চিকিৎসক কি রোগীর প্রতিপক্ষ?

ধর্মঘটের কারণে চিকিৎসা না পেয়ে ফিরে যাচ্ছে শিশুটি
ধর্মঘটের কারণে চিকিৎসা না পেয়ে ফিরে যাচ্ছে শিশুটি

জনপ্রিয় লেখক হুমায়ূন আহমেদ একবার ঠাট্টা করে বলেছিলেন, তিনি সবচেয়ে অপছন্দ করেন ডাক্তারদের। কেন? তাঁর সরস জবাব, ‘শরীরটা আমার, অথচ এই শরীর সম্পর্কে আমার চেয়ে তিনি বেশি জানেন, এটা মেনে নিতে কষ্ট হয়’ (হুবহু উদ্ধৃতি নয়)। কথাটা হ্ুমায়ূনের স্বভাবসুলভ রসিকতাচ্ছলেই বলা। তবে এ কথার মধ্যে কোথায় যেন রোগীর আসল অবস্থার একটা পরিচয়ও পাওয়া যায়। চিকিৎসকের কক্ষে প্রবেশ করার সময় যেকোনো রোগীর চেহারায় যে একটা অসহায়ত্ব ফুটে ওঠে, এ কথা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। তখন তাঁর সামনে ত্রাতার ভূমিকায় থাকেন চিকিৎসক। তাঁর চেহারার দিকে তাকিয়ে যেন নিজের ভাগ্য বুঝতে চেষ্টা করেন রোগী। সেই চেহারায় আশ্বাস বা অভয় পেলে প্রায় শিশুর সারল্যে হাসেন যন্ত্রণাকাতর রোগীও। এই হচ্ছে চিকিৎসক-রোগীর সম্পর্ক। কিন্তু এই চিকিৎসক যদি কোনো কারণে প্রতিপক্ষ হয়ে ওঠেন, রোগীর জীবনের জন্য এর চেয়ে বড় শঙ্কার কারণ আর কিছুই হতে পারে না।
চট্টগ্রামের চিকিৎসকেরা ২০ থেকে ২৪ জানুয়ারি পাঁচ দিন কর্মবিরতি বা ধর্মঘট পালন করেছেন সাধারণ রোগীদের বিরুদ্ধে। ধর্মঘট রোগীদের বিরুদ্ধে বলছি এ কারণে যে সরকারি কোনো সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে বা অন্য কোনো দাবিদাওয়ার জন্য নয়, একজন রোগীর মৃত্যুর কারণটি ‘অপচিকিৎসা’ দাবি করে তাঁর আত্মীয়স্বজন সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকের বিরুদ্ধে মামলা করলে এই কর্মবিরতির বা ধর্মঘটের ডাক দিয়েছিলেন বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) চট্টগ্রাম শাখার নেতারা। স্বাস্থ্যমন্ত্রীর উদ্বেগ, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র ও সাংবাদিক নেতাদের মধ্যস্থতায় পঞ্চম দিনে এসে শর্ত সাপেক্ষে চিকিৎসকেরা কর্মবিরতি প্রত্যাহার করে নিলে আপাতত স্বস্তি এসেছে নগরবাসীর জীবনে।
সরকারি হাসপাতালগুলো অবশ্য ধর্মঘট ও কর্মবিরতির আওতামুক্ত ছিল। স্বাভাবিকভাবেই এসব হাসপাতালে রোগীদের চাপ সামাল দিতে হিমশিম খেতে হয়েছে চিকিৎসক ও ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষকে। বেসরকারি হাসপাতাল ও চিকিৎসকদের ব্যক্তিগত চেম্বারে যাঁরা চিকিৎসা না পেয়ে ফিরে গেছেন, তাঁদের দুর্ভোগের কিছু সচিত্র বিবরণ পত্রপত্রিকায় এসেছে বটে, কিন্তু প্রকৃত ক্ষতির নির্ভুল কোনো পরিসংখ্যান আমাদের হাতে নেই। বিএমএর সমাবেশে একজন চিকিৎসক নেতা স্বীকার করেছেন, এই অঞ্চলে ৬০ শতাংশ রোগী বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও চিকিৎসকের ওপর নির্ভরশীল। যদি তাঁর পরিসংখ্যানকে সঠিক ধরে নিই, তাহলে এই বিরাট অঙ্কের মানুষের রোগযন্ত্রণা ও চিকিৎসাবঞ্চনার খোঁজ কতটুকুইবা জানা সম্ভব আমাদের পক্ষে?
