ছিয়াত্তরে পা, আমাদের পঙ্কজদা

পঙ্কজ ভট্টাচার্য
পঙ্কজ ভট্টাচার্য

ষাটের দশকে সারা দেশে ২০ ছুঁই ছুঁই কিংবা সবে ২০ বছর পার করেছে—এমন একঝাঁক তরুণ দেশমাতৃকার আহ্বানে ছাত্র আন্দোলনে যোগ দেয়। একদল আওয়ামী লীগ, বিশেষত বঙ্গবন্ধুর অনুগত, অপর দল মেধাবী, সংস্কৃতিমনা অংশ শোষণমুক্তির স্বপ্ন দেখে কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে যুক্ত, প্রধানত মোহাম্মদ ফরহাদের ভাবশিষ্য। তখন পাকিস্তান আমলের চরম দুঃসময় চলছে। দেশে সামরিক শাসন, অধিকাংশ রাজনৈতিক নেতা কারাগারে কিংবা আত্মগোপনে, রাষ্ট্র পরিচালিত হচ্ছে সাম্প্রদায়িক ভাবাদর্শে, পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ প্রায় ঔপনিবেশিক শাসনে জর্জরিত। তখন ষাটের দশকের ছাত্র আন্দোলন বর্শাফলকের মতো দেশবাসীর আকাঙ্ক্ষাকে ধারণ করে সাহসী আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছে। তাদের প্রথম সারিতে ছিল চট্টগ্রাম থেকে সদ্য আসা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রনেতা পঙ্কজ ভট্টাচার্য।
প্রথম পরিচয় সম্ভবত ১৯৬২-এর ৩ ফেব্রুয়ারির ছাত্র মিছিলে, হাটখোলার মোড়ে পুলিশ লাঠিপেটা করেছে, ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়াচ্ছি, সামনে মোহাম্মদ ফরহাদ ও সাইফুদ্দিন আহমেদ মানিক, পেছনে পঙ্কজ ভট্টাচার্য, রেজা আলী, রনো, মেনন ও আমি। জুন মাসে আনুষ্ঠানিকভাবে সামরিক শাসনের অবসান করে পরোক্ষ নির্বাচনের বিধি রেখে সংবিধান ঘোষিত হলো, ছাত্র আন্দোলনে যতি এল, বামপন্থী ছাত্র আন্দোলন সংগঠিত করার সুযোগ ঘটল। ১৯৬২ সালের শেষ প্রান্তে পঙ্কজদার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা হলো স্বামীবাগে গোপন কনভেনশনে, আর সেটি নিবিড় হয়েছে ১৯৬৩-এর গোড়ার দিকে ফুলবাড়িয়া রেলওয়ে স্টেশনের নিকটবর্তী মাহবুব আলী ইনস্টিটিউটে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের জাতীয় সম্মেলনে। আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনে মতাদর্শগত চীন-রুশ দ্বন্দ্বের তখন প্রারম্ভিক কাল। সমঝোতা প্যানেলে সভাপতি বদরুল হক, সাধারণ সম্পাদক হায়দার আকবর খান রনো, ঢাকা থেকে সহসভাপতি মতিয়া চৌধুরী, রাশেদ খান মেনন, পঙ্কজ ভট্টাচার্য ও আমি। বাকিরা সবাই আজও রাজনীতির রজতপটের তারকা, আমি একমাত্র দলছুট। ষাটের দশকে এই দ্বন্দ্বটি প্রলম্বিত হয়েছে, পঙ্কজ ভট্টাচার্য একপর্যায়ে কার্যকরী সভাপতির পদ অলংকৃত করেছেন। তাঁর ও সহযোগীদের দৃঢ়চিত্ত অবস্থানের কারণে ছাত্র ইউনিয়নের ঐক্যবদ্ধ অবস্থানটি দৃশ্যমান রয়েছে, পাশাপাশি সারা দেশে ছাত্র সংসদের নির্বাচনের সমন্বয়ের সঙ্গে চলেছে কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আন্দোলনের কর্মসূচি।
আনুষ্ঠানিকভাবে চারটি ছাত্রসংগঠন মিলে কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হলেও মূল চালিকাশক্তি ছিল ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়ন। ১৯৬২ থেকে ’৬৬ অবধি কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদে ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে প্রধানত প্রতিনিধিত্ব করেছে প্রকাশ্যে বা নেপথ্যে শেখ ফজলুল হক মনি ও সিরাজুল আলম খান এবং ছাত্র ইউনিয়নের পক্ষ থেকে পঙ্কজ ভট্টাচার্য ও সাইফুদ্দিন আহমেদ মানিক। এই কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের বিচক্ষণ নেতৃত্বে আন্দোলন দেশবাসীর হৃদয় ছুঁয়েছে, পঙ্কজ ভট্টাচার্য ও অন্য নেতারা সারা দেশে কেবল ছাত্রসভা নয়, প্রায় সর্বত্র জনসভা করে গণতন্ত্র ও স্বায়ত্তশাসনের দাবিকে অগ্রসর করেছে। এই দীর্ঘ সময় পঙ্কজদাসহ সব ছাত্রনেতার বিরুদ্ধে হুলিয়া জারি হয়েছে এবং আমাদের স্থান হয়েছে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হোস্টেল, জগন্নাথ হল ও প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের আহসানউল্লাহ হলে। তবে আত্মগোপন অর্থ অলস জীবনযাপন নয়, ব্যস্ত সময় কাটে। প্রতিদিন সকালে তাঁর ও অন্যদের অবস্থান মধুর ক্যানটিনে, এমনকি মিছিলে আর প্রায় সারা রাত কাটে মোহাম্মদ ফরহাদের সঙ্গে পরের দিনের কর্মসূচি স্থির করায়। ইতিমধ্যে ১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধু ছয় দফা দাবি প্রচার করে জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক আন্দোলনের মহানায়কে পরিণত হয়েছেন। ছাত্রলীগ একক নেতৃত্বে আন্দোলন পরিচালনায় আগ্রহী হয়ে উঠেছে। ১৯৬৫ সালে ছাত্র ইউনিয়নে ভাঙন ঘটেছে। তবে ছাত্রলীগসহ পঙ্কজদা ও মানিক ভাইয়ের বিচক্ষণ নেতৃত্বে ১১ দফা প্রণীত হয়েছে এবং উনসত্তরের গণ–অভ্যুত্থান এবং ৬ দফা ও ১১ দফার মিলিত সংগ্রাম দেশকে মুক্তিযুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে দিয়েছে। এ সময়কালে জাতীয় মূলধারাকে অগ্রসর করার ক্ষেত্রে সবাইকে নিয়ে কাজ করার অসাধারণ ক্ষমতার অধিকারী পঙ্কজ ভট্টাচার্য বিশেষ অবদান রেখেছেন।
মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর একসঙ্গে দেশত্যাগে বাধ্য হয়েছি। তিনি ১৯৭০ সালে ন্যাপে যোগ দেন এবং মুক্তিযুদ্ধে ন্যাপের পক্ষ থেকে রাজনৈতিক এবং ন্যাপ-সিপিবি ছাত্র ইউনিয়নের গেরিলা বাহিনী গড়ে তোলার ক্ষেত্রে প্রধান সংগঠকের ভূমিকা পালন করেন। স্বাধীনতার পর থেকে ১৯৯৩ সাল অবধি পঙ্কজ ভট্টাচার্য ন্যাপের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন এবং তিনি পঁচাত্তরের মর্মান্তিক ঘটনার পর ১১ দল ও ১৫ দলের পক্ষ থেকে সামরিক সরকারদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনে শামিল হন। ১৯৯৩ সালে পঙ্কজ ভট্টাচার্য ন্যাপ ত্যাগ করে গণফোরামের নেতৃত্বে স্থান করে নেন, তবে প্রত্যাশিত ফল লাভ না করায় বেশ কিছুদিন রাজনৈতিক কার্যক্রমে নিষ্ক্রিয় থাকেন। কয়েক বছর ধরে তিনি সব বামপন্থীকে ঐক্যবদ্ধ করার প্রয়াসে ঐক্য ন্যাপ গড়ে তুলতে সচেষ্ট রয়েছেন। অবশ্য প্রায় দেড় দশক ধরে পঙ্কজ ভট্টাচার্য দেশের সুবিধাবঞ্চিত মানুষের পাশে দাঁড়ানোর প্রত্যয়ে অধিকতর মনোযোগী হয়ে উঠেছেন। ক্ষমতাসীন ও সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর প্রশ্রয়ে যখনই দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে অমুসলিম ও আদিবাসীরা নিগ্রহের শিকার হন, পঙ্কজ ভট্টাচার্য তঁাদের কাছে ছুটে যান, প্রতিকারের প্রয়াসী হন। বয়স ও অসুস্থতাও তাঁকে নিবৃত্ত করতে পারে না।
পঙ্কজ ভট্টাচার্য একজন আপাদমস্তক রাজনীতিবিদ। কিছু বিরল ব্যতিক্রম ছাড়া দেশে রাজনীতিবিদদের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল নয়—সাধারণ মানুষ তাদের বিষয়ে নিস্পৃহ, শ্রদ্ধা করে না, কারণ রাজনীতিবিদদের নানা হিসাব-নিকাশে চলার বাধ্যবাধকতায় কৌশলের কাছে প্রায়ই নীতি পরাস্ত হয়। বাংলাদেশ কোনো ব্যতিক্রম নয়, অধিকাংশ উন্নয়নশীল দেশে এমনকি ভারতেও রাজনীতিবিদ, প্রশাসন ও অপরাধজগতের আঞ্চলিকভাবে দুষ্টচক্র গড়ে ওঠে, যার ফলে রাজনীতি দূষিত হয়। পঙ্কজ ভট্টাচার্য সমাজতন্ত্রে আজও বিশ্বাসী, তবে মূলধারার অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের মূল ধারাকে কলুষমুক্ত করার কাজে তিনি একনিষ্ঠ এবং তিনি এই মূলনীতি থেকে কখনো বিচ্যুত হননি এবং এ জন্য ক্ষমতায় স্থান করে নেওয়ার প্রলোভন অনায়াসে পরিত্যাগ করতে দ্বিধাগ্রস্ত হননি। সে কারণে এই নির্লোভ অনাড়ম্বর মানুষটি সবার কাছে গ্রহণযোগ্য রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের মর্যাদা লাভ করেছেন।
আমি তাঁর সুস্বাস্থ্য ও দীর্ঘায়ু কামনা করি।
ডা. সারওয়ার আলী: ট্রাস্টি, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর।