জঙ্গিবাদ আছে, জঙ্গিবাদ নেই

বাংলাদেশে জঙ্গিবাদ আছে নাকি নেই তা অনেক পুরোনো বিতর্ক। ১৯৯৯ সালে উদীচী সম্মেলনে, ২০০১-এ রমনা বটমূলে, ২০০৪-এ তৎকালীন বিরোধী দল আওয়ামী লীগের সভায়, এভাবে একের পর এক বোমা হামলায় যখন মানুষ মরছিল, তখনো দেশে জঙ্গিবাদ ছিল না। ২০০৩-এ যখন বাংলা ভাইয়ের ভয়াবহ অত্যাচারের কথা পত্রিকায় দেখলাম, গাছের সঙ্গে মানুষের উল্টো ঝোলানো লাশের ছবির সঙ্গে, তখনো বলা হলো তা ‘মিডিয়ার সৃষ্টি’ অতিরঞ্জিত খবর। প্রশাসন এভাবে জঙ্গিবাদের অস্তিত্বের কথা যখন অস্বীকার করে আসছিল, তখন এসব জঙ্গি গোষ্ঠী যেন নিজেদের শক্তি-সামর্থ্যের প্রমাণ দেখাতে দেশব্যাপী একই সঙ্গে ক্রমিক বোমা হামলার ঘটনা ঘটাল।
আন্তর্জাতিক চাপের মুখে যখন এই উগ্রবাদী জঙ্গিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া শুরু হলো, তখন আমরা দেখলাম ‘মিডিয়ার সৃষ্টি’ এই জঙ্গিদের শিকড় কত দূর বিস্তৃত হয়েছে। এসব সংগঠনের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের মধ্যে আশির দশকের আফগান যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী ও সেখান থেকে ফেরত আসা জঙ্গিরাও রয়েছে। কখন ও কীভাবে দেশের এতগুলো মানুষ প্রশিক্ষণ নিল, আফগানিস্তানে গিয়ে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে আবার দেশে ফিরে এল, তা কারও জানা নেই! দেশের মধ্যে তারা সংগঠিত হলো, প্রশিক্ষণ নিল কিন্তু কেউ তার খবর রাখল না। নানা কায়দায় উগ্রবাদী আদর্শ দেশের মানুষের মাঝে ছড়িয়ে দেওয়া শুরু হলো, বিশ্ববিদ্যালয়ে পোস্টার ও লিফলেট বিতরণ হলো, ঘরে ঘরে দাওয়াত চলল, তার কোনো কিছুই তখনকার সরকার বা বিরোধী দলগুলো বিবেচনায় নিল না। দেশে জঙ্গিবাদের অস্তিত্ব অস্বীকার করার আর যখন উপায় ছিল না তখন শুরু হলো শক্ত হাতে দমন। উগ্রবাদী মতাদর্শের বিভিন্ন দলকে নিষিদ্ধ ঘোষিত করা হলো। তাতে দলগুলো ভেঙে ছত্রভঙ্গ হয়ে দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়ল। ২০০৫-পরবর্তী তেমন কোনো বোমা হামলা বা জঙ্গিবাদের ঘটনা না ঘটায় আমরাও স্বস্তি পেলাম, দেশ থেকে জঙ্গিবাদ বুঝি চলেই গেল!