সেদিন চিকিৎসকের অবহেলা বা ভুল চিকিৎসায় প্রসূতি মেহেরুন্নেছার মৃত্যু হয়েছে বলে দাবি করে ক্ষুব্ধ ও উত্তেজিত আত্মীয়স্বজন স্থানীয় একটি ক্লিনিকে ভাঙচুর চালান। এটা কিছুতেই সমর্থনযোগ্য নয়। আদৌ অবহেলা বা ভুল চিকিৎসা হয়েছে কি না, তা হাসপাতালের বাইরে অপেক্ষমাণ আত্মীয়স্বজন বুঝে না-বুঝে হাসপাতাল বা ক্লিনিকে ভাঙচুর চালাতে শুরু করবেন, এটা খুবই খারাপ দৃষ্টান্ত। কিন্তু সত্যিই যদি কারও মনে হয় যে তাঁর নিকটজনটি অবহেলা বা ভুল চিকিৎসার শিকার, তাহলে প্রতিকার চাওয়ার অধিকার কি তাঁর নেই?
নিহত মেহেরুন্নেছার বাবা খায়রুল বশর তাঁর মেয়ের চিকিৎসায় অবহেলার অভিযোগ এনে মামলা করেন দুজন চিকিৎসকের বিরুদ্ধে। প্রায় একই সময়ে হার্নিয়ার অপারেশনের পরে রোগীর পেটে গজ-ব্যান্ডেজ রেখে দেওয়ার অভিযোগে আরও একটি মামলা হয় অন্য এক চিকিৎসকের বিরুদ্ধে। এতে খেপে গেছেন চিকিৎসকেরা। তাঁরা প্রাইভেট চিকিৎসা ও চেম্বার বন্ধ রাখার ঘোষণা দিয়ে বসেন। আশ্চর্য, মেয়ে সুচিকিৎসা থেকে বঞ্চিত হয়েছেন মনে করলে একজন শোকার্ত বাবা আদালতের দ্বারস্থও হতে পারবেন না? এক সংবাদ সম্মেলনে বিএমএ চট্টগ্রাম শাখার নেতারা দাবি করেন, চিকিৎসায় অবহেলা বা ভুল চিকিৎসার অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে মামলা, গ্রেপ্তার বা কাউকে হয়রানি করা যাবে না।
প্রশ্ন উঠছে, চিকিৎসায় ভুল বা অবহেলা ছিল কি না—এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত দেওয়ার অধিকার কার? মেহেরুন্নেছার বাবা মনে করেছেন আদালতে ফয়সালা হবে। তাই তিনি আদালতের দ্বারস্থ হয়েছেন। চিকিৎসকেরা মনে করছেন, চিকিৎসাবিজ্ঞান বিষয়ে যথেষ্ট ধারণা না থাকলে তাঁর এ বিষয়ে মত বা রায় দেওয়ার এখতিয়ার নেই। বিএমএ বলছে, ‘কোনো চিকিৎসকের বিরুদ্ধে এ ধরনের অভিযোগ উঠলে আগে চিকিৎসকদের সমন্বয়ে গঠিত বিশেষজ্ঞ কমিটি বিষয়টির তদন্ত করবে। তদন্তে অভিযোগের সত্যতা মিললে সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া যাবে।’ এ-সংক্রান্ত আইন করতেও সরকারের কাছে দাবি জানান তাঁরা। উত্তম প্রস্তাব। কিন্তু চিকিৎসকের বিরুদ্ধে অভিযোগ তদন্তের দায়িত্ব যদি অন্য চিকিৎসক পালন করেন, সে ক্ষেত্রে অভিযোগকারী কতটা আশ্বস্ত হতে পারবেন?
