জাকাত গরিবের প্রাপ্য অধিকার

ইবাদতের বিশেষ মাস রমজান। ইবাদত অর্থ জীবনের সব ক্ষেত্রে আল্লাহর আনুগত্যের মাধ্যমে তাঁর রেজামন্দি হাসিল করা। বাহ্যিক ইবাদত তিনভাবে হয়ে থাকে: মৌখিক, শারীরিক ও আর্থিক।

ইসলামি অর্থব্যবস্থার মূল ভিত্তি হলো জাকাত, যা ইসলামের মূল পঞ্চ স্তম্ভের অন্যতম। জাকাত অর্থ পবিত্রতা ও প্রবৃদ্ধি। জাকাত প্রদানের মাধ্যমে সম্পদ পবিত্র হয়, আত্মা পরিশুদ্ধ হয় এবং সম্পদে বরকত হয় ও মনে প্রাচুর্যের অনুভূতি আসে। জাকাত একটি নির্ধারিত ফরজ ইবাদত। আল–কোরআনে নামাজের নির্দেশ যেমন ৮২ বার রয়েছে, অনুরূপ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জাকাতের নির্দেশনাও রয়েছে ৮২ বার। ‘জাকাত’ শব্দ দ্বারা ৩০ বার, ‘ইনফাক’ শব্দ দ্বারা ৪৩ বার এবং ‘সদাকা’ শব্দ দ্বারা ৯ বার।

জাকাত গরিবের পাওনা বা অধিকার এবং দাতার নাজাত ও জান্নাতের মাধ্যম। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘মুত্তাকিরা জান্নাতে ফোয়ারার নিকটে থাকবে। তারা গ্রহণ করবে, যা তাদের পালনকর্তা তাদের দেবেন। নিশ্চয়ই ইতিপূর্বে তারা ছিল সৎকর্মপরায়ণ, তারা রাত্রির সামান্য অংশেই নিদ্রা যেত, রাতের শেষ প্রহরে তারা ক্ষমাপ্রার্থনা করত এবং তাদের ধনসম্পদে ছিল প্রার্থী ও বঞ্চিতের হক বা ন্যায্য অধিকার।’ (সুরা-৫১ জারিয়াত, আয়াত: ১৫-১৯)। আল্লাহ তাআলা আরও বলেন, ‘তবে তারা স্বতন্ত্র, যারা নামাজ আদায়কারী। যারা তাদের নামাজে সার্বক্ষণিক কায়েম থাকে এবং যাদের ধনসম্পদে নির্ধারিত হক আছে যাঞ্চাকারী ও বঞ্চিতের এবং যারা প্রতিফল দিবসকে সত্য বলে বিশ্বাস করে আর যারা তাদের পালনকর্তার শাস্তি সম্পর্কে ভীত–কম্পিত। (সুরা-৭০ মাআরিজ, আয়াত: ২২-২৭)।

জাকাত সম্পর্ককে পবিত্র করে। জাকাতযোগ্য সম্পদের প্রতি চান্দ্রবছরে তথা ৩৫৪ দিনে একবার জাকাত দিতে হয়। জাকাত প্রদান না করলে হালাল বা বৈধ সম্পদও হারামমিশ্রিত হয়ে যায়। হালাল খাদ্য ব্যতীত নামাজ, রোজা, হজ কোনো ইবাদতই কবুল হয় না।

