জাতীয় মানবাধিকার কমিশন কি ঘুমিয়েই থাকবে?

জাতীয় মানবাধিকার কমিশন

আমাদের জাতীয় মানবাধিকার কমিশন এক যুগ পূর্ণ করেছে। কোনো দেশে রাষ্ট্রীয়ভাবে জনগণের অর্থে মানবাধিকার কমিশন প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য হলো দরিদ্র, নিপীড়িত ও অসহায় মানুষের প্রতি মানবাধিকার লঙ্ঘনের ক্ষেত্রে তাৎক্ষণিক ক্ষতিপূরণসহ অন্যান্য প্রতিকার আদায় করা এবং এ আদায়ের মধ্য দিয়ে সরকার ও সরকারি প্রতিষ্ঠানসমূহকে মানবাধিকার রক্ষায় জবাবদিহির আওতায় নিয়ে আসা। বিশ্ব মানবাধিকার দিবসে স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন জাগে—জনগণের টাকায় পরিচালিত এত বড় কমিশন লালন করে মানুষের কী লাভ হচ্ছে? কমিশন কি আইনে অর্পিত তার দায়িত্ব পালন করছে?

আদালত বা সুপ্রিম কোর্ট থেকে প্রতিকার পাওয়া সাধারণ মানুষের জন্য কষ্টসাধ্য, সময়সাপেক্ষ এবং ব্যয়বহুল। ন্যায় বিচারের এই বাধাসমূহ থেকে উত্তরণের জন্যই আধা বিচারিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের প্রতিষ্ঠা। কমিশনে কোনো আনুষ্ঠানিক সাক্ষ্য উপস্থাপনের প্রয়োজন নেই; আইনজীবী নিয়োগেরও কোনো প্রয়োজন নেই। যা প্রয়োজন তা হলো কমিশনে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ করা এবং উক্ত অভিযোগের ওপর ভিত্তি করে কমিশন সরকারসংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে ব্যাখ্যা চাইবে। কিন্তু কমিশনের প্রথম চেয়ারম্যান গত ১০ বছর কেবল সভা সেমিনারে বলেছেন যে ‘কমিশনের ক্ষমতা নেই’। যদি কমিশনের কোনো ক্ষমতা না-ই থাকে, তাহলে প্রতি বছর জনগণের পাঁচ-ছয় কোটি টাকা ব্যয় করে আমরা কেন এই কমিশন লালন করছি? ৩৫-৪০ জন কর্মকর্তা–কর্মচারীদের এ কমিশন যদি নিপীড়িত মানুষের মানবাধিকার আদৌ রক্ষা করতে না পারে, তাহলে চেয়ারম্যানসহ অন্যান্য কমিশনারগণই বা পদ আঁকড়ে আছেন কেন?

সাম্প্রতিককালে প্রতিনিয়ত ধর্ষণ, পুলিশ, র‌্যাবসহ অন্যান্য সরকারি প্রতিষ্ঠান কর্তৃক যেভাবে নারী, শিশু ও অন্যান্য সাধারণ মানুষের ওপর প্রকাশ্যে নির্যাতন করা হচ্ছে, গুম করা হচ্ছে—এর একটি ক্ষেত্রেও কমিশন যথাযথ অনুসন্ধান বা পদক্ষেপ সরকার বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিরুদ্ধে গ্রহণ করছে না।

