চীনের সঙ্গে শক্তির প্রতিযোগিতা ও যুক্তরাষ্ট্রে নতুন ক্ষমতাকৌশল

সোভিয়েত ইউনিয়নের ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে স্নায়ুযুদ্ধের চার দশক ধরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিশাল এক কৌশল নিয়েছিল। তারপরও নব্বই দশকে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর আমেরিকা মহাপরাক্রমশালী নেতা হয়ে উঠতে পারেনি। ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর সন্ত্রাসী হামলার পর মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশের প্রশাসন এই অপারগতাকে এমন একটি কৌশল দিয়ে পূরণ করার চেষ্টা করে, যাকে তারা ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে বৈশ্বিক যুদ্ধ’ বলে আখ্যায়িত করে। এই কৌশলকে নিখুঁতভাবে প্রয়োগ করতে গিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তান এবং ইরাকের মতো প্রান্তিক জায়গায় দীর্ঘ সময়ের জন্য যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। এরপর ২০১৭ সাল থেকে যুক্তরাষ্ট্র আবার চীনের সঙ্গে ‘শক্তি প্রতিযোগিতায়’ ফিরে এসেছে।

মহাপরাক্রমশালী হয়ে ওঠার এই প্রতিযোগিতা যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তা, অর্থনীতি ও মূল্যবোধের জন্য হুমকি হয়ে উঠেছে। যদিও সন্ত্রাসবাদ একটি অব্যাহত সমস্যা, যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে অবশ্যই গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে। সন্ত্রাসবাদ জুজুর ভয়ের মতো, যেখানে একটি দুর্বল প্রতিপক্ষ অপেক্ষাকৃত বৃহৎ প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নামে। নাইন–ইলেভেনের হামলায় ২ হাজার ৬০০ জনের বেশি মার্কিন নিহত হয়েছে। কিন্তু সেই প্রতিশোধ নিতে গিয়ে যুক্তরাষ্ট্র যে ‘অন্তহীন যুদ্ধ’ শুরু করেছে, তার জন্য আরও বেশি জীবন খরচ করতে হয়েছে। সেই সঙ্গে খরচ করতে হয়েছে ট্রিলিয়ন পরিমাণ ডলার। প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার প্রশাসন যখন বিশ্ব অর্থনীতির দ্রুত বর্ধনশীল অংশ এশিয়ার দিকে অগ্রসর হওয়ার চেষ্টা করেছিল, তখন ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে বৈশ্বিক যুদ্ধ’ আমেরিকাকে মধ্যপ্রাচ্যে আটকে রেখেছিল।

সন্ত্রাসবাদ জুজুর ভয়ের মতো, যেখানে একটি দুর্বল প্রতিপক্ষ অপেক্ষাকৃত বৃহৎ প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নামে। নাইন–ইলেভেনের হামলায় ২ হাজার ৬০০ জনের বেশি মার্কিন নিহত হয়েছে। কিন্তু সেই প্রতিশোধ নিতে গিয়ে যুক্তরাষ্ট্র যে ‘অন্তহীন যুদ্ধ’ শুরু করেছে, তার জন্য আরও বেশি জীবন খরচ করতে হয়েছে।

মহাপরাক্রমশালী প্রতিযোগিতার কৌশল আমেরিকাকে আবার আলোচনায় আনতে পারে; কিন্তু এর দুটি সমস্যা আছে। প্রথমত, এটি ভিন্ন ভিন্ন দেশগুলোকে একত্র করতে পারে। রাশিয়ার ক্ষমতা ক্রমেই কমে আসছে, আর চীন ক্রমেই শক্তিধর হয়ে উঠছে। তবে রাশিয়া যে হুমকি তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে, তার প্রশংসা যুক্তরাষ্ট্রকে করতেই হবে। ১৯১৪ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শুরুতে সারা বিশ্ব বেদনার সঙ্গে দেখেছিল যে একটি পতনশীল শক্তিও (অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরি) কখনো কখনো ঝুঁকি গ্রহণ করতে পারে। বর্তমানে রাশিয়া অর্থনৈতিক পতনের মধ্যে রয়েছে, কিন্তু এটাও সত্য যে তারা বিপুল সম্পদ ধরে রেখেছে। এই সম্পদ তারা পারমাণবিক অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ এবং সাইবার হামলা থেকে শুরু করে মধ্যপ্রাচ্য পর্যন্ত সবকিছু তছনছ করার কাজে ব্যয় করতে পারে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তাই একটি রাশিয়া কৌশল দরকার, যাতে সেই দেশটি চীনের কবলে পড়ে না যায়।