পরিকল্পিতভাবে জাকাত প্রদান করলেই সমাজ, দেশ, জাতি ও রাষ্ট্র এবং বিশ্ব দারিদ্র্যমুক্ত হবে। জাকাত দারিদ্র্য বিমোচন করে ও সম্পদের প্রবাহ তৈরি করে। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘যাতে তোমাদের বিত্তবানদের মাঝেই শুধু সম্পদ আবর্তন না করে।’ (সুরা-৫৯ হাশর, আয়াত: ৭)। জাকাতের সামাজিক অনেক সুফল রয়েছে। যেমন: (ক) অর্থের প্রবাহ বা সঞ্চালন: জাকাত প্রদান করলে নগদ অর্থ হাত বদল হয়, সম্পদে গতিশীলতা আসে, প্রচুর লোক ক্রয়ক্ষমতা অর্জন করে, চাহিদা বা ভোক্তা সৃষ্টি হয়। ক্রেতা সৃষ্টি হলে উৎপাদন বৃদ্ধি হয়, শিল্পকারখানা প্রতিষ্ঠা হয়, কর্মসংস্থান হয়। ফলে জনগণের জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন হয়। (খ) দারিদ্র্য বিমোচন: সঠিকভাবে জাকাত প্রদান করলে সমাজের দারিদ্র্য দূরীভূত হয়, অপরাধপ্রবণতা কমে এবং আর্থসামাজিক বিপর্যয় থেকে জাতি রক্ষা পায়। সর্বোপরি সুদের অভিশাপ থেকে মুসলমানগণ রক্ষা পায়। (গ) মানবিক উন্নয়ন: জাকাত আদায়ের মাধ্যমে খাই খাই মানসিকতার অবসান হয়, দাতার তালিকায় নাম ওঠে ও আত্মসম্মানবোধের সৃষ্টি হয়। এতে ধনী–গরিবের বিভেদ দূর হয়, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ, ভালোবাসা সম্প্রীতি তৈরি হয়, সহমর্মিতা ও সামাজিক নিরাপত্তাবলয় গঠিত হয়; এতে দাতা-গ্রহীতা উভয়ের আর্থসামাজিক নিরাপত্তা জোরদার হয়। সমাজ থেকে কার্পণ্য, লোভ, মোহ এবং হিংসা ও পরশ্রীকাতরতাসহ নানাবিধ দুষ্ট উপসর্গ দূর হয়। হাদিস শরিফে জাকাত ও সদাকাত প্রদানের উপকারিতা প্রসঙ্গে এসেছে: দাতা আল্লাহর কাছে প্রিয়, মানুষের কাছে প্রিয়, জান্নাতের নিকটতম; জাহান্নাম থেকে দূরে। সাধারণ দাতা অধিক ইবাদতকারী কৃপণ অপেক্ষা আল্লাহর নিকট বেশি প্রিয়।’ (তিরমিজি শরিফ)।

জাকাত ও সদকাতুল ফিতর ব্যয়ের আটটি খাত কোরআন মাজিদে উল্লেখ রয়েছে। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘মূলত সদকাত হলো ফকির, মিসকিন, জাকাত কর্মী, অনুরক্ত ব্যক্তি ও নওমুসলিম, ক্রীতদাস, ঋণগ্রস্ত ব্যক্তি, আল্লাহর পথে জিহাদকারী ও বিপদগ্রস্ত বিদেশি মুসাফির ও পথ-সন্তানদের জন্য। এটি আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত। আর আল্লাহ সর্বজ্ঞানী ও পরম কৌশলী।’ (সুরা-৯ তওবা, আয়াত: ৬০)। উক্ত আটটি খাতের মধ্যে সময়ের প্রয়োজন ও ফলাফল বিবেচনা করে নিকটাত্মীয়, প্রতিবেশী ও অন্যদের অগ্রাধিকার দিতে হবে। এতে জাকাত ফিতরা আদায় হওয়ার পাশাপাশি নিয়ত অনুযায়ী ক্ষেত্রবিশেষ সওয়াবের পরিমাণও বাড়বে।

জাকাত ও সদকা যাঁদের দেওয়া যায় না, তাঁরা হলেন পিতা-মাতা ও ঊর্ধ্বতন পুরুষ, ছেলেমেয়ে ও অধস্তন পুরুষ, ধনী লোক যারা নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক, সাইয়্যেদ অর্থাৎ হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রকৃত বংশধর এবং অমুসলিম।

জাকাত, সদকা ও ফিতরা দেওয়ার সময় গ্রহীতাকে তা জানানোর প্রয়োজন নেই। জাকাতগ্রহীতা যদি আত্মীয়স্বজন, আপনজন বা পরিচিত সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি হন, তাহলে জাকাত উল্লেখ করাটা মোটেই সমীচীন নয়। কারণ, এতে গ্রহীতা অপমানিত, অসম্মানিত ও বিব্রতবোধ করতে পারেন।

মুফতি মাওলানা শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী

যুগ্ম মহাসচিব, বাংলাদেশ জাতীয় ইমাম সমিতি; সহকারী অধ্যাপক, আহ্ছানিয়া ইনস্টিটিউট অব সুফিজম

[email protected]