চীনকে ভার্চ্যুয়াল অফিস ব্যবস্থা রপ্ত করতেই হবে

করোনা মহামারি শুরু হওয়ার আগে সারা বিশ্বেই বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কর্মীরা যোগাযোগসংক্রান্ত খরচাপাতি কমানোর জন্য ই-মেইল এবং কনফারেন্স কলের আশ্রয় নিতেন। কিন্তু যথার্থ সমন্বয়ের অভাবে এসব প্রযুক্তির ব্যবহার তখন খুব কঠিন ছিল। লোকে পুরোনো অভ্যাস ছেড়ে নতুন প্রযুক্তি ব্যবহারে উদাসীন ছিল। সে সময় একটি ভার্চ্যুয়াল মিটিংয়ের আয়োজন করা হলে অংশগ্রহণকারীরা সাধারণত মনে করতেন, মিটিংটা হয়তো গুরুত্বপূর্ণ কিছু না।

কোভিড-১৯ মহামারির ঠেলায় পড়ে গোটা অর্থনৈতিক খাতের কাজ ভার্চ্যুয়াল ধরনে রূপান্তরিত হতে বাধ্য হওয়ায় এখন আগের সমন্বয়জনিত অনেক সমস্যারই সমাধান হয়ে গেছে।

আর্থিক খাতের সবাইকে এ নতুন প্রযুক্তি কেনায় পয়সা ঢালতে বাধ্য হতে হয়েছে এবং সেই সুবাদেই সেগুলোর ব্যবহারবিধি তাদের জানতে হয়েছে। এখন পরিস্থিতি এমন জায়গায় এসেছে যে ভার্চ্যুয়াল বৈঠককে এখন আর আগের মতো কম গুরুত্বপূর্ণ কিংবা নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে বিবেচনা করার সুযোগ নেই। এখন প্রায় প্রতি সপ্তাহেই ওয়ার্কপ্লেস অ্যাপগুলো উত্তরোত্তর ব্যবহারবান্ধব হয়ে উঠছে।

যুক্তরাষ্ট্রে গুগলের মতো বড় বড় কোম্পানি এবং ফেডারেল রিজার্ভের মতো সরকারি সংস্থাগুলো ভার্চ্যুয়াল ওয়ার্কপ্লেসকে বেছে নিয়েছে এবং ঘোষণা দিয়েছে, মহামারি শেষ হওয়ার পরও তাদের উল্লেখযোগ্যসংখ্যক কর্মী বাড়িতে থেকে বা তাদের সুবিধামতো জায়গায় অবস্থান করে অফিসের কাজ চালিয়ে যাবেন। এতে কোম্পানির অফিসবিষয়ক অবকাঠামোগত খরচাপাতি কমবে, অন্যদিকে কর্মীরাও তাঁদের ওয়ার্ক শিডিউল ও কোথায় বাস করতে চান, সে বিষয়ে স্বচ্ছন্দ হতে পারবেন। এতে দূরবর্তী জায়গা থেকে অফিসে আসা–যাওয়ায় গণপরিবহনের ব্যবহার কমবে, আবার নাগরিক জনঘনত্বও হ্রাস পাবে।

কিন্তু গত এক বছরে চীনে অনেক খাতে এ প্রযুক্তির সুফল নেওয়া হয়নি। ফলে পাইকারি হারে ভার্চ্যুয়াল কাজ করা হয়নি এবং মহামারি–পরবর্তী পরিস্থিতিতে নতুন ভার্চ্যুয়াল কর্মপরিবেশ নিয়ে যথেষ্ট আলাপ–আলোচনাও হয়নি। অথচ চীন যদি দ্রুততার সঙ্গে আর্থিক খাতের সব শাখায় ভার্চ্যুয়াল অফিস ব্যবস্থা চালু করতে পারে, তাহলে তারা ইউরোপ–আমেরিকার চেয়ে বেশি লাভবান হবে।

উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ভার্চ্যুয়াল প্রযুক্তি বহু কর্মীর জীবনযাপনের খরচ কমিয়ে দেবে। চীনের শহর এলাকায় বাচ্চাদের বড় করা সাংঘাতিক ব্যয়বহুল বিষয়। সাংহাই শহরে সিটি সেন্টার এলাকায় প্রতি বর্গফুটের বার্ষিক আবাসন ব্যয় ১ হাজার ৪৫৩ ডলার। কিন্তু একজন ফুল টাইম কর্মীর বার্ষিক গড় আয় ১২ হাজার ডলার। এর চেয়ে ভয়ানক কথা হলো চীনে কাজ করতে হয় সকাল নয়টা থেকে রাত নয়টা অথবা রাত নয়টা থেকে ভোর ছয়টা পর্যন্ত। সপ্তাহে ছয় দিন হিসেবে পুরো সপ্তাহে মোট ৭২ ঘণ্টা কাজ করতে হয়।

অন্যদিকে নিউইয়র্ক সিটিতে প্রতি বর্গফুটের বার্ষিক আবাসন ব্যয় ১ হাজার ৪৩৮ ডলার। আর কর্মী সপ্তাহে ৪৩ ঘণ্টা কাজ করে আয় করেন ৭৪ হাজার ৮৩৪ ডলার। তার মানে নিউইয়র্কে থাকা কর্মীর চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ কাজ করে সাংহাইয়ের কর্মী পান তার মাত্র অর্ধেক মজুরি।

অন্যদিকে, চীনে শহরাঞ্চলের মা–বাবার পক্ষে সন্তানদের সময় দেওয়া একেবারেই কঠিন। কারণ, চীনের সাধারণ স্কুলশিক্ষার্থীদের সপ্তাহে গড়ে ১৭ ঘণ্টা কাটাতে হয় হোমওয়ার্ক করে এবং ছয় ঘণ্টা যায় শিক্ষকদের সঙ্গে। ফলে অভিভাবকেরা তাদের সময় দেওয়ার সময় পান খুবই কম। কিন্তু টেলিকমিউটিং থাকলে পুরো চিত্রটাই আলাদা হয়ে যেত।

গত এক বছরে চীনে অনেক খাতে এই প্রযুক্তির সুফল নেওয়া হয়নি। ফলে পাইকারি হারে ভার্চ্যুয়াল কাজ করা হয়নি এবং মহামারি–পরবর্তী পরিস্থিতিতে নতুন ভার্চ্যুয়াল কর্মপরিবেশ নিয়ে যথেষ্ট আলাপ–আলোচনাও হয়নি

আবার চীনের শহরাঞ্চলের বায়ুদূষণ পরিস্থিতি বিশ্বের প্রায় যেকোনো দেশের যেকোনো শহরের চেয়ে খারাপ। শুধু দূষণের কারণে সেখানে ২০১৭ সালে ১২ লাখ ৪০ হাজার মানুষ মারা গেছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে জন্মহার বাড়ানো এবং দূষণ কমানো নিয়ে চীন চাপে রয়েছে। দেশটি শহরাঞ্চলে এক সন্তান নীতি বাতিল করে ২০১৬ সালে দুই সন্তান নীতি চালু করেছে। পাশাপাশি দুই সন্তান নিলে সরকারের তরফ থেকে বিভিন্ন সহায়তা দেওয়ার ব্যবস্থাও রাখা হয়েছে। কিন্তু তারপরও দেশটিতে গত ৫০ বছরের মধ্যে জন্মহার সবচেয়ে তলানিতে নেমে এসেছে।

দূষণ কমাতে হলে গাড়ির ব্যবহার কমাতেই হবে। বেইজিংয়ে এক লিটার গ্যাসোলিনের জন্য খরচ হয় ১ ডলার এবং নিউইয়র্কে খরচ হয় ০.৯০ ডলার। গাড়ির ব্যবহার কমাতে চীন ২০০০ সাল থেকে রেলপথ নির্মাণে ১০ হাজার ৩০০ কোটি ডলার খরচ করেছে।

এরপরও চীন গাড়ির ব্যবহার লক্ষণীয় মাত্রায় কমাতে পারেনি। এ অবস্থায় চীন যদি ভার্চ্যুয়াল ওয়ার্কপ্লেসের দিকে পূর্ণমাত্রায় নজর দেয়, তাহলে দেশটি এসব সমস্যা থেকে বেরিয়ে আসতে পারবে।

ইংরেজি থেকে অনূদিত, স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট

ন্যান্সি কিয়ান নর্থ ওয়েস্টার্ন ইউনিভার্সিটির কিল্লোগ স্কুল অব ম্যানেজমেন্টের ম্যানেজারিয়াল ইকোনমিকসের অধ্যাপক