়েছে। তিনি নাকি ‘গোপন সার্ভে’ করে প্রায় ৫০টি মিলের খোঁজ পেয়েছেন। এসব মিলে কমপক্ষে ২০০ মেট্রিক টন থেকে সর্বোচ্চ ৩ হাজার মেট্রিক টন ধান মজুত আছে। এমনকি ৫০০ মেট্রিক টন চালও মজুত আছে। মন্ত্রী বলেন, ‘আমার নিজের নির্বাচনী এলাকা নওগাঁয় হাজার হাজার মেট্রিক টন ধান মজুত রয়েছে। দেশে কৃষকদের কাছে ২ শতাংশও ধান নাই। আড়তদাররাও ধান ও চাল মজুত করে রাখছে।’

খাদ্যমন্ত্রীর অভিযোগ, মিলমালিকেরা সব জেনেও সরকারকে তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করছেন না। এত কিছু জানার পরেও তিনি তাঁদের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। বৈঠকে আলোচনা শেষে প্রতি কেজি উৎকৃষ্ট মানের মিনিকেট চাল ৫১ টাকা ৫০ পয়সা দরে ৫০ কেজির বস্তা ২ হাজার ৫৭৫ টাকা এবং মাঝারি মানের প্রতি কেজি মিনিকেট চাল ৪৫ টাকা দরে ৫০ কেজির বস্তা ২ হাজার ২৫০ টাকা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়। কিন্তু সাংবাদিকেরা বাজার ও মোকাম ঘুরে দেখেছেন, খাদ্যমন্ত্রীর কড়া হুঁশিয়ারির পরেও বাজারে এর কোনো প্রভাব পড়েনি।

দর নির্ধারণ করে দেওয়ার পরেও কেন চালের বাজারে অস্থিরতা কমছে না—এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে খাদ্যসচিব সংবাদমাধ্যমকে বলেন, ‘আমরা আমাদের কাজ করেছি। মিলগেটে দর নির্ধারণ করে দেওয়ার এখতিয়ার খাদ্য মন্ত্রণালয়ের। খাদ্য মন্ত্রণালয় তা করেছে। কিন্তু খুচরা বাজারে এর প্রভাব পেতে হলে পাইকারি ও খুচরা বাজারেও দর ঠিক করে দিতে হবে। কিন্তু সেই ক্ষমতা তো খাদ্য মন্ত্রণালয়ের নেই। তা করবে কৃষি বিপণন অধিদপ্তর, এটা কৃষি মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ সংস্থা। তারপরেও ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর যেন চালের বাজারে অভিযান পরিচালনা করে, সে জন্য আমাদের মন্ত্রণালয় থেকে অনুরোধ জানিয়ে লেখা চিঠি আমি নিজে বাণিজ্যসচিবের হাতে পৌঁছে দিয়েছি।’

মন্ত্রীর উপস্থিতিতে উচ্চপর্যায়ের সভা করার অর্থ হচ্ছে, নিজ নিজ করণীয় ঠিক করে একসঙ্গে তাল রেখে কাজ করা। মানুষ যে মিলগেট থেকে চাল কেনে না, সেটা জানার জন্য কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র পড়া বা অমর্ত্য সেনের ছাত্র হওয়ার দরকার নেই। মিলগেট থেকে চাল নেবেন আড়তদার ও পাইকারেরা; তাঁদের কাছ থেকে নেবেন খুচরা বিক্রেতারা। আমজনতা নেবেন খুচরা বিক্রেতার কাছ থেকে। আমজনতাকে মিলগেটের হাইকোর্ট দেখালে চলবে কীভাবে? এই চালবাজি চলেনি। চালের দাম কমেনি।