খাদিজা নির্যাতন মামলা এবং হাইকোর্টের রায়ে পর্যালোচনা
সিসিবি ফাউন্ডেশন ২০১৩ সালে গৃহকর্মী খাদিজাকে গৃহকর্তা কর্তৃক অমানুষিক নির্যাতনের বিষয় তুলে ধরে কমিশনের কাছে প্রতিকার চায়। কমিশন খাদিজার নির্যাতনের বিষয়ে মামলা গ্রহণ না করায় পুলিশের মারাত্মক মানবাধিকার লঙ্ঘন খুঁজে পায়। কিন্তু কমিশন বাস্তবে কোনো পদক্ষেপ না নিয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে বারবার পত্র দিয়ে তদন্ত করতে বলে। এই পত্র প্রেরণ করতে কমিশন ছয় বছর পার করে দেয়। ২০১৮ সালে কমিশনের বিরুদ্ধে ফাউন্ডেশন রিট করে। ২০১৯ সালে হাইকোর্ট রায়ে মন্তব্য করেন যে মানবাধিকার আইনে অর্পিত দায়িত্ব পালনে মারাত্মক গাফিলতির পরিচয় দিচ্ছে; মানবাধিকার কমিশন মানবাধিকার রক্ষায় ‘জেগে জেগে ঘুমাচ্ছে’। খাদিজা নির্যাতনের বিষয়ে খাদিজাসহ পুলিশের এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের শুনানি শেষে ৫০ হাজার টাকা ক্ষতিপূরণের সুপারিশ করেই কমিশন তার দায়িত্ব শেষ করেছে। হাইকোর্ট কমিশনকে স্পষ্টভাবে নির্দেশনা দিয়েছিল সরকার বা কর্তৃপক্ষ কমিশনের সুপারিশ না শুনলে যেন হাইকোর্টের দ্বারস্থ হয়। কিন্তু কমিশনকে আইনি নোটিশ দেওয়ার পরও কমিশন হাইকোর্টে কোনো রিট করেনি।

কমিশন কর্তৃক আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ নিষ্পত্তির ধরনও প্রশ্নবিদ্ধ। সরকার থেকে প্রতিবেদন না পেয়ে কমিশন একের পর এক পত্র দেয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তিন বছরেও সরকার প্রতিবেদন দেয়নি কিন্তু কমিশন নিশ্চুপ থেকেছে।

কমিশনের এরূপ দায়িত্বহীনতা দেশে মারাত্মক মানবাধিকার লঙ্ঘনকে আরও উসকে দেওয়ার কাজ করছে। খাদিজা নির্যাতন মামলার রায়ে বোঝা যায় যে কমিশন অপরাধ এবং মানবাধিকারের পার্থক্য অনুধাবনে এখনো সক্ষমতা অর্জন করতে পারেনি। রায়টি পড়লে আরও বোঝা যায় যে কমিশন বারবার ‘অপরাধের’ ওপর গুরুত্ব দিচ্ছে। অর্থাৎ থানায় মামলা করলে বা হলে ‘কমিশনের করণীয় কিছু নেই’ বলে হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকে। কমিশনের চেয়ারম্যান বা সদস্যের যদি ‘মানবাধিকার’ বোঝার সক্ষমতা না থাকে, সেখানে কমিশন কী ‘মানবাধিকার’ রক্ষা করবে, তা এখনো অস্পষ্ট।

ক্ষমতা থাকলেও ক্ষতিপূরণ আদায়ের নজির নেই
গত এক বছরে পুলিশের হাতে নির্মম নির্যাতনের শিকার হয়েছে কমপক্ষে দুই হাজারের মতো নারী, অসংখ্য শিশু ও নিরীহ মানুষ। বারবার এরূপ প্রকাশ্য মানবাধিকার লঙ্ঘনেও আমাদের মানবাধিকার কমিশন নিশ্চুপ কেন? এটা সত্য যে মানবাধিকার কমিশন কোনো আদালত নয়, তবে কমিশন মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য সরাসরি কাউকে শাস্তি দিতে না পারলেও ইহা যথাযথ কার্যক্রমের মাধ্যমে শাস্তি ও ক্ষতিপূরণ এনে দিতে পারে। উল্লেখ্য, ভারতীয় মানবাধিকার কমিশন গত ২৫ বছরে ৯ হাজার ৮৯০টি মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় ভুক্তভোগীদের ১৫০ কোটিরও বেশি ভারতীয় রুপি ক্ষতিপূরণ সুপারিশ করেছে সরকারি সংস্থাসমূহের বিরুদ্ধে এবং উক্ত ক্ষতিপূরণ আদায় নিশ্চিত করেছে। ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে ভারতীয় কমিশন ক্ষতিপূরণের সুপারিশ করেছে ৪৫ লাখেরও বেশি। আইনে বাংলাদেশের কমিশনের সমান এবং কিছু ক্ষেত্রে বেশি ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও আমাদের কমিশনে এমন নজির দেখা যায় না। গত ১০ বছরে এখন পর্যন্ত একটি ঘটনায় ক্ষতিপূরণের সুপারিশ করেছে।

আইনে যখন নানা প্রতিবন্ধকতা
জাতীয় মানবাধিকার কমিশন আইনটির ১৮ ধারা পড়লে আপাতত দৃষ্টিতে মনে হতে পারে যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য কর্তৃক মানবাধিকার লঙ্ঘিত হলে কমিশনের প্রতিবেদন চাওয়া ছাড়া অন্য কোনো ক্ষমতা নেই। কিন্তু ১৮ ধারার ব্যাখ্যা কমিশনকে উপলব্ধি করতে হবে।

প্রথমত, আইনের ১৮ ধারার সঙ্গে ভারতীয় মানবাধিকার কমিশন আইনের ১৯ ধারার সঙ্গে হুবহু মিল রয়েছে। কিন্তু ভারতীয় কমিশন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়ে যে পদ্ধতি গ্রহণ করেছে, বাংলাদেশের মানবাধিকার কমিশনের তা গ্রহণ করা উচিত। আইনটির ১৮(১), ১৮(২), ১৮(৩), ১৮(৪) ও ১৮(৫) উপধারার বিধানসমূহ অন্যান্য বিধানের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে ব্যাখ্যা করলে বোঝা যায় যে কমিশনের হাত–পা বাধা নয়। কমিশন সরকারকে সময় বেঁধে দিতে পারে। কমিশন ১৮(৩)(খ) উপধারা অনুযায়ী ভুক্তভোগীকে সাময়িক সাহায্যের সুপারিশ করতে পারবে যে কাজটি ভারতীয় কমিশন অহরহ করছে; তবে সরকারের নিকট থেকে প্রতিবেদন প্রাপ্তির পর কমিশন সন্তুষ্ট হলে আর কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করবে না।

কিন্তু সন্তুষ্ট না হলে কমিশনের ক্ষমতা প্রয়োগের একটি বড় ক্ষেত্র তৈরি হয়ে যায়। এখন তথ্য-উপাত্ত বা তদন্তের কাগজপত্রসহ প্রতিবেদন না পেলে কমিশন কী করে সন্তুষ্ট হবে যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তার প্রতিবেদনে প্রকৃত তথ্য লুকিয়েছে কি না? ‘প্রতিবেদন চাওয়ার’ ও ‘প্রতিবেদন পর্যালোচনা’ করার মধ্যেই নিহিত রয়েছে মানবাধিকার রক্ষার শক্তিশালী অস্ত্র। কিন্তু সেই প্রতিবেদন চাওয়ার প্রক্রিয়ায় কমিশন গত এক যুগে কোনো দক্ষতা অর্জন করতে পেরেছে বলে মনে হয় না।

কমিশন কর্তৃক আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ নিষ্পত্তির ধরনও প্রশ্নবিদ্ধ। সরকার থেকে প্রতিবেদন না পেয়ে কমিশন একের পর এক পত্র দেয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তিন বছরেও সরকার প্রতিবেদন দেয়নি কিন্তু কমিশন নিশ্চুপ থেকেছে। অন্যদিকে, ভারতীয় কমিশন প্রতিবেদন চায় নির্ধারিত দিনের মধ্যে এবং প্রতিবেদন পাওয়ার পর সন্তুষ্ট না হলেই সাময়িক সাহায্য ভিকটিমকে বা তার পরিবারকে কেন দেওয়া হবে না, তার কারণ দর্শানোর নোটিশ জারি করে। বাংলাদেশের মানবাধিকার কমিশনের এ ধরনের দু–একটা ঘটনায় প্রথমে সক্রিয়তা দেখাতে হবে। হয়তো সরকার সংক্ষুব্ধ হয়ে হাইকোর্টে যাবে? তাতে কমিশনের ভয় কীসের? কমিশন আইনি লড়াইয়ে মানবাধিকারের পক্ষে রায় ছিনিয়ে আনবে। এ বিষয়ে কমিশনের উচিত ভারতীয় মানবাধিকার কমিশনের কার্যাবলি পর্যবেক্ষণ করা।
ভারতীয় মানবাধিকার কমিশনের সক্রিয়তা

