ছদ্মতাপসে আসলের মর্যাদাহানি ঘটবে

আধুনিক রাষ্ট্র ব্যবস্থাপনায় দুটি জিনিস খুব দরকার—মুনশিয়ানা ও গৃহিণীপনা। সেই সঙ্গে ব্যবস্থাপকদের প্রশাসনিক দক্ষতার সঙ্গে থাকতে হবে প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতা। যেকোনো পরিস্থিতির মোকাবিলায় তাৎক্ষণিক কী করণীয় তা জানা থাকতে হবে এবং অদূর ও দূরভবিষ্যতে কী ধরনের সমস্যা দেখা দিতে পারে তা সমাধানের প্রস্তুতি। কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে দশবার চিন্তা করা উচিত ভবিষ্যতে তা কোনো সমস্যা সৃষ্টি করবে কি না। যেকোনো কাজই হোক, তা দক্ষতার সঙ্গে করার নামই মুনশিয়ানা। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, তা হলো কাজটি গুছিয়ে করা। আধাখেঁচড়াভাবে করলে কোনো ভালো উদ্যোগও সুফল দেয় না। তার নামই গৃহিণীপনা।
বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পর থেকে সেই মুনশিয়ানা ও গৃহিণীপনার অভাব অনুভব করছে জাতি। শ্রেণিবিশেষের চাপে হোক, ঝোঁকের বশে হোক অথবা মতলববশত হোক, কিছু কিছু সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিভিন্ন সরকার, যা জাতির জন্য কল্যাণকর তো হয়ইনি বরং এমন দীর্ঘমেয়াদি ঝামেলা বা জটিলতা সৃষ্টি করেছে, তা থেকে বেরিয়ে আসা অসম্ভব হয়ে যাবে।
রাষ্ট্র একবার কোনো সুবিধা কাউকে দিলে তা যত যুক্তিসংগত কারণেই হোক, প্রত্যাহার করতে চাইলে অসন্তোষের কারণ ঘটবেই। বিশেষ করে যারা সেই সুবিধাটাই হারাবে। অন্যদিকে যে সিদ্ধান্তে রাষ্ট্রের দশ হাজারেও একজন উপকৃত হয় না, সে সিদ্ধান্ত বাতিল করলে মানুষ খুশিই হয়। সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্র কারও প্রতি অতিরিক্ত আনুকূল্য দেখাতে পারে না।
মুক্তিযুদ্ধ ছিল বাঙালি জাতির জীবনে এক বহুমাত্রিক আয়োজন। তাকে কোনো বিশেষ সংজ্ঞায় আবদ্ধ করা সম্ভব নয়। তা কোনো প্রথাগত যুদ্ধ ছিল না। তা শুধু সৈন্যসামন্তের বীরত্বের ব্যাপার ছিল না। তা ছিল জনযুদ্ধ। যে যেভাবে পেরেছে শত্রুর মোকাবিলা করেছে। যে কিছুই করতে পারেনি সে অকাতরে স্বাধীনতার জন্য জীবন দিয়েছে। যাঁরা জীবন দিয়েছেন তাঁদের প্রমোশন দেওয়া যাবে না, ইনক্রিমেন্ট দেওয়া যাবে না, পদক-পুরস্কার-সনদ কিছুই দেওয়া যাবে না। একই কারণে যিনি জীবন দিলেন, তিনি কিছুই পেলেন না; যিনি বেঁচে রইলেন তিনি এবং তাঁর অনাগত বংশধরেরা সবকিছুই পাবেন, সেটা নৈতিক দিক থেকে কতটা সঠিক বিজ্ঞ ব্যক্তিরা বলতে পারবেন। তবে এটাও ঠিক যে জাতির জীবনের সবচেয়ে বড় একটা ব্যাপারে যিনি বেশি অবদান রেখেছেন, তাঁর একটা স্বীকৃতি প্রাপ্য। তা তাঁকে দিলে কেউ আপত্তি করবে না।