দ্বিতীয় সমস্যা হচ্ছে, মহাশক্তির এই ধারণা আমাদের জন্য এক নতুন হুমকি, যার মুখোমুখি আমরা ইতিমধ্যে দাঁড়িয়ে আছি। ১৯১৪ এবং ১৯৪৫ সাল থেকে জাতীয় নিরাপত্তা এবং বৈশ্বিক রাজনৈতিক অ্যাজেন্ডা পরিবর্তিত হয়েছে, কিন্তু মার্কিন কৌশল বর্তমানে পরিবেশগত বিশ্বায়নের নতুন হুমকি হিসেবে দেখা দিয়েছে। বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য ট্রিলিয়ন ডলার ব্যয় হবে। অন্যদিকে কোভিড-১৯ মহামারি ইতিমধ্যে লাখ লাখ আমেরিকানকে মেরে ফেলেছে। ১৯৪৫ সাল থেকে এ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র যত যুদ্ধে জড়িয়েছে এবং যত আমেরিকান এসব যুদ্ধে মারা গেছে, তার চেয়ে কোভিডে মৃত্যুর পরিমাণ বেশি।

যাহোক, মার্কিন নীতিনির্ধারকেরা চীনকে কীভাবে মোকাবিলা করা যায়, তা নিয়ে বিতর্ক করছেন। কিছু রাজনীতিবিদ এবং বিশ্লেষক বর্তমান পরিস্থিতিকে ‘নতুন স্নায়ুযুদ্ধ’ বলে অভিহিত করেছেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে খুব কম দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য বা সামাজিক যোগাযোগ ছিল। অপর দিকে আমেরিকা এবং তার মিত্ররা চীনের সঙ্গে প্রচুর বাণিজ্য করে এবং কয়েক লাখ চীনা শিক্ষার্থীকে তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করে। চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং স্তালিন নন। আবার চীনা ব্যবস্থাও মার্ক্সবাদী-লেনিনবাদী নয়। বরং চীন একটি পুঁজিবাদী রাষ্ট্র।

যেহেতু আমেরিকা নিজেই জলবায়ু পরিবর্তন বা মহামারি মোকাবিলা করতে পারে না, তাই তার শক্তিকে অন্যের সঙ্গে ব্যবহার করার ব্যাপারটি উপলব্ধি করতে হবে। এই বৈশ্বিক সমস্যাগুলো সমাধানের জন্য আমেরিকাকে এখন চীনের সঙ্গে কাজ করতে হবে।

চীন এখন বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ। এর জিডিপি সম্ভবত ২০৩০ সালের মধ্যেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে ছাড়িয়ে যাবে। তাই চীনকে কৌশলে মোকাবিলা করতে হবে। অস্ট্রেলিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী কেভিন রাড যেমন যুক্তি দিয়েছেন, চীনের সঙ্গে শক্তির প্রতিযোগিতা মানে অস্তিত্বের হুমকির বিরুদ্ধে বিজয় নয় বরং কৌশলগত বিজয় হিসেবে দেখা দরকার।

সুতরাং আমরা এসব সমস্যা তখনই সফলভাবে মোকাবিলা করতে পারব, যখন আমরা উপলব্ধি করতে পারব যে এটি বিংশ শতাব্দীর মহাপরাক্রমশালীর প্রতিযোগিতা নয়।

ইংরেজি থেকে অনূদিত, স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট

জোসেফ এস নাই হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও ডু মোরালস ম্যাটার বইয়ের লেখক