চিম্বুক পাহাড়ে হোটেল চাই না

বান্দরবানে চিম্বুক পাহাড়।
ছবি: প্রথম আলো

বান্দরবানে চিম্বুক পাহাড়ের কোলে ম্রো জনগোষ্ঠী তাদের চিরায়ত পাহাড়, ভূমি ও অস্তিত্ব রক্ষার আন্দোলনে নেমেছে। আজ থেকে ১১ বছর আগে, ২০০৯ সালের ১ ডিসেম্বর প্রথম আলোতে আমার কলামে ‘ধরিত্রী আমার নয়, আমিই ধরিত্রীর’ শিরোনামে লিখেছিলাম, ‘ম্রোদের পাড়া থেকে যখন ফিরি, তখন পশ্চিমে সূর্য ডুবে যাচ্ছে। ওরা বলল, ওদের জুম, বাগানভূমি, বিচরণক্ষেত্র, পূর্বপুরুষের অবারিত রেখে যাওয়া বিস্তীর্ণ বন ও পাহাড় বেদখলে চলে যাচ্ছে। ওদের অনুমতি দূরে থাক, কেউ জিজ্ঞেসও করেনি। শক্তিহীন, ক্ষমতাহীন, অর্থহীন, এমনকি শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত এক পাহাড়ি সমাজ, যারা ধরিত্রী ও প্রকৃতি, বন ও পাহাড়ের বুকে বয়ে চলা নদী ও জলধারাকে, পরিবেশকে এতকাল রক্ষা করে এসেছে সবার জন্য, তারা এখন উপেক্ষিত, বিলুপ্তপ্রায় অসহায় এক জাতি। এ ধারায় চললে একদিন ওরা হারিয়ে যাবে।

প্রথম আলোতে দেখলাম (৯ নভেম্বর পৃষ্ঠা ৪) চিম্বুক পাহাড়ে সিকদার গ্রুপের পর্যটন স্থাপনা নির্মাণ বন্ধের দাবিতে বিক্ষোভ মিছিল করেছেন ম্রো জনগণ। তাঁরা বাঁশি ও ঢোল বাজিয়ে চিম্বুক পাহাড়ে হোটেল নির্মাণের প্রতিবাদ জানিয়েছেন। শত শত ম্রো নারী-পুরুষ এই বিক্ষোভে অংশ নিয়েছেন। ম্রোরা বলেছেন, নাইতং পাহাড়ের নামও বদলে দিয়েছে ভূমিলোভী চক্র। এসব প্রথাগত ও ঐতিহ্যগত জমিতে কাপ্রুপাড়া, দোলাপাড়া, ইরাপাড়া ও কলাইপাড়ার শতাধিক¤ ম্রো পরিবার জুমচাষ করে আসছে। পরিবারগুলো বলছে, এই হোটেল ও পর্যটনকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করা হলে চারটি পাড়া সরাসরি উচ্ছেদ হবে। আর ৭০ থেকে ৮০টি পাড়ার ম্রোরা উচ্ছেদের হুমকির মুখে পড়বে।

আমাদের জিজ্ঞাসা, কেন ম্রোদের ঐতিহ্যগত ভূমিতে এই হোটেল ও পর্যটনকেন্দ্র স্থাপন করতে হবে? পাহাড়ের হাজার হাজার একর ভূমি দখল হয়ে গেছে, বন উজাড় হয়ে গেছে অনেক আগে। এখানে বন, প্রকৃতি, নদী, জীববৈচিত্র্য—সব মানুষের অত্যাচারে মুমূর্ষু। রাবারবাগান ও অন্যান্য প্রকল্পের নামে কত জমি দখল হয়ে গেছে। সেসব জায়গায় এসব স্থাপনা করা হোক, যেখানে পাহাড়িদের প্রথাগত ভূমি কেড়ে নিতে হবে না।

দীর্ঘ দুই যুগের বেশি সময়ে যে প্রশ্নের মুখোমুখি বারবার হয়েছি, তা হলো কেন পাহাড়ি বনবাসী মানুষের ভূমির কাগজ বা দলিল নেই? এর উত্তর আমি বহুবার দিয়েছি। জাতিসংঘ নিজেও তার স্থায়ী ফোরামের মাধ্যমে উত্তর দিয়েছে যে ঐতিহাসিক কারণে আধুনিক রাষ্ট্রগুলোতে এসব মানুষ অবিচার ও বৈষম্যের শিকার হয়েছে। তারা যুগ যুগ ধরে এসব ভূমিতে বসবাসের পরও রাষ্ট্রগুলো তাদের ভূমির মালিকানা নিশ্চিত করেনি। তাই জাতিসংঘ এই প্রথাগত ও ঐতিহ্যগত বা এনসেস্ট্রাল ভূমি অধিকারকে স্বীকৃতি দিয়েছে এবং সদস্যরাষ্ট্রগুলোকে এ বিষয়ে পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে। এ বিষয়ে জাতিসংঘের কয়েকটি ঘোষণাপত্রও আছে। আইএলও ইনডিজেনাস ও ট্রাইবাল পপুলেশন কনভেনশন ১০৭, যা ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু সরকার র‌্যাটিফাই করেছে, তার ১১ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘এসব জনগোষ্ঠীর সদস্যদের ঐতিহ্যগতভাবে অধিকৃত ভূমির ওপর যৌথ কিংবা ব্যক্তিগত মালিকানার অধিকার স্বীকার করতে হবে।’ আবার জাতিসংঘের ইনডিজেনাস পিপলস ঘোষণাপত্রের ২৬ ধারায় বলা হয়েছে, যেসব ভূমি, অঞ্চল ও প্রাকৃতিক সম্পদ তারা বংশপরম্পরায় ঐতিহ্যগতভাবে ভোগদখল করে আসছে বা কোনো রকমে ব্যবহার করে আসছে, তার ওপর তাদের অধিকার রয়েছে। রাষ্ট্র তাদের রীতিনীতি, ঐতিহ্য ও ভূমি মালিকানা প্রথাকে যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করে এসব ভূমি, অঞ্চল ও সম্পদের আইনগত স্বীকৃতি প্রদান করবে। আমি মনে করি, আন্তর্জাতিক এই চেতনা, ঘোষণাপত্র ও স্বীকৃতিই ম্রোদের আন্দোলনে শক্তি ও প্রেরণা জোগাবে। তাদের অধিকার আছে ‘না’ বলার।

আমি এক যুগ আগেই চিম্বুক নিয়ে লিখেছিলাম। সামনে, পেছনে, দূরে, কাছে সব পাহাড়, অপরূপ সুন্দর এক বাংলাদেশ। নিচে মেঘমালা আর আর ছোট ছোট ম্রো গ্রাম। বাড়িগুলো বাঁশ ও শণ দিয়ে তৈরি। মাচাং ধরনের। এখানে ধরিত্রী, প্রকৃতি ও মানুষ পরিপূরক, একাকার। মানুষ ধরিত্রীর, ধরিত্রী মানুষের নয়। বাঙালিরা বলেন, পৃথিবী আমার, ভূমি আমার। আমরা বলি, পৃথিবী আমার নয়, আমিই পৃথিবীর। এই ভূমি আমার নয়, আমিই ভূমির। এই ধরিত্রী ও ভূমি কেনাবেচা করার জন্য নয়। একে নষ্ট করার, ধ্বংস করার অধিকার মানুষের নেই।

বান্দরবানে এসব পাহাড় ও ভূমি ছিল পাহাড়িদের, এই ম্রো, বম, লুসাই, ত্রিপুরা, মারমা, খিয়াং, খুমি ও পাংখুদের। দূরের মানুষ তো জানেই না ‘ম্রো’ শব্দের অর্থ মানুষ। গারোদের ‘মান্দি’ মানেও মানুষ। সাঁওতালদের ‘হড়’ মানেও মানুষ। জেনেছিলাম, বম জাতি নিজেদের ‘লাই’ বা ‘লাইমি’ বলত। এর অর্থও মানুষ। আজ অপরিণামদর্শী উন্নয়নের আগ্রাসনে এসব মানুষের জীবন ছারখার হতে চলেছে।

আজও চিম্বুকের কথা মনে পড়লে মেল গিবসনের বিখ্যাত চলচ্চিত্র অ্যাপোক্যালিপ্টোর শেষ দৃশ্য চোখের সামনে ভেসে ওঠে। ছবিতে নায়ককে তাড়া করছে দস্যুর দল। প্রাণপণে ছুটছে নায়ক বনের ভেতর দিয়ে। একসময় গভীর জলপ্রপাতের ভেতর ঝাঁপিয়ে পড়ে নায়ক। দূরে জলপ্রপাতের ওপারে হানাদারের দল দাঁড়িয়ে থাকে। নায়ক ওদের দিকে চিৎকার করে বলে, ‘এই বন আমার। এখানে শিকার করেছিল আমার বাবা। এই বনে শিকার করব আমি, আমার সন্তান এবং ভবিষ্যতে আমার সন্তানদের সন্তান।’

এ ছবির শেষ দৃশ্যটি আরও অর্থবহ। হানাদারের সঙ্গে যুদ্ধে জয়ী হয় নায়ক। কোলে তার নবজাত সন্তান চোখ মেলে চেয়ে থাকে। স্ত্রী পাশে দাঁড়িয়ে। একটু দূরে সমুদ্রতীরে কয়েকটি জাহাজ ভেড়ে। জাহাজে অচেনা মানুষের দল। নায়ককে স্ত্রী প্রশ্ন করে, ‘ওরা কারা, আমরা কি তাদের সঙ্গে যাব?’ নায়ক তার নবজাত সন্তানের দিকে তাকিয়ে বলে, ‘ওরা এই বনে বহিরাগত মানুষ নিয়ে আসে। আমরা ওদের সঙ্গে যাব না। বনে ফিরে যাব, আমাদের সন্তানের জন্য নতুন স্বপ্নের দেশ গড়ে তুলব।’ আমি আশা করব, সরকার এই ম্রোদের কথা শুনবে।

সঞ্জীব দ্রং: কলাম লেখক ও সংস্কৃতিকর্মী

[email protected]