জান-মান-জবানের দাবি ও নিরস্ত্র বাংলা

শিশুদের বানানো ভালোবাসার মিনার
শিশুদের বানানো ভালোবাসার মিনার

এই দিনে তারা খালি পায়ে দেশের বুকে নরম পা ফেলে হাঁটবে। সবার গন্তব্য একটাই, যার যার কাছের শহীদ মিনার। আর সবখানেই তা আছে। যে মাটিতে খালি পায়ে হাঁটতে হয়, তা নিশ্চয়ই পবিত্র। ঢাকা শহরে মাটি নেই, আছে কালো পিচ। কিন্তু গ্রাম-মফস্বলে ফাল্গুনের সকালে খালি পায়েই শহীদ মিনারে স্মৃতিতর্পণ করা হয়। এর থেকে সুন্দর আর কী হয়?
এই সুন্দরের তলায়ও দুঃখ আছে। এ দেশের ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ মানুষ আজও অশিক্ষিত। ঠিক তত মানুষই দরিদ্র মানবেতর। ভাষার সঙ্গে শিক্ষার যে সম্পর্ক, শিক্ষার সঙ্গে সম্পদ ও ক্ষমতারও সেই সম্পর্ক। এই নিরক্ষর, শিক্ষাবঞ্চিত দরিদ্র মানুষের সন্তানেরাও ফুল হাতে শহীদ মিনারে যায়। পাড়া-মহল্লায়, বস্তিতে তারাও যা আছে তা দিয়ে স্মৃতির মিনার গড়ে। মাতৃভাষাই তো চাকরির হাতিয়ার, জীবিকার অস্ত্র, সম্মানের দাবি। জমি-সহায়-ক্ষমতা কেড়ে নেওয়া গেলেও মুখের ভাষাটাই একমাত্র, যা কেড়ে নেওয়া যায় না। অথচ বাংলায় শিক্ষিতরা ইংরেজির কাছে নত থাকে, এই বাংলাদেশে। ভাষাবঞ্চনা তাই অধিকারবঞ্চনারই অপর নাম।
অথচ রাষ্ট্রভাষা দাবির স্লোগান কৃষকের আঞ্চলিক ভাষাতেই উচ্চারিত হয়েছিল: ‘ওরা আমার মুখের ভাষা কাইড়া নিতে চায়’ কিংবা ‘রে বাঙালি ঢাকার শহর রক্তে ভাসাইলি’। সবার জন্য সহজবোধ্য বাংলা ভাষাকে বলা হবে মান বাংলা। কিন্তু একে বলে প্রমিত, যেন অন্যগুলো অপ্রমিত, ব্রাত্য। ঠিক যেমন কেউ কেউ সুশীল; তবে কি বাকিরা দুঃশীল? ভাষার মধ্যে এভাবে শ্রেণির দেমাগ কাজ করে। যাঁরা আঞ্চলিক বাংলাকে উপভাষা বলে অশুদ্ধ বলতে চান, তাঁরা জানেনও না, ভাষাবিজ্ঞানে সবার মুখের সব ভাষাই শুদ্ধ।
ভাষা আন্দোলনে জীবন দিয়েছিল কৃষক ও নিম্নমধ্যবিত্ত ঘর থেকে পড়তে আসা ছাত্ররা। ’৪৭ থেরক ’৫২ পর্যন্ত তীব্র খাদ্যাভাব চলছিল গ্রামবাংলায়। সেই হাভাতে কৃষকেরাও ঢাকায় ছাত্রদের বুকে গুলি চলেছে শুনে বিভিন্ন স্থানে কর্মবিরতি করেছিলেন। প্রতিবাদে দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষ রিলিফের চাল নিতে রাজি হয়নি। এ রকম বিস্তর বিবরণ বদরুদ্দীন উমরের গবেষণাগ্রন্থ পূর্ব বাঙলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি বইয়ে মিলবে।
বাঙালির যখন রাষ্ট্র ছিল না, তখনো ভাষা ছিল। ভাষাই আদি কারণ, যার জন্য বাঙালি ও বাংলাদেশ আছে। পৃথিবীতে ভাষা থেকে রাষ্ট্র হওয়ার এমন নজির বিরল। বলা হয়, ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদের ফল বাংলাদেশ। তাহলে ভাষার জন্ম দিল কে? ভাষার জন্ম দেয় জনগণ। আবার ভাষার মধ্য দিয়েই মানুষ মানুষ হয়ে ওঠে, সমাজ ও কারবার চালায়। বাংলা ভাষার জয়-পরাজয় এবং জাতির সাফল্য-ব্যর্থতার প্রধান মানদণ্ড এর ভাষাভাষীরা। জনগণ যদি ভালো না থাকে, তাহলে বাংলা ভাষা ভালো থাকে কী করে?