চালের দাম বাড়ার জন্য মিলমালিক ও আড়তদারেরা একে অপরের ওপর দায় চাপাচ্ছেন। মিল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক বলেছেন, তাঁরা সরকারনির্ধারিত দরে চাল বিক্রির জন্য প্রস্তুত, কিন্তু আড়তদারেরা এই চাল কিনছেন না। ২৯ সেপ্টেম্বর সমঝোতার পর আড়তদারেরা সরকারনির্ধারিত দরে চাল কেনার জন্য কোনো অর্ডার করেননি। মিলাররা মনে করেন, বেঁধে দেওয়া দামে কিনলে কম দামে বেচতে হবে বলে তাঁরা কিনছেন না। বেশি মুনাফার আশায় তাঁরা যে শত শত টন চাল মজুত করেছেন, সেই চালই বিক্রি করছেন। তাঁদের এই ধারণার সঙ্গে মন্ত্রীর কথা মিলে যায়। কে জানে কার কী ব্যবসা আছে, আর কে কার সঙ্গে মিলে মিলের বাইরে আর বাজারের ভেতরে কী খেলা খেলছে। প্রাণ যাচ্ছে চাল কিনে খাওয়া মানুষদের।

চালের বাজারে স্থিতিশীলতা আনতে পাইকারি ও খুচরা বাজারে দর নির্ধারণ করে দেবেন কি না জানতে চাইলে কৃষিসচিব মো. নাসিরুজ্জামান সংবাদমাধ্যমকে বলেছিলেন, ‘আমরা আলাপ–আলোচনা শুরু করেছি। বিষয়টি নিয়ে কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের সঙ্গে কথা বলেছি। আশা করছি আগামী রবিবার বা সোমবারের (৪/৫ অক্টোবর) মধ্যে এটি আমরা চূড়ান্ত করতে পারব।’ নির্ধারিত দরে পাইকারি ও খুচরা বাজারে চাল বিক্রি না করলে অভিযুক্ত ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলেও জানিয়েছেন তিনি।

বোরো ধান ওঠার পর সাধারণত চালের দাম কমে যায়। কিন্তু এবার উল্টো বেড়েছে এবং বাড়ছে।

দাম কমানোর উপায় কী

খাদ্যমন্ত্রী যখন বলছেন, তিনি জানেন ধান–চাল মুনাফাখোরদের গুদামে গুদামে পড়ে আছে, তখন সেটা মিথ্যা নয়। এখন গুদাম থেকে চাল বের করার উপায় খুঁজতে হবে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে দিয়ে মালিকদের ভয় দেখিয়ে কাজ হবে না। বিবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে অর্থনীতিবিদ ড. নাজনীন আহমেদ বলেছেন, তাঁরা একটি গবেষণায় দেখেছেন, দেশে শত শত চালকলের মধ্যে প্রায় ৫০টি বাজারকে প্রভাবিত করে থাকে। তাদের মজুত করে রাখার ক্ষমতা অপরিসীম। এটা তারা বৈধভাবেই করতে পারে।

বাজার থেকে ধান কেনা, ধান থেকে চাল করে তা গুদামে রাখা কিংবা রেয়াতি শুল্কে চাল আমদানি করা—সবই ব্যবসা। ব্যবসা চলে ব্যাংকের টাকায়। ব্যাংক টাকা পায় সাধারণ মানুষের কাছ থেকে। তাদের কষ্টেসৃষ্টে জমানো টাকাই ব্যাংকের টাকা। মানুষ যে টাকার নিরাপত্তার জন্য ব্যাংকে রাখে, ব্যাংক সেই টাকা তুলে দেয় আড়তদার আর মিলারদের হাতে। সেই টাকাতেই তাঁদের রমরমা মজুতদারি ব্যবসা চলে। ঋণ হিসাবে ছাড়া এসব টাকা ব্যাংক ফেরত চাওয়ার অধিকার রাখে। হাত দিতে হবে সেখানে। এ জেড এম ওবায়দুল্লাহ খান কৃষি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকার সময় একবার চালের দাম অস্বাভাবিক রকম বাড়তে থাকলে ঋণ ফেরত আর নতুন ঋণ না দেওয়ার কৌশল নিতে সরকারকে পরামর্শ দিয়েছিলেন। সরকার সে পরামর্শ গ্রহণ করে সুফল পেয়েছিল।

৫০ জন চালকলমালিক আর শ পাঁচেক আড়তদারের কাছে চালের বাজার জিম্মি হয়ে থাকবে, এটা চলতে পারে না। চালের দাম কমানোর আলোচনায় ব্যাংক বিভাগ আর বাংলাদেশ ব্যাংককে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।

গওহার নঈম ওয়ারা: লেখক ও গবেষক

[email protected]