ছেলের জন্য হাহাকার কেন

গত ২০ জানুয়ারি প্রথম আলোসহ দেশের বেশ কয়েকটি পত্রিকায় মোটামুটি গুরুত্বসহকারে একটি খবর ছাপা হয়। খবরটি এ রকম, রাজশাহী নগরের একটি মাতৃসদনে জন্ম নেওয়ার ছয় ঘণ্টা পর এক নবজাতক চুরি হয়েছে। ওই মাতৃসদনের একজন মাঠকর্মীর সহায়তায় এক নারী শিশুটিকে কৌশলে চুরি করে নিয়ে পালিয়ে যান। ২৮ জানুয়ারির খবর হচ্ছে, রাজশাহী সিটি করপোরেশনের সিসি ক্যামেরা থেকে পাওয়া একটি ছবির সূত্র ধরে পুলিশ ওই চোরকে গ্রেপ্তার এবং নবজাতককে উদ্ধার করেছে। শিশুচোরের পরিচয় পেয়ে হতবাক হওয়ার দশা। তাঁর নামধাম এখানে না-ইবা বললাম। যদিও পত্রিকায় খবর পড়ে অনেকেই তাঁর পরিচয় এখন জানেন। তিনি উচ্চশিক্ষিত। একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক। স্বামী পেশায় চিকিৎসক। সমাজের যে স্তরে তাঁর বসবাস, শিশু চুরির মতো একটি ঘৃণ্য কাজ কেন তিনি করতে গেলেন, সেটা একটা বড় প্রশ্ন। পত্রিকান্তরে জানতে পারলাম,
ওই নারীর ছয় বছর বয়সের একটি কন্যাসন্তান আছে। স্বামী ও শ্বশুরবাড়ির কাছ থেকে ছেলেসন্তান হওয়ার ব্যাপারে তাঁর ওপর চাপ ছিল। তাই তিনি ওই নবজাতককে চুরি করেছেন।
এ রকম ছেলেসন্তানের জন্য নবজাতক চুরির আরও বহু ঘটনা অতীতে ঘটেছে। চুরি যাওয়া শিশুদের অনেকে মায়ের বুকে ফিরতে পারে। অনেকের আর ফেরা হয় না। কিন্তু একজন উচ্চশিক্ষিত নারী যখন এ কাজ করেন, তখন বুঝতে হবে সমস্যাটা কত গভীর হয়ে আমাদের সমাজে গেড়ে বসেছে। এ থেকে যেন মুক্তি নেই।
হায়রে ছেলেসন্তান! এই ছেলে ছেলে করে আমাদের দেশে কত নারীর জীবনে যে দুঃখের অমানিশা নেমে এসেছে, কত সংসার যে ভেঙেছে, তার কোনো ইয়ত্তা নেই। যেভাবেই হোক ছেলে চাই-ই চাই। সব শিশু বা নবজাতক চুরির ঘটনা এ কারণে ঘটছে, বিষয়টি এমন না হলেও অনেক চুরির ঘটনা যে ছেলেসন্তান পাওয়ার জন্যই ঘটছে, তা তো চোখ বন্ধ করেই বলা যায়।
অন্যান্য কারণও আছে শিশু চুরির পেছনে। কেউ শিশু চুরি করে ভিক্ষাবৃত্তিতে নামায়, কেউ বিদেশে পাচার করে, কেউ শিশুর অঙ্গপ্রত্যঙ্গ বিক্রি করার জন্য শিশু চুরি করে। নিঃসন্তান দম্পতিরাও সন্তান পাওয়ার জন্য অন্যের শিশু চুরি করে। হাসপাতালে হাসপাতালে গড়ে উঠেছে শিশু চুরির সিন্ডিকেট চক্র। শিশু চুরিতে তারা বিভিন্ন লোককে সহায়তা করে থাকে। বহুদিন আগে একটি পত্রিকায় পড়েছিলাম এসব শিশুচোর সিন্ডিকেট নবজাতক চুরি করার জন্য নিঃসন্তান দম্পতি বা যারা ছেলে চায়, তাদের কাছ থেকে অগ্রিম অর্থ নেয়। তারপর চাহিদামতো বাচ্চা চুরি করে এনে দেয়। সিন্ডিকেট সদস্যদের পেছনে প্রভাবশালী মহল সম্পৃক্ত থাকায় থানা-পুলিশ করেও সন্তানহারা অভিভাবকেরা খুব একটা সুবিধা করতে পারেন না। চিন্তা করা যায় এমন একটি পরিস্থিতির কথা!