এবং এই জনগণের সবচেয়ে বড় অবদান হলো সমাজ-সংস্কৃতির অসাম্প্রদায়িকীকরণ। উনিশ শতকে ব্রিটিশ উপনিবেশের রাজধানী কলকাতার রাজনীতি ও সংস্কৃতির চালচলন ছিল উঁচুতলার। জনসংস্কৃতি ও মুখের ভাষা থেকে দূরে যাওয়াকেই কৃতিত্ব ভাবা হতো। এ জন্যই তা ছিল গণবিরোধী ও সাম্প্রদায়িক। ’৪৭ সালের পর পূর্ব বাংলার মানুষ হিন্দু-মুসলিম সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে জোট বাঁধে। খাদ্যসংকট ও নিপীড়নে পর্যুদস্ত কৃষকদের পাকিস্তানের সাধ মিটে যায়। আমলা আর নবাবজাদাদের দাপটে ফুঁসছিল মধ্যবিত্ত শ্রেণিও। ওই রাষ্ট্র পূর্ব বাংলার জান, মান ও জবানকে চেপে ধরেছিল। এসবের বিরুদ্ধে দানা বাঁধছিল এক ঐতিহাসিক জোট। ইতালীয় মার্ক্সবাদী তাত্ত্বিক আন্তোনিও গ্রামসি বলেন, হিস্টোরিক্যাল ব্লক বা ঐতিহাসিক জোট তখনই গঠিত হয়, যখন অর্থনৈতিক ভিত আর রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক ছাউনি এক হয়ে যায়। অন্যভাবে বললে, ঐতিহাসিক জোট হলো এমন এক সমধর্মী জোট, যাদের স্বার্থ এক, পরিচয় এক, উদ্দেশ্য এক। ভাষা ও অর্থনৈতিক স্বার্থ ছিল এই ঐক্যের যুগল বেণী। সম্প্রদায়ের চাইতে বড় হয়ে ওঠে জাতি। এভাবে বায়ান্নর মাধ্যমে সম্প্রদায়ভিত্তিক হিন্দু ও মুসলিম জাতীয়তাবাদ ওরফে দ্বিজাতিতত্ত্বের সংশোধন ঘটায় পূর্ব বাংলার মানুষদের ঐতিহাসিক জোট। এই জোট একাত্তর পর্যন্ত অটল ছিল। বাংলাদেশের জনগণের চেতনায় মানবিক পলির মতো এখনো তা আছে। এখনো এর শক্তি কম নয়। শাহবাগ আন্দোলনের মধ্যে সেই ঐতিহাসিক জোটবদ্ধতার স্মৃতিরই সাময়িক জাগরণ ঘটেছিল। শাসকেরা তার সঙ্গে প্রতারণা করেছে, বিপথে চালনা করেছে। তারপরও যখনই দেশের মানুষের জান, মান ও জবানের ওপর আঘাত আসবে, তখনই বায়ান্নর ওই ঐতিহাসিক ব্লকের জাগরণ ঘটবে।

দুই.
