চিন্তার সংস্কৃতি বদলাতে প্রয়োজন হবে পরিকল্পিত ব্যবস্থাপনা

ছোটবেলায় পড়া কিছু জিনিস মগজে এমনভাবে ঢুকে থাকে, প্রয়োজনে ঘড়ির অ্যালার্মের মতো টিক টিক করতে থাকে। একটি বইয়ে পড়েছিলাম, বিড়ালজাতীয় প্রাণী বা কুকুরের যখন ছোট্ট ছানা জন্ম নেয়, তখন প্রাকৃতিক নিয়মেই চোখ খুলে মায়ের দুধ খায়। মায়ের অল্প দিনের যত্নে নিজ পায়ে দাঁড়িয়ে যায়। পাখিও তেমনি ডিমে তা দেয়, ডিম থেকে বাচ্চা বের হয়। মা পাখি যত্ন নেয়, বাবা পাখি পাহারা দেয় অনেক সময়। মুখে তুলে খাবার দেয় মা। একসময় উড়তে শেখে, তারপর ডানা মেলে মিশে যায় প্রকৃতিতে। অন্য প্রাণীরাও তা–ই। কিন্তু মানুষকে বড় করতে হয় অনেক দিনে। শেখাতে হয় অনেক দিন, বছর। শিখতে হয় সারা জীবন। যেমন উন্নত চলাচলব্যবস্থা আছে যেসব দেশে, তারা জানে, পথে একটু পরপরই সংকেত আছে এত মাইল বা কিলোমিটার গতি। এত মাইল গেলে গতি ক্যামেরা সামনে। এখানে গতি কমাতে হবে। এসব প্রয়োজন হয় মানুষকে তার প্রতি মুহূর্তে, প্রতি পদে নিয়ন্ত্রিত রাখতে জীবন রক্ষার জন্য।

আমার সহজ হিসাব; যত দিন পৃথিবীতে কোভিড-১৯ ভাইরাস দুর্বল ভাইরাসে পরিণত না হয় বা নিয়ন্ত্রিত না হয়, তত দিন পর্যন্ত প্রচারণা কার্যক্রম বন্ধ করা যাবে না। মুখে মাস্ক পরা, পাঁচ ফুট দূরত্ব বজায় রাখা, হাত ধোয়া, পরিষ্কার–পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা বন্ধ করা যাবে না।

কোনো রকম লক্ষণ দেখা গেলে সঙ্গে সঙ্গে পরীক্ষা করান। পর্যাপ্ত পানি পান করা, ডিম, দুধসহ মাছ ও মুরগির পর্যাপ্ত প্রোটিন খাওয়া, সবজি খাওয়া—এসব দৈনন্দিন অভ্যাসে পরিণত করতে হবে। যাঁরা আর্থিকভাবে অসচ্ছল, তাঁদের জন্য নির্ভুল পক্ষপাতহীন তালিকা প্রণয়নের দ্রুত ব্যবস্থা করতে হবে। আমরা কাপাসিয়াতে এভাবে ২০২০ সালের এপ্রিল মাসের ১০ তারিখ থেকে অক্টোবর পর্যন্ত ৬ মাস এই কার্যক্রম চালিয়েছি। দুই জায়গায় আইসোলেশন সেন্টার করেছিলাম। যিনি রান্না করছিলেন, আমি নিজে তাঁকে খাবারের তালিকা করে দিয়েছিলাম প্রতি বেলার। এমনকি মার্চের শেষে ইতালি থেকে কিছু প্রবাসী, যাঁরা বিভিন্ন এলাকার (কুমিল্লা, শরিয়তপুর, নারায়ণগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জ, ঢাকা প্রভৃতি), তাঁদেরও আমরা কাপাসিয়ায় কোয়ারেন্টিনে রেখেছি। আমি প্রতিদিন তাঁদের মনোবল ধরে রাখতে ফোনে কথা বলেছি। আমরা তাঁদের সব খাবারের ব্যবস্থা করেছি কোনো রকম সরকারি অনুদান ছাড়া। শেষে আমাদের নিজ খরচে প্রত্যেককে তাঁদের বাড়িতে পৌঁছে দিয়েছি। কষ্ট পেতে দিইনি।

