জনসেবকেরা কেন নিষ্ঠুর হবেন?

বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস সংক্ষেপে যা বিসিএস নামে পরিচিত, তার মূল উদ্দ্যেশ্য হলো জনগণকে সেবা প্রদান। যার কারণে বিসিএস কর্মকর্তাদের বলা হয় সিভিল সার্ভেন্ট, এর অর্থ জনগণের সেবক। কিন্তু বাস্তবে উল্টো। এই জনগণের সেবকদের বেশির ভাগই জনগণের সঙ্গে দূরত্ব বজায় রেখে চলেন, ক্ষমতার চর্চা করেন। আবার কেউ কেউ হয়ে ওঠেন দোর্দণ্ড প্রতাপশালী। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন জেলা প্রশাসক, সচিব, যুগ্ম সচিব জনগণের ওপর বিশেষ ক্ষমতা প্রয়োগ করেন, তখন তিনি ভুলে যান যে তাঁর চাকরিটি হলো জনগণের সেবা দেওয়া, জনগণকে নিয়ন্ত্রণ, নিপীড়ন এবং জনগণের ওপর কর্তৃত্ব প্রদর্শন করার জন্য কোনোভাবেই নয়।

জনগণের সেবকদের এই কর্তৃত্বপরায়ণতা এবং নিপীড়ন বা ‘শায়েস্তা’ করার মনস্কতা এখন এতটাই আধিপত্যবাদী যে তাঁরা অনেকেই এখন এই ধরনের স্বেচ্ছাচারী ক্ষমতা প্রয়োগের কারণে আলোচিত। তাঁদেরই একজন কুড়িগ্রামের সদ্যবিদায়ী জেলা প্রশাসক সুলতানা পারভীন। কিছুদিন আগে একটি পুকুর সংস্কার করে নিজের নামে নামকরণ করেন। এ নিয়ে সেখানকার সাংবাদিক আরিফুল ইসলাম রিপোর্ট করেন। তখন এই জেলা প্রশাসক রেগে যান। এ ছাড়া জেলায় সরকারি নিয়োগে অনিয়ম নিয়ে সেই সাংবাদিক জেলা প্রশাসকের বিরুদ্ধে ফেসবুকে পোস্ট দেন। এতে জেলা প্রশাসকসহ অনেকে ক্ষুব্ধ হন। এই ঘটনার পর কুড়িগ্রামের স্থানীয় সাংবাদিক আরিফুল ইসলামকে মধ্যরাতে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে নির্যাতন করে সাজা দেওয়া হয়। একজন জেলা প্রশাসকের ক্ষমতা এবং প্রতিপত্তির কাছে সাংবাদিকের পেশা ‘অতি নগণ্য’। তাই তাঁকে ‘দুই টাকার সাংবাদিক’ বলতেও তিনি দ্বিতীয়বার ভাবেননি। আর সেই ‘দুই’ টাকার সাংবাদিকের এত বড় স্পর্ধা! শাস্তি তাঁকে যে পেতেই হবে! এই শাস্তির সঙ্গে মামলা পোক্ত করার জন্য তাঁর হাতে ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে মাদক।

সচিব, যুগ্ম সচিব কিংবা প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের জনগণের প্রতি এই ধরনের আচরণ কিংবা ক্ষমতা প্রয়োগের ঘটনা এই প্রথম নয় এবং এগুলো এক দিনে তৈরি হয়নি। চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের গুলিয়াখালী সমুদ্রসৈকতে ভ্রমণে আসা এক তরুণের চুল কেটে দেওয়া হয়েছে। ১০ মার্চ বিকেলে সীতাকুণ্ডের সহকারী কমিশনার (ভূমি) ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সৈয়দ মাহবুবুল হকের নির্দেশে তাঁর মাথার চুল কেটে দেওয়া হয়। ঘটনাস্থলে ওই নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট উপস্থিত ছিলেন।

সরকারের অতিরিক্ত আমলানির্ভরতা এই খুঁটিকে আরও পোক্ত করেছে। যার ফলে তাঁদের অনেকের মনেই এই ধারণা তৈরি হয়েছে যে তাঁরা যা খুশি করতে পারেন, কারণ তাঁরা সরকারের লোক। জনগণের প্রতি তাঁদের জবাবদিহির কোনো বালাই নেই। গত বছরের নভেম্বরে যুগ্ম সচিব আব্দুস সবুর মণ্ডলকে পারাপারের জন্য ফেরিঘাটে ফেরিকে তিন ঘণ্টা অপেক্ষমাণ রাখা হয়েছিল। মাদারীপুরের কাঁঠালবাড়ি ফেরিঘাটে দেরিতে ফেরি ছাড়ায় অ্যাম্বুলেন্সে থাকা স্কুলছাত্র তিতাস ঘোষ মারা যায়। কিন্তু তারপর সেই ঘটনাকে নিয়ে তৈরি হওয়া তদন্ত কমিটিও সেখানে যুগ্ম সচিবের কোনো দোষ খুঁজে পায়নি; বরং দোষ দিয়েছেন কর্মচারীদের। এটিও আমাদের সহজে বোধগম্য যে যদি সেই কর্মচারী ওই যুগ্ম সচিবের জন্য অপেক্ষা না করে ফেরি চলার নির্দেশ দিতেন, তাহলে হয়তো তিনি কারণ দর্শানোর নোটিশ পেতেন। তাই চাকরি যেন চলে না যায়, সে জন্য তিনি তাঁর ওপরের কর্তাকেই খুশি করতে চেয়েছেন।

শিক্ষার্থীদের বেশির ভাগই এখন বিসিএস দিয়ে প্রশাসনিক অফিসার হতে চান। প্রায়ই দেখি এবং শুনি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারে শিক্ষার্থীরা বিসিএসের গাইড পড়েন। একবার আগ্রহ নিয়ে কয়েকজনকে জিজ্ঞেস করলাম, কেন জনগণের সেবক হতে চান? বললেন সেবক কেন? অফিসাররা কি কখনো সেবক হন? বরং সবচেয়ে বেশি ক্ষমতা প্রয়োগ করা যায়। এ জন্যই বিসিএসে চাকরি পেতে চাই। তাঁদের কাছে যখন আমলাদের বেশির ভাগেরই চেহারা আলাদিনের প্রদীপবাহী দৈত্যের মতো, তাই তাঁরাও এই প্রদীপ হাতে পেতে চান।

বেশ কয়েক বছর আগে বরিশালে গিয়েছিলাম। সেখানে মনোরমা মাসিমার (মনোরমা বসুর) প্রতিষ্ঠিত স্কুল মাতৃপীঠে গেলাম, দেখলাম স্কুলের দরজার পাশে অনেক বড় করে জেলা প্রশাসকের নাম লেখা। হয়তো তিনি স্কুলটির কোনো কাঠামোগত পরিবর্তন উদ্বোধন করেছেন। সেই ফলকটির অনেক নিচে খুবই ছোটভাবে আযত্নে-অবহেলায় ঝুলছে এই স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা মনোরমা বসুর ছবি। এমনই আমাদের আমলাতন্ত্র, এমনই আমাদের শিক্ষা।

দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ বলেছেন, ‘আমরা চাই প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীরা সেবাগ্রহীতা নাগরিকদের “স্যার” সম্বোধন করবেন।’ যে নামেই ডাকা হোক, জনগণ অন্তত মানুষের মর্যাদাটুকু তাঁদের কাছে চায়। তার বদলে নিপীড়নের দিকে আগ্রহ মোটেই গ্রহণযোগ্য নয়।

জোবাইদা নাসরীন: শিক্ষক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
[email protected]