চিম্বুক থেকে ম্রোরা যে কারণে ঢাকায় এসেছিলেন

ম্রো জনগোষ্ঠির লোকজন ‘উন্নয়ন’ দেখতে ঢাকা আসেনি, এসেছিল উন্নয়ন–ভাবনার অপরিণামদর্শীতা তুলে ধরতে
ছবি; সংগৃহীত

বিশ্বের বুকে শীর্ষ স্থান দখল করা বায়ুদূষিত ধূলিধূসর এই নগরে বান্দরবানের চিম্বুক পাহাড় থেকে ২৮ জন ম্রো এসেছিলেন। ওঁরা পাহাড়ি মানুষ। ওঁদের প্রায় কেউই এই শহর আগে দেখেননি। কিন্তু ওঁরা এই শহরের দালানকোঠা আর বিশৃঙ্খল ফ্লাইওভারের ‘উন্নয়ন’ দেখতে আসেননি। ওঁরা এই শহরের মানুষদের বলতে চান, আমরা তোমাদের উন্নয়ন চিন্তা বুঝতে পারি না। কী করে তোমরা আমাদের জন্মভূমি পাহাড়ে ফাইভ স্টার হোটেল বানানোর পরিকল্পনা করো? তাহলে কী হবে আমাদের ১০টি গ্রামের? কী হবে আমাদের বনের? কী হবে প্রাকৃতিক ঝরনাধারা ও জলাধারের? কী আমাদের ছোট ছোট পাহাড়ি সন্তানদের ভবিষ্যৎ?

চিম্বুক-নাইতং পাহাড় থেকে ম্রোদের এই শহরে আসার খবর পেয়েছিলাম বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া একমাত্র ম্রো ছাত্রের কাছ থেকে। ওর লম্বা চুল। ওর ধলিধূসর চোখ যেন কত কথা বলতে চায় আমাদের, এই শহরের মানুষকে। এই ম্রো ছেলেটি কী বলতে চায়, তোমাদের এই অপরিণামদর্শী উন্নয়ন-ভাবনা পাপ? এই সীমাহীন মুনাফার লোভ পাপ? আদিম জাতিগোষ্ঠীকে অপমানে নিষ্পেষিত করা, দুঃখ দেওয়া, ত্রাসিত রাখা পাপ? পাপ অরণ্য-পাহাড়-নদী-প্রকৃতি ধ্বংস করে ওদের বিপন্ন করে তোলা? অরণ্য উজাড় করে ফাইভ স্টার হোটেল আর বিনোদনের স্থাপনা তৈরি করে জীববৈচিত্র্য, প্রাণীর অভয়ারণ্য নিশ্চিহ্ন করা মহাপাপ? এই ধূসর চোখের ছেলেটি হয়তো আরও বলতে চায়, আমাদের ধ্বংস করে দিয়ে তোমরাও একদিন বিপন্ন হবে। এখানে আমাদের পূর্বপুরুষের পবিত্র সমাধিক্ষেত্র আছে। তোমরা পাহাড় কেটে, বৃক্ষ উজাড় করে রাস্তা ও ব্রিজ করে কলুষিত করেছ আদিম জনপদ আমাদের বিস্তীর্ণ বিচরণ ভূমি। ছেলেটি হয়তো বলতে চায়, তোমরা তো অনেক আগেই বুড়িগঙ্গা, ধলেশ্বরী, শীতলক্ষ্যা, তুরাগ, পদ্মা-মেঘনা-যমুনা-তিস্তাসহ সব নদী প্রায় শেষ করে দিয়েছ। ব্রহ্মপুত্র-সোমেশ্বরী-সুরমা-কুশিয়ারাও মৃতপ্রায়। সুন্দরবন বিপন্ন। বহু আগেই ভাওয়াল গাজীপুরের বনভূমি দখল হয়ে গেছে। মধুপুরের শালবন মুমূর্ষু। চলনবিলও হারিয়ে গেছে। জাফলংয়ের পাথর ধূলিকণা নিঃশেষিত।

ছেলেটি হয়তো আরও বলতে চায়, তোমাদের অস্তিত্বও ভীষণ বিপন্ন। তোমাদের সমাজে মানুষে মানুষে বিচ্ছিন্নতা বাড়ছে, জলবায়ু পরিবর্তন হচ্ছে, তোমাদের আগ্রাসী উন্নয়ন মানুষকে আকাশচুম্বী লোভী ও নিষ্ঠুর করে তুলছে। তাই তোমরা ভাবো, এগিয়ে চলেছ, নাকি পিছিয়ে যাচ্ছ?