প্রসঙ্গক্রমে সাম্প্রতিক কালের একটি উদাহরণ দিতে চাই। ওয়াহেদা নামের পাঁচ বছর বয়সী এক মেয়ে একটি চলন্ত পিকআপের ধাক্কায় পায়ে মারাত্মক আঘাত নিয়ে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে এসেছিল গত ২৪ আগস্ট। ওই দিনই অর্থোপেডিক বিভাগে মেয়েটির বাঁ পা কেটে ফেলতে হয়। রোগীর ফাইলেও লেখা ছিল, ‘বাঁ পায়ে গুরুতর আঘাত রয়েছে’।
কিন্তু বিস্ময়কর তথ্য হলো, কিছুদিন পর বাঁ পায়ে মারাত্মক আঘাত পাওয়া শিশুটির বাঁ হাতটিও কেটে ফেলতে হয়েছে! ওয়াহেদার বাবা মোজাহের আহমদ বলেছেন, তাঁর মেয়ের পা ও পেট ছাড়া আর কোথাও আঘাতের চিহ্ন ছিল না। বাঁ হাতে আঘাত থাকলে সেটির এক্স-রে করা হতো। কিন্তু পা ছাড়া আর কিছুর এক্স-রে করা হয়নি। নাম-পরিচয় উল্লেখ করতে ইচ্ছুক নন, এমন কয়েকজন চিকিৎসকের সঙ্গে আলাপ করে মোজাহের বুঝতে পেরেছেন, পায়ের অপারেশনের পর চিকিৎসকেরা বাঁ হাতে ক্যানোলা দিয়েছিলেন। কিন্তু ক্যানোলাটি শিরায় না ঢুকে ভুলে মাংসে চলে যায়। এর ফলে ইনজেকশন দিলে হাতটি ফুলে যায়। পরে হাতে অস্ত্রোপচার করে ইনজেকশনের পানি বের করার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু হাতটি ধীরে ধীরে কালো হয়ে যেতে থাকে। পরে বাধ্য হয়ে হাতটি কেটে বাদ দিতে হয়। পায়ের চিকিৎসার জন্য এসে দরিদ্র মোজাহের ও মরিয়ম দম্পতির ছোট্ট মেয়েটি তার হাতও হারাল। এ ঘটনায় চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালকের কাছে লিখিত অভিযোগ জানিয়েছিলেন মোজাহের। বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশনের পক্ষ থেকেও এ ঘটনার উচ্চপর্যায়ের তদন্তের নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। জ্যেষ্ঠ চিকিৎসকদের সমন্বয়ে তদন্ত কমিটি গঠন করেছিলেন হাসপাতালের পরিচালক। কিন্তু তদন্ত কমিটি যথারীতি অভিযোগের ‘সত্যতা’ পায়নি।
সবিনয়ে বলি, চিকিৎসকদের দিয়ে চিকিৎসার ত্রুটি বা গাফিলতির তদন্ত করানো হলে আর যা-ই হোক, ভুক্তভোগীর কাছে তা বিশ্বাসযোগ্য হবে বলে মনে করি না। এযাবৎ সে রকম কোনো উদাহরণ সৃষ্টি হয়নি। এ ব্যাপারে জনস্বাস্থ্য অধিকার রক্ষা পরিষদের আহ্বায়ক মাহফুজুর রহমানের বক্তব্যটি বরং তুলনামূলক গ্রহণযোগ্য বলে মনে হয়। প্রবীণ এই চিকিৎসক বলছেন, বিএমডিসির তত্ত্বাবধানে একটি কমিটি গঠন করা যায়, যেখানে চিকিৎসক, আইনজীবী ও প্রশাসনের কর্মকর্তারাও থাকবেন। কোনো চিকিৎসকের বিরুদ্ধে চিকিৎসায় অবহেলার অভিযোগ এলে ওই কমিটি তদন্ত করে প্রথমে প্রতিবেদন দেবে। এর ভিত্তিতেই মামলা বা পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে।
