ছেলেশিশুদের যৌন নির্যাতন নিয়ে নীরবতা ভাঙুক

‘শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিশু যৌন নির্যাতন বন্ধে করণীয়’ শীর্ষক আলোচনার আয়োজন করেছিল মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন। ২০২১ সালের এপ্রিলে এই অনুষ্ঠানে বক্তারা বলেন যে মেয়েশিশুদের মতো ছেলেশিশুরাও যৌন নির্যাতনের শিকার হচ্ছে, কিন্তু বিষয়টা নিয়ে খুব একটা আলোচনা হয় না। এ বছর জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ২০ জন ছেলেশিশু নির্যাতিত হয়েছে বলে জানানো হয়। পাশাপাশি বলা হয় যে বাস্তবে এই সংখ্যা আরও বেশি।

রিপোর্টটি পড়তে পড়তে মনে পড়ে গেল কানাডীয় তারকা হকি খেলোয়াড় শেলডন কেনেডির লেখা হোয়াই আই ডিডেন্ট সে অ্যানিথিং বইটির কথা। ১৯৯৬ সালে শেলডন কেনেডি তাঁর সাবেক হকি কোচ গ্রাহাম জেমসের দ্বারা ৩০০ বারের বেশি সময় ধরে যৌন নির্যাতনের শিকার হওয়ার বিষয়ে পুলিশের কাছে অভিযোগ করেন। এরপর কানাডীয় হকি জগতে ছেলেদের যৌন নির্যাতন সবার নজরে আসে এবং এ নিয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি পায়। তিনি এই বিষয়ে নীরবতা ভাঙার পর অনেকে পুরুষ কোচের বিরুদ্ধে যৌন নির্যাতনের অভিযোগ করার সাহস পান। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তারা শৈশব-কৈশোরে নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন। কানাডায় শিশু সুরক্ষাবিষয়ক এক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে শেলডন কেনেডির বক্তৃতা শুনেছিলাম। যৌন নির্যাতন প্রতিরোধে এবং নির্যাতনের শিকার ব্যক্তিদের সহায়তায় তিনি নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন।

বাংলাদেশে ছেলেশিশুদের যৌন নির্যাতনে আইনি পদক্ষেপ ও বিচার নিয়ে অস্পষ্টতা আছে। এটি দূর করার পাশাপাশি যৌন নির্যাতনকারীদের দ্রুত বিচারের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। মা-বাবা কিংবা অভিভাবকদের উচিত ছেলে ও মেয়েশিশুকে বুঝিয়ে বলা যে কেউ যদি তার সঙ্গে এমন আচরণ করে যাতে সে অস্বস্তিবোধ করে, তাহলে সে ‘না’ বলতে পারে। এমনকি সেই ব্যক্তি যদি শিশুর কাছের কেউ হন তবু

অনেকেই মনে করেন, শিশুরা অপরিচিত ব্যক্তিদের দ্বারা নির্যাতনের শিকার হয় এবং শুধু মেয়েশিশুদের ক্ষেত্রেই এটি ঘটে। বিশ্বের নানা দেশের অভিজ্ঞতা থেকে আমরা জানি যে ছেলে ও মেয়ে উভয়েই যৌন নির্যাতনের শিকার হয়। এ–সংক্রান্ত বেশির ভাগ ঘটনা অপ্রকাশিত থেকে যায়। ছেলেদের নির্যাতিত হওয়ার ঘটনা প্রকাশিত হয় আরও কম। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বেশ কিছু গবেষণা থেকে জানা যায় যে প্রতি ছয়জন পুরুষের মধ্যে কমপক্ষে একজন শৈশবে বা প্রাপ্তবয়স্ক হিসেবে যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। ধারণা করা হয়, প্রকৃত সংখ্যা এর চেয়ে বেশি। (তথ্যসূত্র <https:// 1 in 6. org/>)

বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, পরিবার, কর্মক্ষেত্র, খেলা বা বিনোদন–সংক্রান্ত নানা স্থানেই ছেলেরা যৌন নির্যাতনের শিকার হয়। সাধারণত আত্মীয় বা পরিচিত এবং শিশুদের চেয়ে যারা বড় এবং শক্তিশালী তাদের দ্বারাই নির্যাতন ঘটে। শিক্ষক, খেলার কোচ, ধর্মীয় বা সামাজিক নেতা, জ্ঞাতি ভাইবোন বা কোনো সফল ব্যক্তি যাকে শিশুরা সমীহ করে ইত্যাদি অনেকের দ্বারাই ছেলেশিশুরা নির্যাতিত হতে পারে। তারা নানাভাবে শিশুর বিশ্বাসভাজন হয়। শিশুদের প্রতি মনোযোগ দেখায়। কখনোবা বিশেষ সুবিধা, উপহার বা অন্য কোনো প্রতিশ্রুতি দেয়। এভাবে তারা শিশুদের কাছাকাছি এসে তারপর নির্যাতন করে। অনেক ক্ষেত্রে নির্যাতনের ঘটনাটি বুঝতেই শিশুদের সময় লেগে যায়; তাদের মাঝে দ্বিধা কাজ করে। বোঝার পরও তারা প্রকাশ করতে পারে না নির্যাতনকারীর ভয়ে। অনেকে মনে করে কেউ তাদের বিশ্বাস করবে না অথবা নির্যাতিত হওয়ার জন্য তাদের দোষী করা হবে। ফলে অনেক শিশু বছরের পর বছর নীরবে বারবার নির্যাতিত হয়। ঠিক এই ঘটনাই ঘটেছিল শেলডন কেনেডির জীবনে।

যৌন নির্যাতনের অভিজ্ঞতার ফলে ছেলেশিশু ও পুরুষদের জীবনে দীর্ঘ মেয়াদে নানা ধরনের সমস্যা হতে পারে। এর মধ্যে আছে পোস্ট-ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিজঅর্ডার, হতাশা, মদ্যপান, মাদকাসক্তি, আত্মহত্যার চিন্তা ও চেষ্টা, অন্তরঙ্গ সম্পর্কে সমস্যা, আত্মবিধ্বংসী আচরণ, বিষণ্নতা, রাগ, সহিংসতা, পড়াশোনা বা পেশাগত জীবনে অসফল হওয়া।

নারী ও পুরুষের কাছে সনাতন সামাজিক প্রত্যাশার (জেন্ডার স্টেরিওটাইপ) কারণে দুজনই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অনেক পুরুষের মধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ আচরণ (যেমন ধূমপান বা মদ্যপান, জোরে গাড়ি চালানো, একাধিক যৌন সম্পর্ক স্থাপন) দেখা যায়, যা তাদের জীবনে ক্ষতির কারণ হয়ে ওঠে। এর মূলে রয়েছে পৌরুষত্ব সম্পর্কে প্রচলিত ধারণা, যেখানে তাদের শারীরিক ও মানসিকভাবে ‘শক্তিশালী’ হিসেবে মনে করা হয়। পরিবার, সমাজ, মিডিয়া নানাভাবে এই তথ্যটি দিতে থাকে। শৈশব থেকেই ছেলেদের কান্না বা অনুভূতির প্রকাশকে নিরুৎসাহিত করা হয়, যা তাদের জন্য নেতিবাচক। সমাজ আশা করে যে পুরুষেরা নিজেদের রক্ষা করতে সক্ষম হবে। নির্যাতিত হওয়াকে ছেলেদের দুর্বলতা বলে মনে করা হয়। এই সব কিছু মিলিয়েই ছেলেরা নির্যাতিত হলে সাধারণত প্রকাশ করতে পারে না।

বাংলাদেশে ছেলেশিশুদের যৌন নির্যাতনে আইনি পদক্ষেপ ও বিচার নিয়ে অস্পষ্টতা আছে। এটি দূর করার পাশাপাশি যৌন নির্যাতনকারীদের দ্রুত বিচারের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। মা-বাবা কিংবা অভিভাবকদের উচিত ছেলে ও মেয়েশিশুকে বুঝিয়ে বলা যে কেউ যদি তার সঙ্গে এমন আচরণ করে যাতে সে অস্বস্তিবোধ করে, তাহলে সে ‘না’ বলতে পারে। এমনকি সেই ব্যক্তি যদি শিশুর কাছের কেউ হন তবু। সেই সঙ্গে এটাও বলা প্রয়োজন যে এমন কিছু ঘটলে শিশুরা বড়দের জানাবে। শিশুটি কোনো ব্যক্তিকে এড়িয়ে চললে মা-বাবাকে তার কারণ অনুসন্ধানের চেষ্টা করতে হবে এবং কোনোভাবেই শিশুটিকে সেই ব্যক্তির সঙ্গে স্বাভাবিক যোগাযোগ রাখতে বাধ্য করা যাবে না। শিশুদের বলতে হবে, কেউ যদি গোপনে তাদের কোনো উপহার দেয় তবে সেটা পরিবারের বড়দের জানাতে হবে এবং এই উপহারের বিনিময়ে সে কোনো কিছু করতে বাধ্য নয়।

নারীত্ব এবং পৌরুষসংক্রান্ত যেসব ধারণা নারী-পুরুষ উভয়ের জন্য ক্ষতিকর, তা থেকে তাদের মুক্ত করা প্রয়োজন। মা-বাবা ও পরিবারের দায়িত্ব ছেলে এবং মেয়েশিশুদের এমনভাবে বড় করা, যাতে তারা নারী ও পুরুষের কাছে প্রত্যাশিত আচরণের সংকীর্ণ গণ্ডিতে আবদ্ধ না হয়ে পরিপূর্ণ মানুষ হিসেবে গড়ে ওঠে। নারী ও পুরুষের ভূমিকা নিয়ে ইতিবাচক সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি তৈরিতে সংবাদমাধ্যম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। এসবের ফলে যৌন নির্যাতনের শিকার হলে ছেলেরা প্রকাশ করতে পারবে এবং সমাজে ছেলেদের নির্যাতন নিয়ে নীরবতা ভাঙা এবং তাদের রক্ষা করার জন্য পদক্ষেপ নেওয়া সম্ভব হবে।

লায়লা খন্দকার উন্নয়নকর্মী