তবে কথা হচ্ছে, কেন ছেলেসন্তানের জন্য এই হাহাকার? কী আছে ছেলেসন্তানের মধ্যে? একটা সময় ছিল বাংলাদেশের গোটা অর্থনীতি ছিল কৃষিনির্ভর। পরিবারের পুরুষ সদস্যদের মূল জীবিকা ছিল চাষবাস করা। যার ঘরে যত বেশি ছেলেসন্তান থাকত, তার তত বেশি লাভ হতো। সবাই মিলে কাজ করে অধিক ফসল উৎপাদন করত। আর বৃদ্ধ বয়সে বাবা-মায়েরা ছেলের উপার্জনের ওপরই নির্ভরশীল হয়ে পড়তেন। ছেলে না হলে বুড়ো বয়সে ভাত পাবেন না—বাবা-মায়ের এমন একটি ধারণা প্রচলিত ছিল। আবার ছেলেসন্তান না হলে বংশরক্ষা হবে কী করে! কাজেই তখন ছেলেসন্তান হলেই বেশি খুশি হতো। মেয়েসন্তান ছিল অনাকাঙ্ক্ষিত। একটি ছেলের জন্য পরপর পাঁচটি বা সাতটি মেয়ের বাবা-মা হয়েছেন এমন নজির বহু রয়েছে।
মেধা, যোগ্যতা ও দক্ষতা যেখানে নারী ও পুরুষ এখন পাল্লা দিয়ে চলছে, সেই যুগেও বাবা-মায়েদের ছেলেসন্তানের জন্য এভাবে হেদিয়ে মরতে দেখলে সত্যিই কষ্ট লাগে। মানসিকতা কি আর তাহলে পাল্টাবে না? সব ছেলেসন্তানই কি ভালো হয়? সব ছেলে কি তার পরিবারের প্রতি দায়িত্বশীল? সব ছেলেই কি বৃদ্ধ বয়সে বাবা-মাকে দেখে? মেয়েসন্তানরা কি তাদের বাবা-মাকে দেখে না? নিজেদের চারপাশে তাকালে তো এ রকম উদাহরণ কম দেখা যাবে না। তাহলে কিসের এত ভাবনা?
ছেলে জন্ম না দেওয়ায় অতীতে অনেক নারী নানাভাবে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন এবং এখনো হচ্ছেন। অনেক মেয়েকে তাঁদের স্বামীরা তালাক দিয়েছেন। অনেক মেয়ে সতিনের সংসার করছেন। এমনকি অনেকে খুনও হয়েছেন। যদিও সন্তান ছেলে না মেয়ে হবে তার জন্য কোনোভাবেই নারীরা দায়ী নন। রাজশাহীর হাসপাতাল থেকে নবজাতক চুরি করা ওই নারীর স্বামী তো একজন চিকিৎসক। তিনি নিশ্চয়ই জানেন, সন্তান ছেলে বা মেয়ে হওয়ার পেছনে শুধু মায়ের এককভাবে কোনো ভূমিকা নেই। তাহলে ছেলেসন্তানের জন্য কেন স্ত্রীর ওপর চাপ প্রয়োগ করা? সবাই কি তাহলে জ্ঞানহারা হয়ে গেল?
এখন সময় হয়েছে এসব মানসিকতা পাল্টানোর। তা না হলে ছেলেসন্তানের জন্য এ রকম শিশু চুরি হয়তো আরও অনেক হবে। খালি হবে অনেক মায়ের বুক। কিন্তু এ রকম তো চলতে পারে না। সন্তান তো সন্তানই। বাবা-মায়ের কাছে ছেলে এবং মেয়ে সব সন্তানের সমান গুরুত্ব থাকা উচিত। সমাজে তো নারী-পুরুষ উভয়েরই প্রয়োজন রয়েছে। শুধু ছেলেই যদি হবে তাহলে পরবর্তী প্রজন্ম জন্ম নেবে কী করে। সবাইকে এই সহজ সত্যটা বুঝতে হবে। সন্তান ছেলে বা মেয়ে হোক, তাকে আদর্শ মানুষ হিসেবে গড়ে তোলাই সব বাবা-মায়ের লক্ষ্য হওয়া উচিত।
রোকেয়া রহমান: সাংবাদিক।