কাপাসিয়ায় যেমন সংগঠন ও সহযোগী সংগঠন, তেমনি অনেক সাধারণ মানুষও স্বেচ্ছাসেবীর কাজ করেছে। আমি আক্রান্ত প্রত্যেকের সঙ্গে প্রতিদিন ফোনে কথা বলে সাহস জুগিয়েছে। আমাদের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা, উপজেলা পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা, তৎকালীন থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সার্বক্ষণিক আমার সঙ্গে মিলে কাজ করেছেন।

কাপাসিয়ায় মাতৃমৃত্যু শুন্যের কোঠায় নামিয়ে আনতে প্রায় ছয় বছর ধরে আমরা কাজ করছি। গত তিন বছরে প্রসবকালে কোনো গর্ভবতীর মৃত্যু হয়নি। কোভিড-১৯–এর মধ্যে এই কার্যক্রম যেন কোনো অবস্থায়ই ঝিমিয়ে না পড়ে, তার জন্য সর্বোচ্চ কার্যক্রম গ্রহণ করেছি। যার ফলে কাপাসিয়ায় মাতৃমৃত্যু শুন্যের কোঠায়। শিশুদের প্রতিও আমরা সর্বোচ্চ খেয়াল রাখছি।

১৯৭০ সালে বারান্দা থেকে ফুলের বাগানে দ্রুত নামতে গিয়ে আমার আম্মার পা ভেঙে যায়। সে সময় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে প্লাস্টার করার কোনো সরঞ্জাম ছিল না। তিন দিন আম্মাকে অপেক্ষা করতে হয়। আমরা ছোট অসহায় শিশু দুই বোন আম্মার যন্ত্রণা দেখেছি।

দেশ স্বাধীন হলো। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত স্বদেশে ফিরে এলে আমার বাবা তাজউদ্দীন আহমদ স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী অর্থ ও পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত হন। ১৯৭২ সালে তাঁর নেতৃত্বে বাংলাদেশের প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা কাজ শুরু করে। এই কাজে পরিকল্পনা কমিশনে একঝাঁক জ্ঞানী, স্বচ্ছ ধারণাসম্পন্ন, দেশপ্রেমে পরিপূর্ণ সদস্যরা সমন্বিতভাবে কাজ শুরু করেন। বিশেষভাবে আমি সেই সময়ের সরকার এবং তাজউদ্দীন আহমদের গণমানুষের স্বাস্থ্যব্যবস্থা, শিক্ষা ও অন্যান্য সমন্বিত উন্নয়ন পরিকল্পনা ভাবনা সংক্ষিপ্ত আকারে তুলে ধরছি।

বর্তমানের উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, সে সময় থানা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স নামে প্রতিটি থানায় করার ব্যবস্থা করা হয়। এই কমপ্লেক্সকে সম্পূর্ণ ইউনিট হিসেবে স্থাপনের পরিকল্পনা ছিল। মেডিসিন থেকে হৃদ্‌রোগ, হাড়, গাইনি, শিশু, চোখসহ তৎকালীন সব চিকিৎসাব্যবস্থা এই কমপ্লেক্সে থাকবে। এখানে ১০ জন কনসালট্যান্ট থাকবেন, পুরো থানায় (উপজেলায়) জুনিয়র কনসালট্যান্ট ১০ জন, ২১ জন মেডিকেল অফিসার এবং ১ জন উপজেলা (থানা) স্বাস্থ্য কর্মকর্তা। মেডিকেল টেকনোলজিস্ট, এক্স-রে মেশিন, অপারেটর, পরিচ্ছন্নতাকর্মীসহ যা প্রয়োজন, তার ব্যবস্থা রাখা হয়। একটি থানার (বর্তমান উপজেলার) মানুষকে যেন প্রাথমিক চিকিৎসার জন্য এলাকার বাইরে যেতে না হয়, তার সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা ছিল। তাজউদ্দীন আহমদের বক্তৃতা ও বিবৃতিতে বারবার উল্লেখিত হয়েছে, আমরা ভবিষ্যতে এমন বাংলাদেশ গড়ে তুলব, যেখানে কতজন ডাক্তার, কতজন নার্স, ইঞ্জিনিয়ার, যা যেখানে প্রয়োজন, তার ব্যবস্থা থাকবে।