বিশ্বজুড়ে যে ধারণাকে জঙ্গিবাদ নাম দেওয়া হচ্ছে, তা কিছু মানুষের রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক স্বার্থ হলেও, ধর্মীয় আদর্শ তার পুঁজি। সেই আদর্শ কারও কাছে যতই উগ্র, অনৈতিক বা অযৌক্তিক মনে হোক না কেন, তা কিছু মানুষের ধর্ম বা বিশ্বাস। মানুষের ধর্মকে কখনোই শক্তি দিয়ে দমানো সম্ভব নয়। কেবল নিষিদ্ধ করে বা নেতা-কর্মীদের ফাঁসি বা কারাদণ্ড দিয়ে কখনোই কোনো আদর্শের হত্যা করা সম্ভব নয়।
২০১৩ সালে হেফাজতে ইসলামের হাজার হাজার অনুসারী নিয়ে ‘ঢাকা ঘেরাও’ কর্মসূচি অবাক করে জানান দেয় বাংলাদেশে উগ্রবাদী আদর্শের শক্তি-সামর্থ্যের বিষয়টি। সরকার হেফাজতে ইসলামের সঙ্গে বর্তমানে একটি শান্তিপূর্ণ ও সমঝোতামূলক সহাবস্থানে আছে। তবে এই সংগঠনের ডাকে মাদ্রাসাভিত্তিক এত ছাত্রের সমাগম হওয়ার বিষয়টিকে গুরুত্বের সঙ্গে না নিয়ে উপায় নেই। তারা কোন আদর্শের ভিত্তিতে তাদের এই বিশাল সমর্থনকারীদের পরিচালনা করছে, তা আমাদের অজানা। আগের নিষিদ্ধ দলগুলো নতুন নেতৃত্বে নতুন নাম নিয়ে তৎপরতা শুরু করেছে। এই দলগুলো ২০১৩ সাল থেকে ব্লগার, প্রকাশক, ব্যাংকার, পীর, বিদেশি নাগরিক, হোমিও ডাক্তার, অধ্যাপক, ক্ষৌরকার, সমকামী অধিকারকর্মী হত্যাসহ বিভিন্ন ধর্মীয় স্থাপনায় হামলা চালিয়েছে। আবারও সরকারের তরফ থেকে একই কথা, দেশে কোনো জঙ্গিবাদ নেই, আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠন ইসলামিক স্টেট বা আইএসের সঙ্গে দেশের সন্ত্রাসী দলগুলোর কোনো যোগসাজশ নেই।
আইএসের উত্থান ইরাকের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের সুযোগেই। ইরাকে যেখানে সাদ্দামের পতনের পর শিয়া, সুন্নি ও কুর্দিরা নিজেদের মাঝে ক্ষমতা দখলের সংগ্রামে ব্যস্ত, তখনই আইএস তাদের ভিত শক্ত করে। ১ হাজার ৩০০ যোদ্ধা নিয়ে আইএসের পক্ষে মসুল দখল সম্ভব হয়েছিল মানুষের সঙ্গে ইরাক সরকারের দূরত্ব, অবিশ্বাস, বিভাজিত সমাজ ও দুর্নীতির কারণে। এভাবেই আইএস শক্তিশালী হতে পেরেছে সিরিয়ায়, সেখানে চলতে থাকা গৃহযুদ্ধের সুবাদে। সিরিয়ায় আইএস সুযোগ নিচ্ছে বিভাজিত আন্তর্জাতিক স্বার্থবাদী রাজনীতিরও।

>এখন ইসলামি জঙ্গিদের আফগানিস্তান বা সিরিয়ায় যুদ্ধ করতে বা সামরিক প্রশিক্ষণ নেওয়ার দরকার ফুরিয়ে গেছে। ঘরে বসে ইন্টারনেটের মাধ্যমে তারা দলে দলে বা যে যার অবস্থান থেকে উদ্বুদ্ধ হয়, ধারণা গ্রহণ করে ও নিজের অঞ্চলেই তার প্রকাশ ঘটায়

এ ধরনের উগ্র আদর্শবাদী দলগুলোর কোনো রাষ্ট্র বা সীমানা নেই, তবে এদের ব্যাপ্তি বিশ্বব্যাপী। এরা দুভাবে কাজ করে: ১. প্রচলিত আদর্শকে চ্যালেঞ্জ করার জন্য উন্নত রাষ্ট্রগুলোতে হামলা করে তাদের অস্তিত্বের জানান দেয়, ২. বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে নিজেদের অবস্থান জোরদার করা বা ঘাঁটি গাড়া। এদের উদ্দেশ্য বর্তমান রাষ্ট্রব্যবস্থা ভেঙে তাদের আদর্শ প্রতিষ্ঠা করা। এদের অবস্থান সরকার ও জনগণের মাঝে। যেখানে এই দুই সত্তার মাঝে দূরত্ব যত বেশি, সেখানেই এরা বেশি শক্তিশালী। যেখানে ক্ষমতার ভারসাম্য নেই, মুক্ত গণমাধ্যম নেই, প্রশাসন জনস্বার্থে কাজ না করে ব্যক্তি বা দলবিশেষের জন্য কাজ করে, যেখানে আইনের শাসন নেই, মানুষ বিচার পায় না, জনগণ প্রতিনিয়ত নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতে থাকে, জনগণ সরকারের ওপর থেকে বিশ্বাস হারিয়ে ফেলে, সেখানেই এমন উগ্রবাদী আদর্শ ঘাঁটি গাড়তে থাকে।
আইএসকে এখন আর কোনো একটি একক দল হিসেবে বিবেচনা করার সুযোগ নেই। আইএস তার ধারণাকে দুনিয়াজুড়ে ছড়িয়ে দিতে পেরেছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ঔপনিবেশিক শক্তিগুলো অন্য দেশে নিজেদের প্রত্যক্ষ উপস্থিতি বজায় রাখার অবস্থান থেকে সরে আসে। নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখার কৌশল হিসেবে বেছে নেয় রাজনৈতিক আদর্শ ও ধারণাকে। আইএসও একইভাবে কাজ করে। এখন ইসলামি জঙ্গিদের আফগানিস্তান বা সিরিয়ায় যুদ্ধ করতে বা সামরিক প্রশিক্ষণ নেওয়ার দরকার ফুরিয়ে গেছে। ঘরে বসে ইন্টারনেটের মাধ্যমে তারা দলে দলে বা যে যার অবস্থান থেকে উদ্বুদ্ধ হয়, ধারণা গ্রহণ করে ও নিজের অঞ্চলেই তার প্রকাশ ঘটায়। এভাবে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে, বিভিন্ন সমাজে আইএসের ধারণা ছড়িয়ে পড়ছে। বাংলাদেশে ‘আইএস’ থাক বা না থাক তাদের আদর্শ ও ধারণাকে কার্যকর করতে কোনো সমস্যা হওয়ার কথা নয়। ফলে বাংলাদেশে সাম্প্রতিক সময়ে ঘটে যাওয়া হত্যাকাণ্ডগুলোর দায় আইএস স্বীকার করুক বা না করুক, এর সঙ্গে সরাসরি জড়িত থাক বা না থাক আমাদের শঙ্কামুক্ত হওয়ার সুযোগ নেই।
তাই সরকার যতই বলুক দেশে আইএস নেই, দেশের গড়ে ওঠা সন্ত্রাসী দলগুলোর সঙ্গে আইএসের যোগসাজশ নেই, তা কেবলই বাস্তবতা থেকেই আমাদের দূরে সরিয়ে রাখবে। এ ধরনের অস্বীকার বরং খুনিদের আরও শক্তিশালী করবে। সরকার যখন মন্তব্য করে দেশে সমকামিতা নিষিদ্ধ ও দণ্ডনীয় অপরাধ, কিংবা মুক্তচিন্তার নামে কেউ কারও ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করলে তার দায় সরকার নেবে না, তা কেবলই এমন খুনিদের সমর্থন দেয়। বাড়িতে এসে যখন খুন করে চলে যায়, খুনি ধরা পড়ে না আর সরকারের তরফ থেকে বলা হয়, ‘ঘরে ঘরে মানুষের বেডরুম পাহারা দেওয়া সরকারের কাজ না’, তখন জনমনে নিরাপত্তাহীনতার বোধটিই আরও জোরালো হয়, সরকারের প্রতি মানুষের আস্থা কমতে থাকে। আর এরই সুযোগ নেয় উগ্রবাদী দলগুলো।
এ ধরনের সংগঠনকে শুধু নিষিদ্ধ করে ফল পাওয়া যায় না। নিষিদ্ধ করা মানে অন্য নামে অন্যভাবে ফিরে আসা। উগ্রবাদী আদর্শের বিরুদ্ধে লড়াই কেবল অন্য আদর্শ দিয়েই সম্ভব। আর তা সম্ভব জনগণ ও সব রাজনৈতিক দলকে সম্পৃক্ত করার মাধ্যমে ও সর্বোপরি অন্তর্ভুক্তিমূলক একটি আদর্শগত নীতি গ্রহণ ও তার প্রতিফলনের মধ্য দিয়ে। তার জন্য দরকার সরকার ও জনগণের মধ্যেকার দূরত্ব ও অবিশ্বাস ঘোচানো। রাষ্ট্রের প্রতিটি প্রতিষ্ঠানকে স্বাধীনভাবে যার যার দায়িত্বমতো কাজ করতে দিয়ে ও আইনের শাসন কার্যকর করার মাধ্যমেই তা করতে হবে।
আইরিন খান: সামাজিক গবেষক।
[email protected]