ছাত্রলীগ, টিলাগড়ে খুন ও মহাভারতের মুষলপর্ব

ঢেঁকির মাথায় শুঁড়ের মতো যে মুগুর থাকে তাকে গ্রামগঞ্জের লোকে বলে ‘মোনাই’। ‘ভালো বাংলায়’ বলে মুষল। এককালে মুষলের ছ্যাঁচায় ধান থেকে চাল হতো। আজ সে ঢেঁকিও নেই, মুষলও নেই। তবে মৃত মানুষের মতো বিলুপ্ত মুষলও তার কর্ম রেখে গেছে। সেই কর্মের নাম ছ্যাঁচাকর্ম। এখনো তাই ভ্রাতৃঘাতী ছ্যাঁচাছেঁচির প্রসঙ্গ উঠলে মহাভারতের ‘মুষলপর্ব’ সবার আগে মনে আসে।

মুষলপর্বে দেখা যায়, দ্বারকায় যদু বংশের লোকজন, মানে যাদবেরা ভারি আমোদে ছিল। বিরোধী শিবিরের সবগুলোকে বহু আগে সাবাড় করে দিয়ে নিশ্চিন্ত মনে ছিল তারা। এলাকার একচ্ছত্র ক্ষমতা তাদেরই হাতে। বিরোধিতা তো দূরের কথা, সামান্য ট্যাঁ ফো করার মতোও কেউ নেই। পয়সাকড়ির অভাব নেই। আসমান বরাবর জিডিপি। ঘরে ঘরে বিল্ডিং। আনন্দ–সংগীতে তাদের দিন কাটে। সুখে থাকলে ভূতের তো না কিলানোর কথা না। তাই যাদবদেরও ভূতে কিলাতে শুরু করল।

অপজিশনের কাউকে না পেয়ে যাদবেরা নিজেরাই নিজেদের মধ্যে ভাগ হয়ে মারামারি লাগিয়ে দিল। তাদের প্রধান অস্ত্র হলো ঢেঁকির মোনাই বা মুষল। তাই দিয়ে এ মারল ওকে, ও মারল তাকে। মুষল হাতে নিজেরা নিজেরা মারামারি করে যদুবংশ নির্বংশ হয়ে গেল। মারাত্মক চিন্তার কথা, ছাত্রলীগের মধ্যে অতি ক্ষুদ্র চেহারা নিয়ে হলেও সেই সমগ্রবিনাশী মুষলপর্ব আবির্ভূত হচ্ছে।

সাত দশক আগে জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র তাঁর ‘মধুবংশীর গলি’-তে লিখেছিলেন, ‘নিজেরাই মারামারি করছি, ঘরে বাইরে মরছি।’ ছাত্রলীগ ক্রমেই সেই দশার দিকে যাচ্ছে। কদিন পরপরই খবর পাওয়া যাচ্ছে, অমুক জায়গায় কমিটি গঠন নিয়ে ছাত্রলীগের কর্মীদের মধ্যে মারামারি, তমুক জায়গায় তাঁরা অবরোধ করছেন, ভাঙচুর করছেন।

সর্বশেষ ঘটনা ঘটল সিলেটে। সেখানে গত বৃহস্পতিবার রাতে ছাত্রলীগের কর্মীদের মধ্যে বিরোধের জের ধরে ছুরির ঘায়ে অভিষেক দে নামের একজন মারা গেছেন। ছুরিবিদ্ধ হয়েছেন শুভ রায় ও সৈকত রায় নামের দুজন। শুভর বুকে এবং সৈকতের পায়ে ছুরি মারা হয়েছে। অভিষেককে মেরে ফেলার অভিযোগে আহত সৈকতকে আটক করেছে পুলিশ। শুভ ও সৈকতের ভাষ্যমতে, অভিষেকই প্রথমে তাঁদের ছুরি দিয়ে কুপিয়েছেন। পরে তাঁরা পাল্টা হামলা করেছেন এবং ছুরি মেরে অভিষেককে মেরে ফেলেছেন। নিহত ও আহত তিনজনই নগরের টিলাগড় এলাকায় জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক যুব ও ক্রীড়াবিষয়ক সম্পাদক রণজিৎ সরকারের অনুসারী ছাত্রলীগ কর্মী। এ নিয়ে গত এক দশকে শুধু টিলাগড়েই ‘মুষলপর্বে’ অর্থাৎ নিজেদের মধ্যে হানাহানিতে ছাত্রলীগের পাঁচ কর্মী খুন হলেন।

অন্যদিকে শুক্রবার চট্টগ্রাম নগরের ডবলমুরিং ও চান্দগাঁও থানা ছাত্রলীগের নতুন কমিটি বাতিলের দাবিতে সড়ক অবরোধ করেছিল ছাত্রলীগের একাংশ। এই দিন তাঁরা নগরের চৌমুহনী ও দেওয়ানহাট মোড়ে টায়ার জ্বালিয়ে সড়ক অবরোধ করেছিলেন। এতে অনেকক্ষণ সেখানে গাড়িঘোড়া চলতে পারেনি। নতুন কমিটিতে নিজেদের লোকজন পদ–পদবি ঠিকমতো না পাওয়ার কারণে তাঁরা এই সড়ক অবরোধ করেছিলেন। তাঁরা বলছিলেন, টাকাপয়সা খেয়ে নগর ছাত্রলীগের নেতারা অযোগ্য লোককে কমিটিতে ঢুকিয়েছেন। এমনকি বিরোধী দলের নেতা–কর্মীদের স্বজনদেরও কমিটিতে জায়গা করে দিয়েছেন। তাঁরা এই কমিটি বাতিলের পাশাপাশি নগর ছাত্রলীগের মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটি বাতিলেরও দাবি করেছেন।

বৃহস্পতিবার রাত ও শুক্রবার বিকেলে সিলেট ও চট্টগ্রামে যা ঘটেছে, তা সাধারণের বিবেচনায় অবশ্যই বিচ্ছিন্ন ঘটনা। কিন্তু একটু তলিয়ে দেখলে বোঝা যাবে এটি অন্তহীন অন্তর্বিরোধের একটি অধ্যায়মাত্র। এ রকম অসংখ্য অধ্যায় উন্মোচিত হচ্ছে। দেখা যাবে দুই পক্ষের সেনারা আসলে একই। একের মধ্যে থাকা দুই বড় ভাইয়ের দুই গ্রুপ অনুসারী। মুষলপর্বে এ রকমই হয়ে থাকে।

সিলেটে অভিষেকের সঙ্গে শুভ ও সৈকতের মারামারি লেগেছিল কয়েক দিন আগে। ঝগড়ার শুরু সরস্বতীপূজার চাঁদা ওঠানো এবং তার হিসাবপত্তর নিয়ে। সেই গন্ডগোলই পরে খুনোখুনিতে গড়াল। আপাতদৃষ্টিতে মনে হবে এই সংঘর্ষে রাজনীতির যোগ নেই, এটি নিছক স্থানীয় ক্ষমতার রেষারেষি। কিন্তু এই স্থানীয় ক্ষমতার রেষারেষির গভীরে আছে বৃহত্তর ক্ষমতার বলয়ে ঢোকার সুপ্ত লালসা।

মন্ত্রী-সান্ত্রিরা তো বটেই, সাধারণ মানুষও এসব ঘটনা দেখে তাচ্ছিল্যভরে বলে থাকেন: এ নিয়ে চিন্তার কী আছে? এ রকম তো কতই ঘটে! কিন্তু খেয়াল করলেই বোঝা যাবে, কোন গ্রুপের গায়ের জোর বেশি, কার কথায় এলাকা চলবে, তা প্রতিনিয়ত এই ধরনের ‘বিচ্ছিন্ন’ মারামারি ও ‘ছোটখাটো’ অবরোধের মধ্য দিয়েই সাব্যস্ত হয়ে চলে। এর মধ্য দিয়েই এক নেতা ও তাঁর অনুগামীরা ওপরে ওঠেন, অন্য মাতব্বর এবং তাঁর শাগরেদরা নামতে থাকেন।

ছাত্রলীগের ছোট-মাঝারি-বড়—এই তিন প্রকারের ক্ষমতার অধীশ্বরদের নিজেদের মধ্যে সংঘাতকে প্রশ্রয় দিয়ে চললে সেই সংঘাত উত্তরোত্তর উত্তেজিত হতে বাধ্য।

অভিযোগ আছে, এ মুহূর্তে ক্ষমতাসীন দলের আধিপত্যের চাপে অন্য দলগুলো হীনবল হয়ে আছে। এরপরও পাবলিকের নিষ্কৃতি নেই। মাঠে বিরোধীরা না থাকায় ছাত্রলীগসহ ক্ষমতাসীন দলের অন্য সংগঠনগুলোর মধ্যে এখন নানা গোষ্ঠী ও উপগোষ্ঠী পরস্পরের প্রতি তেড়ে আসছে। এতে আরেক মুষলপর্বের আভাস দেখা যাচ্ছে।

সারফুদ্দিন আহমেদ: লেখক ও সাংবাদিক।