আমরা চাই না চিকিৎসকেরা ভুল–বোঝাবুঝির শিকার হয়ে সাধারণ রোগীদের কাছে অপদস্থ হোন। কিন্তু সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি আদালতের আশ্রয় নিতে পারবেন না, এমন নজির বিশ্বের কোনো সভ্য সমাজে আছে বলে আমাদের জানা নেই। এমনকি ইউরোপ-আমেরিকায় চিকিৎসকেরা তটস্থ থাকেন কখন রোগী তাঁদের বিরুদ্ধে অপচিকিৎসার দায়ে মামলা বা ক্ষতিপূরণ দাবি করে বসেন। সাম্প্রতিক ঘটনায় তিন চিকিৎসকের জামিন আবেদন মঞ্জুর করে আদালত বলেছেন, ‘রোগীদের জিম্মি করার অধিকার চিকিৎসকদের সংগঠন সংরক্ষণ করে না। চিকিৎসকেরা অপরাধ করলে তাঁদের বিরুদ্ধে মামলা করা যাবে না—এটি গোষ্ঠীগত দাম্ভিকতা। গোষ্ঠীগত স্বার্থে অপরাধীকে আড়াল করা যাবে না।’ মামলার সুষ্ঠু তদন্তে বিঘ্ন সৃষ্টি হয় এমন কোনো ধরনের অনৈতিক প্রভাব বিস্তার কিংবা চাপ প্রয়োগ থেকে বিরত থাকতে চিকিৎসকদের সংগঠন বিএমএর চট্টগ্রাম শাখাকে সতর্ক করেন আদালত।
চট্টগ্রামের বিভিন্ন ডায়াগনস্টিক ও প্যাথলজিক্যাল সেন্টারে অভিযান চালিয়ে সম্প্রতি ভ্রাম্যমাণ আদালত বহু অনিয়ম ও জালিয়াতির প্রমাণ পেয়েছেন। লাখ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে এসব প্রতিষ্ঠানকে। বিএমএর সমাবেশে ভ্রাম্যমাণ আদালতের বিরুদ্ধেও বিষোদ্গার করা হয়েছে। কোনো কোনো বক্তা বলেছেন, র্যাব-পুলিশ দিয়ে অভিযান চালিয়ে চিকিৎসা-সংক্রান্ত পরীক্ষায় অনিয়ম ধরা কী করে সম্ভব?
ভ্রাম্যমাণ আদালত বিভিন্ন ল্যাবে অভিযান পরিচালনার সময় তো সিভিল সার্জন কার্যালয়ের প্রতিনিধি, ওষুধ প্রশাসনের লোকজন সঙ্গে নিয়ে যান। তাহলে মেয়াদোত্তীর্ণ রাসায়নিকের ব্যবহার, টেকনোলজিস্টের অনুপস্থিতি বা নমুনা পরীক্ষার ক্ষেত্রে নানা অনিয়মের জন্য এই অভিযান পরিচালনা ও জরিমানার বিষয়টি নিয়ে চিকিৎসকদের গাত্রদাহের কারণটি বোধগম্য হলো না।
চিকিৎসকদের হেয় করা এই লেখার উদ্দেশ্য নয়। এ দেশে বহু শ্রদ্ধেয় চিকিৎসক আছেন, তাঁদের স্বতঃস্ফূর্ত মানবিক উদ্যোগের কথা আমরা জানি। গরিবদের বিনা মূল্যে চিকিৎসার পাশাপাশি নিজের টাকায় ওষুধ কিনে দিয়ে তাদের সুস্থ করে তোলার দায়িত্ব পর্যন্ত পালন করেছেন কত চিকিৎসক, তার ইয়ত্তা নেই। তাঁরা কি আমাদের প্রতিপক্ষ হতে পারেন? কিছুতেই নয়। তাহলে আমি, আমার মা-বাবা বা সন্তানসন্ততি কার চিকিৎসায়, কার সেবা-শুশ্রূষায় রোগ-শোক জয় করে বেঁচেবর্তে আছি?
দু–একজনের দায়িত্বে অবহেলা বা এ ধরনের কাজের জন্য একটি পেশার মানুষকে দায়ী করা চলে না। চিকিৎসক ও রোগী প্রতিপক্ষ নন, বরং চিকিৎসকের আশা ও আশ্বাসে ভরা মুখটির দিকে তাকিয়ে যেন আমাদের রোগক্লিষ্ট মুখে ফুটে ওঠে অনাবিল হাসি।
বিশ্বজিৎ চৌধুরী: কবি, লেখক ও সাংবাদিক।
[email protected]