নয় মাস যাঁরা পাকিস্তান সরকারের গোলামি না করে বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য কাজ করেছেন, ওই নয়টি মাসের বেতন যদি স্বাধীন দেশের সরকার তাঁকে দেয়, তা অন্যায্য নয়। অবশ্য তিনি তা গ্রহণ করবেন কি না তা তাঁর বিবেচনার বিষয়। যিনি দেশের জন্য ত্যাগ স্বীকার করতে পারেন, নয় মাসের বেতন তাঁর কাছে কিছুই না।

স্বাধীনতার অব্যবহিত পরে সরকারি কর্মকর্তাদের মধ্যে যাঁরা পাকিস্তান সরকারের চাকরি ছেড়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন, তাঁদের দুই বছরের জ্যেষ্ঠতা দেওয়া হয়। জ্যেষ্ঠতা দেওয়ার সিদ্ধান্তটি ছিল অদূরদর্শী। তার পরিণতি কী হতে পারে তা ভেবে দেখার প্রয়োজনবোধ করেননি নীতিনির্ধারকেরা। সেই দুই বছরের সিনিয়রিটি প্রশাসনের মধ্যে বিভক্তির জন্ম দেয়। একজন অভিজ্ঞ অফিসার দেখলেন তাঁর একজন জুনিয়র তাঁর ওপরে উঠে গেছেন। ২৫ মার্চ ১৯৭১ যিনি তাঁকে ‘স্যার’ সম্বোধন করতেন, তাঁকেই তিনি ‘স্যার’ ডাকবেন। সাবেক জুনিয়র বর্তমানে সিনিয়র ও তাঁর বস কলবেল টিপে পিয়ন দিয়ে ডেকে পাঠালে দৌড়ে যেতে হবে তাঁর রুমে। এ যে কত গ্লানি তা ভুক্তভোগী ছাড়া কারও পক্ষে ধারণা করা সম্ভব নয়। এ রকম ব্যাপার আমি বাহাত্তরে সচিবালয়ে দেখেছি।

আমার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা থেকে জানি, মুক্তিযোদ্ধা ও অ-মুক্তিযোদ্ধা বিভাজনের সিদ্ধান্ত বঙ্গবন্ধু, তাজউদ্দীন আহমদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, এম মনসুর আলী প্রমুখ প্রধান নেতার ধারণা থেকে হয়নি। কিন্তু তাঁদের সরকারই করতে বাধ্য হয়। বাহাত্তরে যাঁরা সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন, তাঁদের হুকুম তামিল না করলে বিপ্লব ঘটার আশঙ্কা ছিল। বঙ্গবন্ধু যদি আর মাসখানেক পরে পাকিস্তানের কারাগার থেকে ফিরে আসতেন, তাহলে জাতির যে কত রকম ক্ষতি হতো তা এখনকার কোনো মানুষকে বোঝানো সম্ভব নয়। জাতীয় পতাকার মাঝে বাংলাদেশের হলুদ মানচিত্র না রাখার কথা বলে অস্থায়ী প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ অসহায় বোধ করেন। সর্বময় ক্ষমতার অধিকারীদের দাপট তখন উপভোগ করার মতো। বঙ্গবন্ধু প্রত্যাবর্তন করে সর্বময় ক্ষমতাবানদের হাত থেকে জাতিকে উদ্ধার করেন। তিনি জাতিকে দুবার উদ্ধার করেছেন। একবার পাকিস্তানি জান্তার কবল থেকে, আরেকবার সর্বময় ক্ষমতাবানদের বলদর্পিতা থেকে।