১৯৭২ সালের ২৪ নভেম্বর দৈনিক পূর্বদেশ–এ তাঁর একটি বক্তব্য পাওয়া যায়। সেখানে তাজউদ্দীন আহমদ বলেন, ‘পরিকল্পিত জনশক্তি ছাড়া কোনো পরিকল্পিত অর্থনীতি হতে পারে না। অর্থনৈতিক তৎপরতা সকল ক্ষেত্রে প্রয়োজন মেটানোর জন্য জনশক্তিকে যুক্তিসংগতভাবে বণ্টন করা হবে। জনশক্তি সম্পর্কে পরিকল্পনা রচনার সময় ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, শিক্ষাবিদ ও কৃষিবিদদের সম্পর্কে দেশের চাহিদার ওপর লক্ষ রাখা হবে।...দেশের শিক্ষকদের পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ দেওয়া উচিত, যাতে তাঁরা শিশুদের মানসিক গঠন বুঝে সে অনুযায়ী শিক্ষা দানে সক্ষম হন।’ ১৯৭৩ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি পূর্বদেশ–এ প্রকাশিত হয়, ‘আগামী এপ্রিল মাসে দেশের প্রথম পাঁচশালা পরিকল্পনা প্রকাশিত হবে। জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও জনগণের মৌলিক প্রয়োজনের কথা মনে রেখেই এ পরিকল্পনা করা হয়েছে। ... আমাদের কী ধরনের শিক্ষার প্রয়োজন, কী ধরনের শিল্প আমরা গড়ে তুলছি, কোন ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আমাদের প্রয়োজন ইত্যাদি সম্পর্কে এ পরিকল্পনায় পরিষ্কার ধারণা দেওয়া হবে। সরকার জীবনের সর্ব ক্ষেত্রে স্বয়ংম্ভরতা আনতে চান।’ ১৯৭২ সালের ৭ আগস্ট দৈনিক ইত্তেফাক–এ ছাপা হয়, ‘বর্তমান শিক্ষাপদ্ধতি সম্পূর্ণ পাল্টাতে হবে। ...বর্তমানে এ দেশের শিক্ষা অঙ্গনে যাহা শিখানো হইতেছে, তাহা একটি নতুন দেশের সমস্যার বহির্ভূত। তাজউদ্দীন আহমদ শিক্ষাবিদদের দেশের সত্যিকার সমস্যা ও শিক্ষার কথা ভাবিয়া সমস্যার সমাধানকল্পে সকলকে আগাইয়া আসার আহ্বান জানান।’

এপ্রিলের ১ ও ২ তারিখ দৈনিক ইত্তেফাক–এ প্রকাশিত হয়, ‘তাজউদ্দীন আহমদ তাঁহার ভাষণে বাংলাদেশের উন্নয়ন পরিকল্পনার উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য পূরণের নিশ্চয়তা বিধানের মাধ্যমে দেশ হইতে দরিদ্রতার অবসান করাই আমাদের পরিকল্পনার মূল লক্ষ্য। আহার, বাসস্থান, স্বাস্থ্য এবং শিক্ষার ন্যূনতম ব্যবস্থা করাই আমাদের অন্যতম লক্ষ্য। ...একটি সুষ্ঠু পরিকল্পনাভিত্তিক জনসংখ্যা এবং আমাদের পরিকল্পনা বাস্তবায়নে জনসম্পদের সফল ব্যবহারের বিষয়টিকে আমরা অধিক গুরুত্ব দান করিয়াছি। অতীতে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় বরাদ্দের ব্যাপারে নিদারুণ অবহেলা করা হয়েছে। তাই আমাদিগকে এই খাতে, বিশেষ করিয়া প্রাথমিক শিক্ষা এবং সকল পর্যায়ে শিক্ষার গুণগত উন্নয়নসহ গ্রামভিত্তিক চিকিৎসা সুযোগের সম্প্রসারণ করিতে হইবে।’

ফেব্রুয়ারি ২৫, ১৯৭৩ দৈনিক পূর্বদেশ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়, ‘তাজউদ্দীন আহমদ বলেন, “একটি নতুন শিক্ষাব্যবস্থা এই পাঁচশালা পরিকল্পনার আওতায় পড়বে। দেশের জনশক্তিকে কাজে লাগানো হবে। ডাক্তার, বিচারক, অধ্যাপক, শিক্ষক, কারিগর, প্রকৌশলী প্রভৃতি গড়ে তোলার দিকে নজর দেওয়া হবে। ছাত্রদের মধ্যে কার কোন বিষয়ে ঝোঁক রয়েছে, তা যাচাই করার চেষ্টা করতে হবে”।’ ১৯ মে ১৯৭৩ দৈনিক পূর্বদেশ–এ প্রকাশিত হয়, ‘তাজউদ্দীন বলেন, ‘‘দেশে আজ সাধারণ শিক্ষার সঙ্গে সঙ্গে আরও বেশি কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা আবশ্যক। কেবলমাত্র সাধারণ শিক্ষার ফলে বেকারত্ব বৃদ্ধি পাচ্ছে।

পরীক্ষায় অসদুপায় অবলম্বনের মাধ্যমে ডিগ্রি লাভ করে কখনোই সমাজের এবং দেশের মঙ্গল করা যায় না’’।’ ৩১ অক্টোবর দৈনিক বাংলা ও দৈনিক পূর্বদেশ–এ তাজউদ্দীন আহমদের দীর্ঘ বক্তব্য প্রকাশিত হয়। সেখানে তিনি বলেন, ‘আমরা সামন্তবাদী অবস্থা ও পরিবেশ থেকে এখনো পূর্ণ গণতান্ত্রিক অবস্থায় পৌঁছাতে পারিনি। সামন্তপ্রথা আজ নেই সত্য, কিন্তু সামন্ত মনোবৃত্তি এখনো রয়েছে। এই মানসিকতার আগে পরিবর্তন করতে হবে।’ ১৯ মার্চ ১৯৭৩ দৈনিক পূর্বদেশ–এ ছাপা হয়, ‘নতুন মানসিকতা ছাড়া দেশের উন্নয়ন করা সম্ভব নয়। নিজেদের কর্তব্য পালন করলেই জাতীয় কর্তব্য করা হবে।’

গত ৫০ বছরে জনসংখ্যা হয়েছে দ্বিগুণ বা তার বেশি। শিক্ষার কথা আজ না, শুধু স্বাস্থ্য বিষয়ে বলি। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স এ পর্যন্ত প্রয়োজনীয়সংখ্যক পরিচ্ছন্নতাকর্মী নেই। এক্স-রে ফিল্ম থেকে শুরু করে রক্ত পরীক্ষার রি–এজেন্ট মাত্র কয়েক মাসের জন্য পাওয়া যায়। ডাক্তার নেই। অ্যানেসথেশিয়ার ডাক্তার নেই, প্রায় সব জায়গায়ই। ‘নেই’–এর তালিকা দীর্ঘ। অসহায় বোধ করা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। কাপাসিয়ায় আমার তত্ত্বাবধানে আমরা পাঁচজন পরিচ্ছন্নতাকর্মী রেখেছি। এক্স-রে ফিল্ম, রি–এজেন্টের যেন কোনো অভাব না হয়, সে ব্যবস্থা করেছি। ডাটা এন্ট্রি অপারেটর নিয়োগ করেছি। অভ্যর্থনা ও অনুসন্ধান ডেস্ক করেছি। সার্বক্ষণিকভাবে একজন সেখানে কর্তব্যরত থাকেন। এই খরচ মেটানোর জন্য আমি স্লোগান তৈরি করেছি, ‘আপনার প্রতিদিন এক টাকা দান, বাঁচাতে পারে অসহায় মানুষের প্রাণ।’

সোনালি ব্যাংকে আমার সম্পৃক্ততা ছাড়া মানবিক সহায়তা তহবিল খুলেছি। যেন স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত থাকে। আমি যদি না থাকি, মরেও যাই, তবু যেন কাপাসিয়ার মানুষ চিকিৎসাসেবা থেকে বঞ্চিত না হয়। কাজটি খুব সহজেই, শুধু আন্তরিকতা থাকলেই পুরো দেশে করা সম্ভব।

আমি আজ কোভিডে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে বসে লিখছি। আমার সামনে অগণিত মানুষের অসহায় মুখ। আমি তাদের হাসিমুখ দেখতে চাই। সরকারের নীতি নির্ধারণী পর্যায়ে অনুরোধ, আর দেরি নয়, বিশেষজ্ঞ প্যানেল করুন। যাঁরা বোঝেন ও জানেন, তাঁদের মতামত এবং কাজ করার, বিবেচনাপ্রসূত সিদ্ধান্ত দেওয়ার সুযোগ দিন। শুধু কোভিড-১৯ নয়, অন্য চিকিৎসাসেবাও যেন ব্যাহত না হয়, সে ব্যবস্থা করুন। সময় কারও জন্য বসে থাকে না। কাজ করার সময় এখনই।

সিমিন হোসেন রিমি জাতীয় সংসদ সদস্য,লেখক ও সমাজকর্মী
[email protected]