জনস্বাস্থ্য উন্নয়নের ধারা বদলে দিয়েছিলেন যিনি

স্যার ফজলে হাসান আবেদ
ফাইল ছবি

ব্র্যাকের প্রতিষ্ঠাতা স্যার ফজলে হাসান আবেদ লোকান্তরিত হয়েছেন আজ এক বছর। সৃজনশীল ও উদ্ভাবনী চিন্তাভাবনায় যে তিনি অনন্য ছিলেন, সে কথা বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত। এর মধ্যে জনস্বাস্থ্য উন্নয়নে তাঁর একটি ভূমিকার ওপরেই আমি এখানে আলোকপাত করছি।

১৯৭২ সালে ব্র্যাকের প্রতিষ্ঠা। সূচনা বর্তমান সুনামগঞ্জ জেলার হাওরঘেরা শাল্লা অঞ্চলে। অন্যান্য বিষয়ের সঙ্গে প্রথম থেকেই গ্রামীণ জনগণের স্বাস্থ্য অবস্থার উন্নতিতে জোর দেওয়া হয়েছিল। সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের স্বাস্থ্য সূচকগুলো তখন পৃথিবীর মধ্যে প্রায় নিম্নতম পর্যায়ে। শিশুমৃত্যুর হার ২৫০-এর কোঠায়। শিশুদের এক-চতুর্থাংশ তাদের পঞ্চম জন্মদিবসের আগেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ত। মাতৃমৃত্যু হারও ছিল অত্যধিক—হাজারের কাছাকাছি।

প্রথমেই ব্র্যাক শাল্লা এলাকায় চারটি ক্লিনিক চালু করে। এর দায়িত্ব দেওয়া হয় তরুণ এমবিবিএস ডাক্তারদের। সবাই খুব নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করছিলেন। কিন্তু তাঁদের বেশি দিন সেই অজপাড়াগাঁয়ে ধরে রাখা যায়নি। এই মহাসংকটে ব্র্যাক ঠিক করল যে এমবিবিএস ডাক্তারদের বদলে ডিপ্লোমা বা এই ধরনের স্বাস্থ্যকর্মী নিয়োগ দেবে। স্থানীয় ১১ জন যুবককে প্যারামেডিক হিসেবে প্রশিক্ষিত করে ক্লিনিকের বিভিন্ন দায়িত্বে বসানো হলো। এবার দেখা গেল নতুন সমস্যা। স্থানীয় হওয়ার সুবাদে এসব প্যারামেডিক খুদে ডাক্তার সেজে নিজেই ডাক্তারি পসরা বসিয়ে দিলেন। ব্র্যাকের ক্লিনিকগুলো আর চলল না।

এরপর ব্র্যাক ঠিক করল প্যারামেডিকের বদলে স্বাস্থ্যসেবিকা নিয়োগ দেবে, যাঁরা হবেন নারী, নিম্ন আয়ধারী এবং স্বল্পশিক্ষিত। তাঁরা কোনো নির্দিষ্ট ক্লিনিকে বসবেন না, বাড়ি বাড়ি গিয়ে স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দেবেন। লক্ষাধিক ‘সেবিকাকে’ ব্র্যাক এ পর্যন্ত প্রশিক্ষিত করেছে। ব্র্যাকের এ স্বাস্থ্যসেবিকা কার্যক্রম এখন বিশ্বজোড়া। প্রশিক্ষিত ডাক্তার-নার্সদের অভাবে তাঁরাই এখন পৃথিবীর দরিদ্র অঞ্চলগুলোয় স্বাস্থ্যসেবার হাল ধরে আছেন।

১৯৭৮ সালে আন্তর্জাতিক শিশুবর্ষে বাংলাদেশে শিশুস্বাস্থ্য উন্নয়নে কী ধরনের কার্যক্রম নেওয়া যায়, তা বিবেচনার লক্ষ্যে তৎকালীন রাষ্ট্রপতির নেতৃত্বে একটি জাতীয় কমিটি গঠন করা হয়। ব্র্যাকের নির্বাহী পরিচালক ফজলে হাসান আবেদ এ কমিটিতে ছিলেন। তখনকার কলেরা রিসার্চ ল্যাবরেটরির (বর্তমান আইসিডিডিআরবি) হেনরি মোসলে এবং লিংকন চেনও ছিলেন এ কমিটিতে। একটি মিটিংয়ের ফাঁকে জনাব আবেদ রাষ্ট্রপতিকে বললেন, বাংলাদেশের সব শিশু রোগ নিরোধক টিকা যাতে পায়, তা তিনি নিশ্চিত করতে চান এবং এ কাজে রাষ্ট্রপতির সহযোগিতা কামনা করলেন। রাষ্ট্রপতি কিছুক্ষণ চুপ থেকে তারপর বললেন, ‘আমাকে আরও কয়েকটা বছর সময় দিন। টিকা কার্যক্রম ভালোভাবে চালাতে হলে একটি নিশ্ছিদ্র কোল্ডচেন দরকার, যা আমি এখনই নিশ্চিত করতে পারছি না।’ টিকাদান প্রচেষ্টা আর এগোয়নি আশির দশকের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত।