সরকারি তথ্যচিত্রে যে অপ্রতিরোধ্য উন্নয়নের ছবি ভাসছে, তার প্রতিফলন কি আছে পাহাড়ে, জনজাতি মানুষের জীবনে? চা-বাগানের লাখো নারী-শিশুর জীবনে? হাওর অঞ্চলে, দলিত, হরিজন ও প্রান্তিক প্রতিবন্ধী মানুষের জীবনে? এই ব্যাপক বৈষম্য পাপ। এই কথাগুলোই হয়তো শহরের সংবেদনহীন ভোঁতা হয়ে মানবিক মূল্যবোধ ক্ষয়ে যাওয়া ভদ্র মানুষদের বলতে এসেছেন বহুদূর পাহাড় থেকে এই ম্রোরা। আসুন, পাহাড় ও ধরিত্রীর সন্তান এই মানুষদের অন্তত একটি দিন এই শহরে একটু ভালোবাসা, মমতা, বেঁচে থাকার প্রেরণা দিই। ওদের মনের কথা উপলব্ধি করার চেষ্টা করি। আসুন, সবাই ওঁদের পাশে দাঁড়াই। আমি খবর পেয়েছি ওঁরা ভালো করে বাংলা ভাষা জানেন না। তাই লম্বা বক্তৃতার বদলে ওঁরা নিজেদের সংস্কৃতির ঐতিহ্যবাহী বাঁশের বাঁশি ‘প্লুং’ বাজিয়ে ওদের মনের বেদনার কথা বলতে চেয়েছেন। ম্রোদের কাছে হয়তো স্মার্টফোন নেই, ফেসবুক, টুইটার, ইউটিউব, হোয়াটসঅ্যাপ—কত কী নেই! আসুন, ওদের পক্ষ হয়ে আমরা ওদের অধিকারের কথা, যন্ত্রণা ও অস্তিত্বের গান সবখানে ছড়িয়ে দিই।

মহাশ্বেতা দেবীর কথা মনে পড়ে। দিদির সঙ্গে ঢাকায় আমার দুবার দেখা হয়েছিল। দিদি ওই বয়সেও গান গাইতেন। আরমা দিদির বাসায় তাঁর গান শুনেছি। মহাশ্বেতা দেবী এই আদি মানুষদের গান লিখেছেন, ‘হায় হায় আঁধি এসেছে! হায় হায় জমি চলে যাচ্ছে! হায় হায় দেশ চলে যাচ্ছে! হায় হায় জমি-দেশ-মানুষ-ধুলা হয়ে যাচ্ছে! হায় হায় বাতাস থেকে ধূলিকণা ধরে এনে কেমন করে তাকে শস্যক্ষেত্র বানাব? বানাব হারিয়ে যাওয়া দেশ।’ যে উন্নয়ন কিছু মানুষকে নিখোঁজ করে দেয়, দুঃখ দেয়, কেন আমরা তা হতে দেব।

প্রথম আলো ১০ ফেব্রুয়ারি খবর ছেপেছে। জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক পাঁচটি বিশেষজ্ঞ সংস্থা সরকারকে এই পাঁচ তারকা হোটেল নির্মাণ বন্ধের আহ্বান জানিয়েছে। দেশের বিশিষ্ট নাগরিকেরাও এই দাবি জানিয়েছেন। ম্রো জনগণ কালচারাল শোডাউনসহ লংমার্চ করেছেন বান্দরবানে। জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার বলেছেন, এই হোটেল বানানোর ফলে ওই এলাকার পরিবেশ ও ম্রো জাতিগোষ্ঠীর জীবনযাপনে মারাত্মক হুমকি সৃষ্টি হবে।

আমি জানি, আমাদের এই প্রিয় শহরে অনেক মানবিক ও সংবেদনশীল মানুষ আছেন। অনেক সংস্কৃতিমান ও ভালো মনের তরুণ আছেন। শিল্পী-গায়ক-লেখক-সাংবাদিক-শিক্ষক-আইনজীবী আছেন। আসুন, সবাই এই ম্রো জনগোষ্ঠীর পাশে দাঁড়াই। ওদের ভূমিতে জোরজবরদস্তিমূলক ফাইভ স্টার হোটেল নির্মাণের শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ করি। আমি আশা করব, আমাদের সরকার শেষ অবধি ওদের কথা শুনবে। আমি সব সময় বলি, এই পাহাড়ি জনজাতি মানুষের ও অন্যান্য প্রান্তিক মানুষের যন্ত্রণা শুধু চোখ দিয়ে দেখলে হবে না, অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে দেখার চেষ্টা করতে হবে। সম্ভব হলে দৃষ্টি দিয়ে নয়, হৃদয় দিয়ে অনুভব করতে হবে। এই হৃদয় দিয়ে অনুভব করতে সক্ষম মানবিক রাষ্ট্র নিশ্চয়ই আমরা একদিন গড়ে তুলতে পারব। তখন ম্রোদের মতো কাউকে এত কষ্ট করে এত দূরের পথ পাড়ি দিয়ে দুঃখ ও যন্ত্রণার কথা বলতে শহরে আসতে হবে না।

সঞ্জীব দ্রং কলাম লেখক ও সংস্কৃতিকর্মী

[email protected]