চীনের নদী মনস্তত্ত্ব

১৯৯৭ সালে নদী আইনসংক্রান্ত বৈশ্বিক চুক্তির বিপক্ষে ভোট পড়েছিল মাত্র তিনটি। এই দেশগুলোর মধ্যে চীন ছিল অন্যতম। চুক্তিটির আলোচনায় চীন অংশ নিয়েছিল এবং কিছু কিছু বিধানের বিষয়ে বেশ উৎসাহ দেখিয়েছিল। এরপরও চীন এর বিপক্ষে ভোট দিয়েছিল। বৈশ্বিক চুক্তির আলোচনায় নিজের মত যতটা সম্ভব জারি করে, পরে সরে আসাটা আমেরিকা, রাশিয়া বা চীনের মতো দেশগুলোর জন্য অবশ্য বিরল নয়।

কনভেনশনটির বিষয়ে চীনের অভিমত আসলে কী? আন্তর্জাতিক নদী ব্যবহারে তার প্র্যাকটিস কী? চীনের নদীসংক্রান্ত মনস্তত্ত্ব জানতে এসব বোঝা আমাদের জন্য আরও জরুরি হয়ে পড়েছে ব্রহ্মপুত্র নদের উজানে তার প্রকল্পের সংবাদ প্রকাশিত হওয়ার পর। ব্রহ্মপুত্র নদটি সাংপো নামে চীনের তিব্বত থেকে যাত্রা শুরু করে ভারতের অরুণাচল ও আসাম রাজ্য হয়ে বাংলাদেশের ভেতর প্রবাহিত হয়েছে। আসাম ভ্যালিতে দুটো উপনদী যুক্ত হওয়ার পর ব্রহ্মপুত্র আরও অনেক বেগবান হয়েছে সত্যি, কিন্তু চীনের উৎস নদীটি (সাংপো) ব্রহ্মপুত্রের যে পানি জোগান দেয়, তার পরিমাণও প্রায় ৪০ শতাংশ।

চীন সাংপোতে ছোট কিছু প্রকল্পের কাজ শেষ করেছে বলে ভারতের গণমাধ্যমে সংবাদ রয়েছে। চীনের পাওয়ার কন্সট্রাকশন করপোরেশনের প্রেসিডেন্ট বৃহৎ আকৃতির জলবিদ্যুৎ প্রকল্প নির্মাণের ঘোষণা দেন সপ্তাহ দুয়েক আগে। এরপর চীনের সরকারি গণমাধ্যমে ৬০ গিগাওয়াট পর্যন্ত জলবিদ্যুৎ প্রকল্প চীন সাংপোতে নিতে পারে বলা হয়।

এ ধরনের অতিকায় প্রকল্প নির্মিত হলে (বিশেষ করে প্রকল্পে জলাধার থাকলে) শুকনা মৌসুমে ভারত ও বাংলাদেশে ব্রহ্মপুত্র নদের পানি অনেকাংশে কমে যাবে। ভারত এই প্রকল্পের বিষয়ে ইতিমধ্যে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। চীনের প্রকল্পের কুফল ঠেকাতে ভারতও অরুণাচল প্রদেশে ব্রহ্মপুত্রের ভরা মৌসুমের পানি ধরে রাখার একটি বহুমুখী প্রকল্প নির্মাণ করতে পারে। আল–জাজিরার একটি সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে ভারতের পানি মন্ত্রণালয়ের বরাত দিয়ে বলা হয় যে ভারতের এ প্রকল্পেও বিশালাকৃতির জলাধার থাকবে এবং এটি সরকারের উচ্চতম পর্যায়ে বিবেচনার জন্য রয়েছে। সত্যি সত্যি চীন ও ভারত তাদের পরিকল্পনা অনুসারে এগোলে বাংলাদেশে ব্রহ্মপুত্রের পানি উল্লেখযোগ্য পরিমাণে হ্রাস পেতে পারে। এর অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত কুফল হবে মারাত্মক।

আন্তর্জাতিক নদীর বিষয়ে ভারতের মনোভাব আমরা মোটামুটি জানি। কিন্তু আমাদের জন্য চীনের মনোভাবটা জানাও এখন প্রয়োজন। প্রয়োজন দুটো দেশই তাদের নিজস্ব স্বার্থ অনুসারে এগোলে বাংলাদেশের করণীয় কী তা নিয়ে ভাবা।

২.

চীন ৪০টি আন্তর্জাতিক নদীর অববাহিকা দেশ। ১৪টি দেশের মধ্য দিয়ে এসব নদী প্রবাহিত। কিন্তু চীনের সঙ্গে নদীর পানির ব্যবহারসংক্রান্ত চুক্তি রয়েছে মাত্র তিনটি দেশের (রাশিয়া, কাজাখস্তান ও মঙ্গোলিয়া)। সব কটি চুক্তিই চীনের উত্তরাঞ্চলের নদীগুলো নিয়ে। এর মধ্যে পৃথিবীর সর্ববৃহৎ সীমান্ত নদী আমুর-এর ওপর রাশিয়া ও চীন যৌথভাবে একটি সেতু নির্মাণ করেছে মাত্র চার মাস আগে।

তুলনায় দক্ষিণাঞ্চলের নদীগুলোর মধ্যে অন্যতম মিকং নদী নিয়ে আঞ্চলিক যে চুক্তি রয়েছে, চীন তাতে আছে শুধু পর্যবেক্ষক হিসেবে। মিকংয়ের উজানে চীনের কিছু প্রকল্পের কারণে বরং নিম্ন অববাহিকায় খরা পরিস্থিতি সৃষ্টির অভিযোগ রয়েছে। অন্যদিকে ব্রহ্মপুত্র নদ নিয়ে ভারত ও বাংলাদেশের সঙ্গে যে সমঝোতা স্মারকগুলো চীন করেছে, তাতে রয়েছে শুধু তথ্য প্রদানের অঙ্গীকার। ২০১৭ সালে দোকলাম বিরোধের সময় ভারতকে বছরখানেকের জন্য তথ্য দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছিল চীন। চীনের তথ্য কতটুকু পর্যাপ্ত, তা নিয়েও সংশয় আছে ভারতে।