এদিকে আবেদ ভাই তাঁর বন্ধু রকফেলার ফাউন্ডেশনের জন রোডিসহ কয়েকজনের সঙ্গে ব্র্যাকের ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা নিয়ে আলাপ করলেন। সবার মতামতের ভিত্তিতে ঠিক হলো ব্র্যাক একটি ডায়রিয়া প্রতিরোধক কর্মসূচি হাতে নেবে। আবেদ ভাই শাল্লায় গেলেন এবং প্রকল্প সভায় এ ডায়রিয়া প্রতিষেধক কর্মসূচির ব্যাপারে ব্র্যাক কর্মীদের সঙ্গে মতবিনিময় করলেন। ঠিক হলো এই শাল্লায়ই ডায়রিয়া প্রকল্পের প্রথম পাইলট আয়োজন করা হবে।

কিন্তু প্রশ্ন দেখা দিল গ্রামের মানুষকে কী বার্তা দেওয়া হবে এবং কীভাবে। খাওয়ার স্যালাইন, যা ডায়রিয়া চিকিৎসায় একমাত্র কার্যকর চিকিৎসা, সেটি কীভাবে বানানো হবে? কীভাবে লবণ, গুড় ও পানির পরিমাণ ঠিক করা হবে?

ইন্দোনেশিয়ায় সে সময় একটি ডায়রিয়া চামচ উদ্ভাবিত হয়েছিল, যার ছিল দুটো প্রান্ত। এক প্রান্তে মাপা হবে লবণ আর অন্য প্রান্তে চিনি বা গুড়। কিন্তু যদি চামচটি হারিয়ে বা ভেঙে যায়, তাহলে কী হবে? নানা বিকল্প নিয়ে আলোচনার পর শেষ পর্যন্ত টিকে গেল এক চিমটি লবণ আর একমুঠো গুড়ের ফর্মুলা।

পুরোনো কর্মী সুখেন্দ্র কুমার সরকারের নেতৃত্বে শুরু হলো পাইলট প্রকল্প—শাল্লা, আজমিরীগঞ্জ আর বানিয়াচং থানায়। এইপ্রকল্পের মাধ্যমেই যে ব্র্যাক বাংলাদেশের শিশুদের জন্য গেমচেঞ্জার হবে, তা তখন অনেকেই বুঝতে পারেননি। কর্মসূচিটির নাম দেওয়া হয় ওরাল থেরাপি প্রোগ্রাম বা সংক্ষেপে ওটেপ।

পাইলট-পরবর্তী এক দশক ধরে ব্র্যাকের হাজার হাজার কর্মী বাংলাদেশের প্রতিটি গ্রামে প্রতিটি বাড়িতে গিয়ে মায়েদের শিখিয়েছেন কীভাবে লবণ-গুড় দিয়ে স্যালাইন নিখুঁতভাবে বানাতে হয় এবং ডায়রিয়া হলে কীভাবে সেটা খাওয়াতে হবে। ব্র্যাকের এ যুগান্তকারী কাজের ফলে বাংলাদেশে ওয়াটারি ডায়রিয়ায় মৃত্যুহার এখন প্রায় শূন্যের কোঠায়। আর মুখে খাওয়ার স্যালাইনের ব্যবহার তো পৃথিবীর মধ্যে সর্বোচ্চ—প্রায় ৮৫ শতাংশ ডায়রিয়া রোগী এখন এ স্যালাইন ব্যবহার করছে।

স্বাস্থ্যক্ষেত্রে ব্র্যাকের অবদান অনেক বিস্তৃত। প্রায় চার দশক ধরে সংস্থাটি অনেক নতুন নতুন কর্মসূচি উপহার দিয়েছে, যা দেশের প্রায় প্রতিটি গ্রামে দরিদ্র জনগণ তথা শিশু ও নারীদের কাছে পৌঁছেছে। এগুলোর মধ্যে আছে সর্বজনীন টিকা, অন্তঃসত্ত্বা মা, নবজাতক ও শিশুস্বাস্থ্য, পুষ্টি, যক্ষ্মা, চক্ষুসেবা, পানি, পয়োনিষ্কাশন ইত্যাদি। এগুলো থেকে বাংলাদেশের বেশির ভাগ মানুষই লাভবান হচ্ছে। আজ পৃথিবীর বহু দেশের সঙ্গে বাংলাদেশও করোনার আঘাতে পর্যুদস্ত। আমি নিশ্চিত, ব্র্যাক এখন আবেদ ভাইয়ের অনুপস্থিতি বেশি করে টের পাচ্ছে। তাঁর সৃজনশীল চিন্তাভাবনা ও উদ্ভাবনী শক্তির বড় প্রয়োজন ছিল এখন।

আহমদ মোশতাক রাজা চৌধুরী: নিউইয়র্কের কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক। ব্র্যাকের সাবেক ভাইস চেয়ার