চীনমুখী নতুন বাণিজ্য জোট ও কমজোরি আমেরিকা

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর জোট আসিয়ান ও তাদের মুক্ত বাণিজ্য অংশীদার ৫টি দেশ এই জোট গঠনের একটি চুক্তিতে সই করেছে, যার নেতৃত্বে থাকছে চীন
এএফপি

এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের ১৫টি দেশকে নিয়ে ১৫ নভেম্বর গড়ে উঠল বিশ্বের বৃহত্তম বাণিজ্যিক জোট। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর জোট আসিয়ান ও তাদের মুক্ত বাণিজ্য অংশীদার ৫টি দেশ এই জোট গঠনের একটি চুক্তিতে সই করেছে, যাকে বিশ্বের সর্ববৃহৎ মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (এফটিএ) হিসেবে দেখা হচ্ছে। এ চুক্তির মাধ্যমে এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় বাণিজ্যে চীনের প্রভাব আরও জোরদার হবে। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র আন্ত প্রশান্ত মহাসাগরীয় অংশীদারি চুক্তি থেকে পিছু হটায় এ অঞ্চলে তাদের প্রভাব অনেকটাই খর্ব হবে।

২০১২ সালে কম্বোডিয়ায় অনুষ্ঠিত আসিয়ান সম্মেলনে আরসিইপির বিষয়ে আনুষ্ঠানিক আলোচনা শুরু হয়। এ উদ্যোগের মূল লক্ষ্য হলো, নিজেদের মধ্যে বাণিজ্যে শুল্ক কমানো, সরবরাহ শৃঙ্খল শক্তিশালীকরণ ও ই-কমার্সের জন্য নতুন বিধিবিধান চালু করা।

বিভিন্ন গণমাধ্যমের খবর অনুসারে ভিয়েতনামে ৩৭তম আসিয়ান সম্মেলনের সমাপনী দিনে রিজিওনাল কম্প্রিহেনসিভ ইকোনমিক পার্টনারশিপ (আরসিইপি) শীর্ষক চুক্তিতে স্বাক্ষর করে আসিয়ানভুক্ত ১০টি দেশ ও তাদের এফটিএ অংশীদার ৫টি দেশের শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তারা। চুক্তিবদ্ধ হওয়া ১৫টি দেশ হলো আসিয়ানভুক্ত ব্রুনেই, কম্বোডিয়া, ইন্দোনেশিয়া, লাওস, মালয়েশিয়া, মিয়ানমার, ফিলিপাইন, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড ও ভিয়েতনাম এবং তাদের এফটিএ অংশীদার অস্ট্রেলিয়া, জাপান, নিউজিল্যান্ড, দক্ষিণ কোরিয়া ও চীন।

তবে চুক্তিটি সই হলেও তা কার্যকর হতে সময় লাগবে। সিঙ্গাপুরের বাণিজ্য ও শিল্পমন্ত্রী জানিয়েছেন, আরসিইপি কার্যকর হতে জোট গঠনের সিদ্ধান্ত অনুসারে অন্তত ৬টি আসিয়ান দেশ ও ৩টি আসিয়ান-বহির্ভূত অংশীদার দেশের অনুমোদন পেতে হবে। সিঙ্গাপুর কয়েক মাসের মধ্যে এ চুক্তিতে অনুমোদন দেওয়ার পরিকল্পনা করছে বলেও তিনি জানান ।

এবারের আসিয়ান সম্মেলনের আয়োজক দেশ ভিয়েতনামের প্রধানমন্ত্রী আশা করেছেন, চুক্তি স্বাক্ষরকারী দেশগুলো শিগগিরই আরসিইপি কার্যকরের অনুমোদন দেবে এবং এই জোট কোভিড-১৯ মহামারি-উত্তর অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখবে বলে তাঁর বিশ্বাস।

আরসিইপি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে চীনের প্রভাব বাড়াতে বড় ভূমিকা রাখবে বলে ইতিমধ্যেই বহুল আলোচিত। এ চুক্তির ফলে আসিয়ানভুক্ত ১০টি দেশের পাশাপাশি জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার মতো বাণিজ্যিক পরাশক্তির সঙ্গে সরাসরি অংশীদারত্বে যাচ্ছে চীন।

আরসিইপিকে বিশ্বের সবচেয়ে বড় এফটিএ বলা হচ্ছে, কারণ বিশ্বের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ জনগোষ্ঠী ও এক-তৃতীয়াংশ জিডিপি এ বাণিজ্য চুক্তির আওতায় আসবে। চুক্তিবদ্ধ ১৫টি দেশে প্রায় ২২০ কোটি মানুষের বসবাস। অর্থাৎ বাজারটি বেশ বড়। বৈশ্বিক জিডিপিতে অঞ্চলটির সম্মিলিত অবদান ৩০ শতাংশের বেশি। সব মিলিয়ে এই ১৫টি দেশের মোট দেশজ উৎপাদনের পরিমাণ প্রায় ২৬ লাখ ২০ হাজার কোটি ডলার।

আরসিইপি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে চীনের প্রভাব বাড়াতে বড় ভূমিকা রাখবে বলে ইতিমধ্যেই বহুল আলোচিত। এ চুক্তির ফলে আসিয়ানভুক্ত ১০টি দেশের পাশাপাশি জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার মতো বাণিজ্যিক পরাশক্তির সঙ্গে সরাসরি অংশীদারত্বে যাচ্ছে চীন। এটা নিশ্চিত যে বিশ্বের সবচেয়ে দ্রুত বর্ধনশীল অঞ্চলে বাণিজ্যিক অংশীদারিতে এগিয়ে থাকার অর্থ হলো যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে অর্থনৈতিক প্রতিপত্তির লড়াইয়ে অনেকটাই এগিয়ে যাওয়া।

যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষেত্রে পরিস্থিতি আবার পুরোটাই ভিন্ন। সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ট্রান্স-প্যাসিফিক পার্টনারশিপের (টিপিপি) উদ্যোগ নিয়েছিলেন। সেই উদ্যোগ কার্যকর হলে প্রশান্ত মাহাসাগরীয় অঞ্চলে এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যিক প্রভাব-বলয় তৈরি হতো। কিন্তু ওবামা-পরবর্তী মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ২০১৭ সালে টিপিপি চুক্তি থেকে নিজেদের প্রত্যাহার করে নেন।

ভারত ২০১২ সাল থেকে এই জোটে যোগ দেওয়ার প্রাথমিক উদ্যোগের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকলেও পরিশেষে যুক্ত হয়নি। ভারতীয় সূত্রের মতে, এই জোটে যোগ দিলে আমদানি শিল্পে শুল্ক হ্রাসের বাধ্যবাধকতার ফলে ভারতীয় অভ্যন্তরীণ শিল্পের ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

আরসিইপি কতটা প্রভাব বিস্তারকারী হয়ে দাঁড়াতে পারে, তা একটি উদাহরণের মাধ্যমেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এশিয়ার দুই শীর্ষ অর্থনৈতিক পরাশক্তি চীন ও জাপান এই প্রথম কোনো চুক্তিতে যুক্ত হলো, যার মাধ্যমে দেশ দুটির মধ্যকার বাণিজ্যে শুল্ক বাধা অনেকটাই দূর হবে। এর মাধ্যমে কার্যত যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র হিসেবে পরিচিত জাপানের বাজারেও প্রবেশের পথ তৈরি করল চীন।

ভারত ২০১২ সাল থেকে এই জোটে যোগ দেওয়ার প্রাথমিক উদ্যোগের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকলেও পরিশেষে যুক্ত হয়নি। ভারতীয় সূত্রের মতে, এই জোটে যোগ দিলে আমদানি শিল্পে শুল্ক হ্রাসের বাধ্যবাধকতার ফলে ভারতীয় অভ্যন্তরীণ শিল্পের ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এ ছাড়া সাম্প্রতিক সময়ে এশিয়ার দুই প্রতিবেশী চীন ও ভারতের মধ্যে দেখা দিয়েছে ভূরাজনৈতিক বিরোধ, যা শেষ পর্যন্ত অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক দ্বন্দ্বের রূপ ধারণ করেছে। চীনের প্রভাবমুক্ত হওয়ার জন্য ভারত যেখানে দেশীয় উৎপাদন বাড়ানোর মাধ্যমে আত্মনির্ভরশীলতা বাড়ানোর দিকে নজর দিয়েছে, বেইজিং সেখানে আঞ্চলিক বাজার দখলের মাধ্যমে নিজেদের প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা চালাচ্ছে। আরসিইপি চীনের এ উদ্যোগে বাড়তি শক্তি জোগাবে। অনেকে অবশ্য মনে করছেন, আসিয়ানের এফটিএ অংশীদার হিসেবে প্রথমে এ আলোচনায় যুক্ত থাকলেও ২০১৯ সালে নিজেদের প্রত্যাহার করে নেওয়ার মাধ্যমে ভারত চীনের সঙ্গে দৌড়ে অনেকটাই পিছিয়ে পড়ল।

অনেকের মতে, আরসিইপির ফলে মার্কিন ও এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের বাইরের বহুজাতিক কোম্পানিগুলো সেখানে ব্যবসা করতে গিয়ে কিছু প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হতে পারে। বিশেষ করে ট্রাম্প প্রশাসনের টিপিপি আলোচনা থেকে সরে যাওয়া ও আরসিইপি চুক্তি বাস্তবায়নের কারণে মার্কিন কোম্পানিগুলোর এ অঞ্চলে প্রভাব বিস্তার করাটা কঠিন হয়ে পড়বে। এসব বিশ্লেষকদের অনেকেই মনে করেন, আরসিইপি এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের চুক্তি হলেও এর প্রভাব কেবল অঞ্চলটির মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে না।

বাংলাদেশ এই বাণিজ্য জোটে নেই। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, বাংলাদেশ এই জোটে যোগ দেওয়ার কোনো আমন্ত্রণ পায়নি। তবে অনেকেরই ধারণা, বাংলাদেশ যেহেতু উল্লেখিত বাণিজ্যিক জোটের অন্তর্ভুক্ত দেশগুলোতে খুব বেশি পণ্য রপ্তানি করে না এবং চীন ও জাপানের বাজারে বাংলাদেশি পণ্যের প্রায় ৯৭-১০০ শতাংশ শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার রয়েছে, তাই রাজস্ব খাতে আমদানি শুল্ক নির্ভরশীল বাংলাদেশের এই নতুন বাণিজ্যিক জোটে যোগদান আপাতত তেমন কোনো সুফল বয়ে আনতে পারবে না। তবে বাংলাদেশকে ধীরে ধীরে এশীয় অঞ্চলের বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ডে তার সম্ভাব্য অংশগ্রহণ নিশ্চিতের জন্য এই ধরনের বাণিজ্যিক জোটের সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে হবে। এমনকি শিগগিরই এই জোটের পর্যবেক্ষক দেশ হিসেবে যোগ দেওয়ার উদ্যোগও চালিয়ে যেতে হবে। সেই সঙ্গে বাণিজ্য সক্ষমতা এবং পণ্য বহুমুখিতাও বাড়াতে হবে অনেক গুণ।

মামুন রশীদ অর্থনীতি বিশ্লেষক