প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মাঝখানে বিশের ও ত্রিশের দশকে পাশ্চাত্যে মার্টিন হাইডেগার ও জাঁ পল সার্ত্রের এক্সিসটেনশিয়াল বা অস্তিত্ববাদী দর্শন জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। সার্ত্রের তত্ত্ব হিসেবে একজন কলাম লেখক কলাম লেখক নয় বলেই সে কলাম লেখক। হেঁয়ালির মতো কথাটির অর্থ হলো এই কাল থেকে যদি তিনি কলাম লেখা ছেড়ে দিয়ে আদম ব্যবসা শুরু করেন, তাহলে তাঁকে কলাম লেখক বলা যায় না। সার্ত্রের ভাষায়, মানুষ হলো ‘ইউজলেস প্যাশন’ বা অর্থহীন ভাবাবেগ। সে তার ইচ্ছার স্বাধীনতা নিয়ে চলে। যিনি একসময় দেশের জন্য কাজ করেছেন, তিনিই যে দেশদ্রোহের কাজ করবেন না তার নিশ্চয়তা নেই। বঙ্গবন্ধুর ঘাতকদের প্রায় সবাই মুক্তিযোদ্ধা। অনেকেই সর্বোচ্চ খেতাবপ্রাপ্ত। নির্মম পরিহাস হলো, যখন ৩২ নম্বরে তাঁরা রক্তস্রোত বইয়ে দিচ্ছেন, তখন বঙ্গবন্ধুকে রক্ষার জন্য যিনি এগিয়ে এসে জীবন দেন, তিনি পাকিস্তান-প্রত্যাগত সেনা কর্মকর্তা, একজন ‘অ-মুক্তিযোদ্ধা’। সুতরাং অস্তিত্ববাদী দর্শনের তত্ত্ব ভুল নয়।

সেটা গেল এক জিনিস। তাঁরা প্রকৃতই একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধা কিন্তু যাঁরা আদৌ মুক্তিযোদ্ধা না হয়ে প্রতারণার মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধার সনদ জোগাড় বা ক্রয় করতে পেরেছেন, তাঁদের কী বলা যায়। একাত্তরের নভেম্বর মাসে যাকে দেখা গেছে দড়ি দিয়ে বই–খাতা বেঁধে হাফপ্যান্ট পরে মক্তবে পড়তে যাচ্ছে, তার বাড়ির সামনে নারকেলগাছে সাইনবোর্ড, তাতে লেখা, ‘বীর মুক্তিযোদ্ধা খড়ম আলী, সাব-সেক্টর কমান্ডার, অমুক সেক্টর—।’ অচেনা পথচারী মনে করেন ইনি তো দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তান—এখন মাদক ব্যবসা বা যা-ই করুন। কিন্তু পাড়ার মানুষ যখন ওই সাইনবোর্ডের দিকে তাকান তখন তাঁদের কারও পিত্তি জ্বলে, কারও মধ্যে ক্রোধের সঞ্চার হয়। অসত্য প্রতিষ্ঠা পেলে সমাজে অশান্তির সৃষ্টি  হয়। ঘৃণা ও হিংসা-প্রতিহিংসা বাড়ে। শ্রদ্ধাবোধ নষ্ট হয়।

পঁচাত্তরের পর থেকে বাংলাদেশে মুক্তিযোদ্ধাদের সংখ্যা ক্রমবর্ধমান। ধারণা করা যায়, ২০২১ সালের মধ্যে যখন দেশের আয়রোজগার বাড়বে, তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যাও ক্রমাগত বেড়ে যাবে। প্রায়ই এ সম্পর্কে পত্রপত্রিকায় লেখা হচ্ছে, কিন্তু কে কার কথা শোনে। সর্বশেষ এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘নতুন করে মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় যুক্ত করার জন্য এখন পর্যন্ত প্রায় ১ লাখ সুপারিশ পেয়েছে জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল (জামুকা)।... গত ২১ জানুয়ারি মহানগর, জেলা ও উপজেলা পর্যায় থেকে প্রাথমিক যাচাই-বাছাই শুরু হয়। গত সোমবার [১৮ সেপ্টেম্বর] পর্যন্ত ৩৪১টি কমিটি থেকে ওই সুপারিশ এসেছে। এখনো ১৪৭টি কমিটির সুপারিশ বাকি রয়েছে। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলেছেন, মুক্তিযোদ্ধা তালিকাভুক্তির জন্য কোনো কোনো এলাকায় স্থানীয় মন্ত্রী-সাংসদের প্রভাব রয়েছে। তালিকাভুক্তির জন্য আর্থিক লেনদেনেরও অভিযোগ এনে কারও কারও ভাতা বন্ধের সুপারিশ এসেছে। তা ছাড়া সব কমিটির সুপারিশের সংখ্যা দেড় লাখে পৌঁছাতে পারে।...এবার নিয়ে সপ্তমবারের মতো তালিকা পরিবর্তন এবং নতুন করে আরও মুক্তিযোদ্ধার নাম তালিকাভুক্ত করতে যাচাই-বাছাইয়ের প্রক্রিয়া চলছে দেশে। গত ৪৬ বছরে ছয়বার মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা পরিবর্তন করা হয়েছে।’ [প্রথম আলো, ২০ সেপ্টেম্বর]

বাহাত্তরে জেনারেল ওসমানীর স্বাক্ষরে যে তালিকা করা হয় এবং সনদ দেওয়া হয় তা সঠিক, তবে তাতে কিছু অসম্পূর্ণতা ছিল। মুক্তিযোদ্ধাদের অনেকেই সনদের প্রয়োজন বোধ করেননি। জিয়াউর রহমানের সময় নতুন তালিকা করা হয়, তাতে কিছু ভুয়া বা ছদ্মতাপস সনদ পান। এরশাদ সরকারের সময় দুবার মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা বাড়ানো হয় রাজনৈতিক স্বার্থে। প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দুইবারে আগাছার মতো বাড়তে থাকে মুক্তিযোদ্ধা।

আমার মনে আছে, এরশাদ সরকার যখন মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা বাড়ায় তখন সাবেক বিচারপতি দেবেশ ভট্টাচার্য, ডা. আলীম আল রাজী এবং আইনজীবী জমিরউদ্দিন এক আড্ডায় ওই কর্মের বিপদ সম্পর্কে বলছিলেন। তাঁদের বক্তব্য, এই কর্ম না থামালে ভবিষ্যতে সমস্যা হবে।

হীন স্বার্থে আমরা নিজেদের হেয় করতে পছন্দ করি। একবার কলকাতার এক অনুষ্ঠানে চা খাওয়ার সময় পশ্চিমবঙ্গের গভর্নর, বাংলাদেশের সাবেক প্রধান বিচারপতি মোস্তফা কামাল এবং বিশিষ্ট চিন্তাশীল লেখক ও অর্থনীতিবিদ অম্লান দত্তের সঙ্গে আলাপ হচ্ছিল। আমার দেশি ভাই একজন সেখানে উপস্থিত হয়ে অম্লান দত্তের সঙ্গে করমর্দন করে বললেন, ‘আমি বীর মুক্তিযোদ্ধা অমুক’। ড. দত্ত নীরস ও স্পষ্টভাষী মানুষ। তিনি তাঁর হাত থেকে নিজের হাত সরিয়ে নিয়ে বললেন, ‘নিজেকে নিজে বীর বলতে নেই।’

অম্লান দত্তের সঙ্গে ঢাকায় এবং কলকাতায় অনেকবার কথা হয়েছে। তিনি ছিলেন যুক্তিবাদী মানুষ। একদিন তিনি বললেন, ‘মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র করে আপনাদের দেশে একটা সুবিধাবাদী শ্রেণি গড়ে উঠেছে। স্বীকৃতি পাওয়া এক কথা আর সুবিধার জন্য লালায়িত হওয়া অন্য কথা। সত্যিকারের দেশপ্রেমিকেরা কখনো রাষ্ট্র থেকে সুবিধা নেয় না।’

আমরা যারা কাগজে লেখালেখি করি, তাদের কাছে মানুষ নানা রকম অভিযোগ করে চিঠি লেখেন। এখন টেলিফোনেও বলতে পারেন। মুক্তিযোদ্ধাদের নতুন তালিকা করা নিয়ে যা ঘটছে সে সম্পর্কে অনেকে আমাকেও জানিয়েছেন। সেসব অভিযোগ প্রকাশ্যে না বলাই ভালো। শুধু এইটুকু বলতে চাই, মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দলই এখন সরকারে। এই অনাচার এই সরকারই বন্ধ করতে পারে, যদিও তাতে তাদের স্বার্থের কিছুটা হানি ঘটবে। কিন্তু এই প্রবণতা যদি অব্যাহত থাকে, তাহলে জাতির মধ্যে, বিশেষ করে প্রশাসনে বিভক্তি বাড়বে। এই ছদ্মতাপসদের দাপটে সংহত জাতি গঠন বাধাগ্রস্ত হবে।

সৈয়দ আবুল মকসুদ: লেখক ও গবেষক।