উত্তরাঞ্চলের তুলনায় চীনের দক্ষিণাঞ্চলের কিছু নদীতে পানিপ্রবাহ অনেক বেশি, বেশি এসব নদীর অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত গুরুত্ব। সবচেয়ে বড় কথা, উচ্চ অববাহিকায় থাকার কারণে এসব নদীর ওপর চীনের নিয়ন্ত্রণও বেশি। চীন এসব নদী ব্যবহারে তার অধিকারের বিষয়ে সোচ্চার ও অনড়। সাংপোতে চীনের প্রকল্প প্রসঙ্গে সম্প্রতি চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র এই অধিকারের কথা জোর দিয়ে উল্লেখ করেছেন। তিনি অবশ্য অন্য দেশের কোনো ক্ষতি হবে না, এটি বলেছেন। কিন্তু আন্তর্জাতিক নদীতে একতরফা বড় প্রকল্পের ক্ষেত্রে এমন আশ্বাস দেওয়া যেকোনো দেশের জন্য গৎবাঁধা বুলির মতো।

চীনের উন্নয়ন দর্শনে বিশাল ড্যাম, গিগাবাইট জলবিদ্যুৎ প্রকল্প, এমনকি নদীর পানির আন্ত–অববাহিকা স্থানান্তর একটি সাধারণ বিষয়। ভারতেরও তা–ই। ব্রহ্মপুত্রের ওপর দুটো দেশই বড় প্রকল্প নেবে, এটি প্রায় নিশ্চিতভাবে বলা যায়। প্রশ্ন হচ্ছে, সবচেয়ে নিম্ন অববাহিকার দেশ বাংলাদেশ কী করবে তখন?

৩.

বাংলাদেশের জন্য অপশন কম না। বাংলাদেশ দেনদরবার করতে পারে, কিন্তু এটি শক্তভাবে করতে হলে আন্তর্জাতিক আইনের কাঠামোতে নিজে প্রবেশ করতে হবে। ১৯৯৭ সালের আন্তর্জাতিক নদী চুক্তিটি অনুসমর্থন করতে হবে।

চীন ১৯৯৭ সালের আন্তর্জাতিক চুক্তির বিরোধিতা করেছিল, এতে রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বকে খর্ব করা হয়েছে এবং এতে বিরোধ নিষ্পত্তিতে তৃতীয় পক্ষের যুক্ত হওয়ার বিধান আছে বলে। ভারত এই চুক্তির ভোটাভুটি বর্জন করেছিল। মজার ব্যাপার হচ্ছে, বর্জনের পক্ষেও ভারত মূলত এসব যুক্তিই দেখিয়েছিল। চুক্তিটির আলোচনাকালে ভারত ও চীন দুই দেশই ন্যায্য ব্যবহার নীতির ওপর জোর দিয়েছিল। অন্যদিকে চুক্তিটি গ্রহণের পক্ষে ভোট দেওয়া বাংলাদেশসহ পৃথিবীর অধিকাংশ নিম্ন অববাহিকার দেশ গুরুত্ব দিয়েছিল নো-হার্ম বা কোনো ক্ষতি করা যাবে না এ নীতির ওপর।

কনভেনশনটির চূড়ান্ত বিধানগুলোতে নো-হার্ম নীতিকে যথেষ্ট গুরুত্ব দেওয়া হয়। পরিবেশগত ক্ষতির বিষয়েও এখানে উল্লেখযোগ্য বিধান রয়েছে। বাংলাদেশ এরপরও চুক্তিটি অনুসমর্থন করেনি আজও। ফলে বাংলাদেশকে এ চুক্তির সদস্যরাষ্ট্র বলার উপায় নেই। সদস্যরাষ্ট্র হলে বাংলাদেশের পক্ষে অনেক জোরালোভাবে বলা সম্ভব যে আন্তর্জাতিক নদীতে ক্ষতিকর কোনো প্রকল্প অন্য দেশ নিতে পারবে না। বিষয়টি নিয়ে নদীভিত্তিক বৃহৎ প্রকল্পে অর্থায়ন করে এমন দাতাগোষ্ঠীর ওপর চাপ সৃষ্টি করাও সহজতর হয়ে উঠবে।

নদীর পানি ব্যবহারসংক্রান্ত ইউরোপের দেশগুলোর মধ্যে ১৯৯২ সালের একটি কনভেনশন (চুক্তি) রয়েছে। ২০১৫ সালে তারা এটি পৃথিবীর যেকোনো দেশের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়। বাংলাদেশ এ কনভেনশনটিরও সদস্যরাষ্ট্র হলে এর বহু সুবিধা পেতে পারে।

এগুলো আইনগত দিক। এর বাইরে বাংলাদেশ নিজেও ভরা মৌসুম পানি ধরে রাখার প্রকল্প নিতে পারে। গঙ্গায় এ ধরনের একটি প্রকল্প নেওয়ার পরিকল্পনা কয়েক যুগ ধরে রয়েছে। আমার মনে হয় না গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র বা তিস্তা নদ–নদীতে এ ধরনের প্রকল্প নির্মাণে বাংলাদেশের থেমে থাকার কোনো যুক্তি রয়েছে, অন্তত রাষ্ট্রের স্বার্থের দৃষ্টিকোণ থেকে।

আসিফ নজরুল: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক