জাতীয় সংলাপ ও জাতীয় সনদ

.
.

বিশিষ্ট নাগরিকদের উদ্যোগে জাতীয় সংলাপের উদ্যোগকে স্বাগত জানাই। এই উদ্যোগ আরও একটি কারণে ধন্যবাদ পাওয়ার যোগ্য। কারণ, তাঁরা দেশে স্থায়ীভাবে শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক পরিবেশ বজায় রাখার জন্য সব দলের পালনীয় একটি ‘জাতীয় সনদ’ও রচনা করার উদ্যোগ নিয়েছেন। বড় দুই দল মিলে যে রাজনৈতিক অপসংস্কৃতির জন্ম দিয়েছে, তাতে এ ধরনের সহিংসতা বা সংঘাত আবার কখনো শুরু হবে না, তা নিশ্চিত বলা যায় না। কাজেই আমাদের রাজনৈতিক দলের ও সরকারের অবশ্যপালনীয় এমন কিছু শর্তে সব দলকে একমত হতে হবে। নাগরিক সমাজ উদ্যোগ নিলেও নির্বাচন কমিশনকেই এ ব্যাপারে আইনি ব্যবস্থা নিতে হবে। নইলে তা নব্বইয়ের তিন জোটের অঙ্গীকারের মতো হাওয়ায় মিলিয়ে যাবে।
প্রথমত, বর্তমান সংকটের অবসান কীভাবে করা যায়, সে ব্যাপারে প্রধান রাজনৈতিক দলের মধ্যে মতৈক্য হতে হবে। সেটা এই মুহূর্তে খুবই জরুরি। নানা ভঙ্গিতে দেশে দূষিত ও রুগ্ণ রাজনীতি রয়েছে। প্রধান কয়েকটি দলই এর পৃষ্ঠপোষক। রুগ্ণ রাজনীতি বজায় থাকলে দেশে আবার এ ধরনের বা অন্য ধরনের সংকট তৈরি হতে পারে। ‘পেট্রলবোমা’ ও ‘বালুর ট্রাক’ দুটোই আমাদের অসুস্থ ও দূষিত রাজনীতির সৃষ্টি। কোনো এক পক্ষকে দায়ী করে সমস্যার সমাধান করা যাবে না। রাজনীতির অঙ্গন থেকে একই সঙ্গে পেট্রলবোমা ও বালুর ট্রাক, দুটোকেই বিদায় দিতে হবে। অনেকে বলতে পারেন, ‘বালুর ট্রাক তো মানুষ মারেনি বা কাউকে অসহনীয়ভাবে আঘাত করেনি, যা পেট্রলবোমা করেছে।’ খুবই লাগসই যুক্তি। কিন্তু পেট্রলবোমার রাজনীতি যে বালুর ট্রাক থেকে সৃষ্ট, এ কথা অস্বীকার করার কি উপায় আছে? এখানে আমরা বালুর ট্রাককে নিছক একটি ‘ট্রাক’ হিসেবে দেখছি না। ‘বালুর ট্রাক’ হলো প্রধান বিরোধী দলকে তার বক্তব্য বা প্রতিবাদ প্রকাশ করার পথে সরকারি প্রতিবন্ধকতার প্রতীক। বালুর ট্রাক দিয়ে বাধা সৃষ্টি করার সময় সরকার একবারও মনে করেনি যে অদৃশ্য শত শত বালুর ট্রাক দেশের সব হাইওয়েতে দিনের পর দিন (এক মাসেরও বেশি) যান চলাচলে বাধাগ্রস্ত করতে পারে। রুগ্ণ রাজনীতির প্রতিবাদ তো রুগ্ণ রাজনীতি দিয়েই হবে।
দেশে এখন রাজনীতির নামে পেট্রলবোমার সহিংসতা চলছে, যার নিন্দা করার ভাষা আমাদের নেই। এর নাম রাজনীতি হতে পারে না। এটা রাজনৈতিক প্রতিবাদের কোনো কর্মসূচিও হতে পারে না। এসব সন্ত্রাসীকে আইনের মাধ্যমে কঠোর শাস্তি দেওয়া প্রয়োজন। ক্রসফায়ার নতুন সংকট ডেকে আনতে পারে। সরকার দাবি করেছে, ‘বিএনপি-জামায়াত জোট এই বর্বরতা চালাচ্ছে।’ বিএনপি দাবি করেছে, ‘সরকারের এজেন্টরা এই বোমাবাজি করে বিএনপির ওপর দায় চাপাচ্ছে।’ অন্তত ছয় মাস আগে প্রথম আলো পত্রিকায় এক কলামে আমি লিখেছিলাম, ‘বিএনপি শান্তিপূর্ণ আন্দোলন করতে চাইলেও সরকার তা হতে দেবে না। সরকারের এজেন্টরা আন্দোলনকে সহিংসতার দিকে নিয়ে যাবে। আর সহিংসতার অভিযোগে বিএনপির নেতাদের পাইকারিভাবে গ্রেপ্তারের সুযোগ পাবে।’
আজ আমরা কী দেখছি? অনেক সময় রাজনৈতিক ভবিষ্যদ্বাণী মিলে যায়। সব সময় মেলে না। বিএনপি এখানে সরকারের কৌশলের কাছে আবার হেরে গেছে। বিএনপির দাবি অনুযায়ী যদি সরকারের এজেন্টরা এই বোমাবাজি করেও থাকে, তবু জনগণের কাছে সরকার এটা বোঝাতে সফল হয়েছে যে এই বোমাবাজি বিএনপি-জামায়াতই করছে। জনগণ এ জন্য এখন বিএনপি-জামায়াতের ওপরই ক্ষুব্ধ। বিএনপি এই সরকারি প্রচারণার যে প্রতিবাদ করেছে, তা খুবই মৃদু। বোমাবাজির বিরুদ্ধে জোরালো প্রতিবাদ বিএনপি করতে ব্যর্থ হয়েছে। এ জন্য সামনে আরও অনেক দিন বিএনপিকে এর ফল ভোগ করতে হবে। অনেক নিরীহ সাধারণ মানুষের অভিশাপ থেকে বিএনপি রেহাই পাবে না। এসব সাধারণ মানুষ রাজনীতির কূটচাল বোঝে না। সারা দেশে বিএনপির একটি খারাপ ভাবমূর্তি তৈরি হয়েছে। বোমাবাজির নীলনকশা করে এখানেই সরকারের সাফল্য (বিএনপির দাবি যদি সত্য হয়)।
জাতীয় সংলাপের ইস্যুতে আবার ফিরে আসি। অনেকে বলতে পারেন, ‘দেশের এই সংকট সমাধানের দায়িত্ব সরকারের। বিশিষ্ট নাগরিকদের এখানে করার কিছু নেই।’ আমরা মনে করি, এই ধারণা ঠিক নয়। কেন নয়, তার কয়েকটি কারণ দেখাতে চাই। ১. সরকার বিভিন্ন বাহিনীকে সর্বোচ্চ ক্ষমতা দিয়েও বোমাসন্ত্রাস, চোরাগোপ্তা হামলা বন্ধ করতে পারেনি। প্রতিদিন মানুষ মারা যাচ্ছে। বার্ন ইউনিটের আর্তনাদ আর সহ্য করা যাচ্ছে না। মানুষ চরম নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। হরতাল ও অব্যাহত অবরোধে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড স্থবির। আকাশযান ছাড়া অন্য সব আন্তজেলা যানবাহন প্রায় বন্ধ বা অনিয়মিত। দেশে একটা অস্বস্তিকর অবস্থা বিরাজ করছে। এভাবে দেশ চলতে পারে না। তাই দেশের স্বার্থে কাউকে না কাউকে উদ্যোগ নিতে হবে।
২. দেশে আজ যে পরিস্থিতি বিরাজ করছে, তার মূলে ৫ জানুয়ারির ‘প্রশ্নবিদ্ধ’ নির্বাচন। ৩. দেশটা শুধু আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও কয়েকটি রাজনৈতিক দলের নয়। ১৬ কোটি মানুষের। বিশিষ্ট নাগরিকেরা সাধারণ মানুষের পক্ষ থেকে দেশের সংকটকালে যে উদ্যোগ নিয়েছেন, তা সফল হলে বিশিষ্ট নাগরিকেরা লাভবান হবেন না। দিনের শেষে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনই হবে। আর তাতে অংশ নেবেন রাজনৈতিক নেতারাই। বিশিষ্ট নাগরিকেরা নন।
৪. ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন ছিল প্রশ্নবিদ্ধ। ২০ শতাংশ ভোটারও তাতে অংশ নেননি। ১৫৪ জন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছিলেন। সংসদে একটি কৃত্রিম ও গৃহপালিত বিরোধী দল সাজানো হয়েছে। এর কোনোটাই গণতন্ত্রের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়। দেশে স্বাভাবিক রাজনৈতিক পরিবেশ ফিরিয়ে আনার জন্য একটি অংশগ্রহণমূলক গ্রহণযোগ্য নির্বাচন প্রয়োজন। ৫. দুটি বড় দলের ও দুই নেত্রীর জেদাজেদির জন্য আমাদের এই সম্ভাবনাময় দেশ, দেশের অর্থনীতি রসাতলে যেতে পারে না। ৬. দলের চেয়ে দেশ বড়। ৭. নির্বাচন পরিচালনা, নির্বাচনকালীন সরকার প্রশ্নেও একটা সমঝোতা হতে হবে। আর এই সমঝোতার জন্য প্রয়োজন হবে একটি তৃতীয় পক্ষ। এঁরা হবেন দেশের নেতৃস্থানীয় ও নিজ নিজ পেশায় যাঁদের ব্যক্তিগত অবদান অতুলনীয়। শুধু রাজনীতিবিদেরা মিলে এই সমঝোতা করতে পারবেন না। রাজনীতিতে দলের বাইরে সাধারণ মানুষ ও নির্বাচনে সাধারণ ভোটারদের স্বার্থ খুব গুরুত্বপূর্ণ। ৮. শুধু একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হলেই দেশে শান্তি ফিরে আসবে না। কারণ, রুগ্ণ ও দূষিত রাজনীতি আমাদের সরকারের প্রশাসনিক কাঠামো, জাতীয় সংসদ, বিভিন্ন সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান, বিচারব্যবস্থা ইত্যাদিকে অনেক দুর্বল করে দিয়েছে। দলীয়করণ ছাড়া বড় দুটি দল এখন সরকার পরিচালনার কথা চিন্তাই করতে পারে না। কাজেই নির্বাচনোত্তর দেশের পরিস্থিতির কথা চিন্তা করে রাজনৈতিক দলগুলোকে একটি ‘জাতীয় সনদে’ স্বাক্ষর করতে হবে।
আমরা মনে করি, ‘জাতীয় সনদ’ গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মতোই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, সুস্থ নির্বাচনে জয়ী দলও সরকার পরিচালনার নামে দেশে জমিদারি রাজ কায়েম করতে পারে। এটা গণতান্ত্রিক দেশ। এখানে কেউ যাতে ভবিষ্যতে ‘নির্বাচিত স্বৈরাচার’ বা ‘পরিবারতন্ত্র’ বা ‘জমিদারি ব্যবস্থা’ চালু করতে না পারেন, সে জন্য জাতীয় সনদে ব্যবস্থা থাকতে হবে।
তবে জাতীয় সনদ এখনো আমাদের কাছে পুরোপুরি স্পষ্ট নয়। যদিও ‘সুজন’ তাদের ফোরামের পক্ষ থেকে কিছু বক্তব্য প্রকাশ করেছে। বৃহত্তর নাগরিক সমাজের কয়েকজন প্রতিনিধি জাতীয় সনদের মুসাবিদা করেছেন। আমরা অনুরোধ করব, গণমাধ্যমে এর খসড়া প্রকাশ করা হোক, যাতে সাধারণ মানুষ খসড়া সনদ সম্পর্কে তাঁদের মতামত দিতে পারেন। এমনকি রাজনৈতিক দল, নেতা-কর্মীরাও তাঁদের মতামত দিতে পারেন।
এসব কারণে বিশিষ্ট নাগরিকদের এই উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। এখানে উল্লেখ করা যায়, গুরুত্বপূর্ণ অনেক রাষ্ট্র ও জাতিসংঘের পক্ষ থেকে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে বর্তমান সংকট নিরসনের জন্য সরকার ও রাজনৈতিক দলের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে। কাজেই নাগরিকদের এই উদ্যোগ বিচ্ছিন্ন বিষয় নয়। বরং আরও আগেই এই উদ্যোগ নেওয়া উচিত ছিল।
এই উদ্যোগ নির্দল নাগরিকদের উদ্যোগ। আমাদের ধারণা, রাজনীতিবিদ পরিচয়ে পরিচিত ব্যক্তিদের এই উদ্যোগে রাখা ঠিক হবে না। বরং এই কমিটি রাজনীতিবিদদের কথা শুনতে যাবে।
এ রকম একটি উদ্যোগের প্রতি সরকার কী অবস্থান গ্রহণ করবে, আমরা জানি না। সরকারের নানা মন্ত্রী, এমনকি প্রধানমন্ত্রী ‘সংলাপ’ নিয়ে নানা নেতিবাচক মন্তব্য করেছেন। আশা করি সরকার পুরো পরিস্থিতির গুরুত্ব অনুধাবন করে বিশিষ্ট নাগরিকদের এই উদ্যোগকে স্বাগত জানাবে এবং সহায়তা করবে। ‘সন্ত্রাসী দলের’ সঙ্গে কথা বলতে সরকার রাজি না হতে পারে, কিন্তু ‘বিশিষ্ট নাগরিকদের’ সঙ্গে দেশের স্বার্থে কথা বলতে সরকার রাজি হবে, এটাই আশা করা যায়।
বর্তমান পরিস্থিতিতে একটা কথা সবাইকে মনে রাখতে অনুরোধ করি। এই দেশটার মালিক দুটি দল নয়। কোনো নেতাও এই দেশের মালিক নন। দেশের মালিক জনগণ। রাজনৈতিক দলের নেতা–নেত্রীরা অস্থায়ী। নেতা পরিবর্তনশীল। কিন্তু দেশ ও জনগণ পরিবর্তনশীল নয়। বড় দুই দলের প্রতিহিংসা ও দুই নেত্রীর জেদাজেদির কাছে আমাদের দেশ জিম্মি হতে পারে না।
বিশিষ্ট নাগরিকদের এই উদ্যোগ নিয়ে দেশব্যাপী ও মিডিয়ায় ব্যাপক আলোচনার ব্যবস্থা করে জনমত গঠন করা হোক। আশা করি জনমতের চাপেই সরকার একটা সমঝোতায় আসবে ও বিভিন্ন দল ‘জাতীয় সনদে’ স্বাক্ষর করবে। এই মুহূর্তে জনমত গঠন জরুরি।
মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর: মিডিয়া ও উন্নয়নকর্মী।