এখানে ভারতীয় কমিশনের দুটি অভিযোগের উদাহরণ দেওয়া বাঞ্ছনীয়। প্রথমত, ২০০০ সালে কমিশন অভিযোগ পায় যে বিএসএফ গুলি করে দুজন নাগরিককে মেরে ফেলেছে। কমিশন কেন্দ্রীয় সরকারের কাছ থেকে প্রতিবেদন চায়। প্রতিবেদন পাওয়ার পর কমিশন সন্তুষ্ট না হতে পেরে ভুক্তভোগীর পরিবারকে কেন দুই লাখ রুপি করে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে না, তার কারণ দর্শানো নোটিশ জারি করে। ভারতীয় বিএসএফ ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কমিশনের এই ক্ষমতাকে চ্যালেঞ্জ করে। তখন স্বরাষ্ট্রসচিব ও বিএসএফ প্রধানকে কমিশন শুনানিতে তলব করে। বিএসএফ ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় যুক্তি দেখায় যে আইনের ১৯ ধারা কমিশনকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিরুদ্ধে ক্ষতিপূরণের আদেশ দিতে কোনো ক্ষমতা প্রদান করে না। কিন্তু মানবাধিকার কমিশন যুক্তি দেখায় যে সরকার প্রতিবেদন দেওয়ার পর এবং প্রতিবেদনে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ইঙ্গিত থাকলে কমিশন তার ক্ষমতা প্রয়োগে ১৯ ধারার সীমাবদ্ধতার মধ্যে চুপ থাকবে না। ১৯(১)(খ) উপধারায় [বাংলাদেশের ১৮(৩)(খ)] প্রদত্ত ক্ষমতা ব্যাপক এবং এই ক্ষমতা ভুক্তভোগী বা তার পরিবারকে সাময়িক সাহায্য প্রদানের ক্ষমতাকে অন্তর্ভুক্ত করে। অবশেষে কমিশনের ব্যাখ্যা মেনে নিয়ে বিএসএফ ভুক্তভোগী পরিবারকে দুই লাখ রুপি ক্ষতিপূরণ প্রদান করে।

পুলিশ কর্তৃক প্রকাশ্যে হয়রানি ও অমানবিক নির্যাতনের ঘটনা বন্ধেও কমিশন ভূমিকা রাখতে পারে। বিগত এক যুগে মানবাধিকার কমিশন যদি লিমন, কাদের, রানা প্লাজা ধস, বিনা বিচারে জেল খাটা, অসংখ্য শিশু–নারী ধর্ষণের মতো মারাত্মক মানবাধিকার লঙ্ঘনে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণসহ সরকারকে ক্ষতিপূরণ প্রদানের সুপারিশ করত, তাহলেও কমিশনের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হতো। অন্তত পুলিশের বিরুদ্ধে শিশু বা নারী নির্যাতনের অভিযোগগুলোতেও যদি একটু সক্রিয় হয়ে ক্ষতিপূরণের সুপারিশ করত, তাহলে সরকারের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীতে অন্যায় কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত কর্মকর্তারা সতর্ক হয়ে যেতেন; কমিশনকে প্রতিষ্ঠান হিসেবে ভয় পেত এবং কমিশনের প্রতি সাধারণ নিপীড়িত মানুষের আস্থা বৃদ্ধি পেত।

মো. আবদুল হালিম আইনজীবী ও ‘জাতীয় মানবাধিকার কমিশন: সমস্যা এবং প্রত্যাশা’ বইয়ের লেখক