কিন্তু বিপদ আসছে অন্যদিক থেকে। ভাইরাসের মতো তা ঘরে ঘরে সংক্রমণ ঘটাচ্ছে। এই বিপদের নাম হলো বিস্মরণ। বাংলা ভাষা ভুলে হিন্দি ও ইংরেজিতে কথা চলা-বলা শুরু করেছে আমাদেরই সন্তানদের একটি অংশ। নিজ ভাষা ও সংস্কৃতির ব্যাপারে তাদের মন ছোট হয়ে যায়। নিজের ইতিহাস–সংস্কৃতি ভুলে গিয়ে তারা গায় ‘একদিন বাঙালি ছিলাম রে’! এই বিস্মরণ এসেছে বিশ্বায়নের ঢেউয়ে সওয়ার হয়ে। এই ভাইরাস ছড়াচ্ছে টেলিভিশন, বিজ্ঞাপন ও পাশ্চাত্যের ভোগবাদী জীবনধারা থেকে। অন্যদিকে পাঠ্যপুস্তকে দুর্বল ভাষার দুর্বল রচনা বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে নিজ ভাষার প্রতিই বিরক্তি জাগাচ্ছে। ইংরেজিমাধ্যমে দেশের সাহিত্য ও ইতিহাসের স্থান মাত্র কয়েক পাতা। মাদ্রাসামাধ্যমেরও অবস্থা তাই। বাংলা কি তবে কেবলই কাজের ভাষা? কাজের লোকের ভাষা? উচ্চ আদালতে, উচ্চশিক্ষায়, উচ্চমহলে তার দাম নেই কেন? শুনি তো দেশ চালায় বাংলাভাষীরাই!
তিন ধরনের শিক্ষা তিন ধরনের সংস্কৃতি তৈরি করছে এবং এরা পরস্পরকে চিনছে না, জানছে না। সময়ে সময়ে এদের মধ্যে সংঘাতও ঘটতে দেখা যাচ্ছে। এই ফাটল বাড়তে দিলে, এভাবে দেশের ভেতরে বিদেশ তৈরি হলে বিপদ আসন্ন। সর্বভাষা ও সর্বসংস্কৃতির প্রতি সম্মান এক জিনিস, কিন্তু নিজের ভাষা ও সংস্কৃতিকে খাটো করে তা হতে হবে কেন?
এসব দেখে দেখে শহীদ মিনারগুলো দুঃখে ও লজ্জায় আরও নত হয়। ভাষা আন্দোলনের স্মৃতি তবু অতীত হতে অস্বীকার করে। তার চাই হাটে-মাঠে, শ্রেণিকক্ষে, টেলিভিশনে, সাহিত্যে, কারখানায় ও জমিতে প্রতিদিনের জীবন্ত প্রকাশ। ‘আমি কি ভুলিতে পারি’ বলে যে ব্যথার শুরু, দেশময় ছড়ানো শহীদ মিনার সেই স্মৃতির জাগরণের প্রতীক। অশুভের বিরুদ্ধে, বিস্মরণের বিরুদ্ধে বায়ান্নর স্মৃতি প্রতিষেধক। একে মৃত ইতিহাস বানিয়ে ফেলা চলবে না।
যখনই জাতির হৃদয়ের কাছে যাওয়ার দরকার হয়, রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সমাজ ফরিয়াদ জানানোর দরকার বোধ করে, তখনই শহীদ মিনার হয় গন্তব্য। জাতির ভালোবাসার মানুষের অন্তিম বিদায়ের মঞ্চও শহীদ মিনার। শহীদ মিনারকে সাক্ষী রেখে ভালোবাসা, সংগ্রাম ও শপথ নেওয়ার রেওয়াজ আমাদের দুনিয়াবি আধ্যাত্মিকতা। একুশ ছিল ক্রোধ আর সংগ্রামের, তাকে করুণ গানের আসরে বসিয়ে রাখা যাবে না।
ভাষা আন্দোলনের চেতনা নিছক বাঙালি জাতীয়তাবাদের চেতনা নয়। এটা হলো সেই ভিত্তি প্রতিষ্ঠাকারী ঘটনা, যার থেকে মুক্তির সব পথেই এগোনো সম্ভব—জাতীয়তাবাদ যার একটি। এর মধ্যে সর্বভাষার, সব মাতৃভাষার মর্যাদার স্বীকৃতি ছিল। মনে রাখা দরকার, ‘শহীদ মিনার’ শব্দযুগল বাংলা নয়। এটাই প্রমাণ, অন্য ভাষার প্রতি বিদ্বেষ একুশের পরিপন্থী। আটই ফাল্গুনের বদলে একুশে ফেব্রুয়ারি, স্মৃতিসৌধ না বলে শহীদ মিনার বলা দিয়ে বোঝায় যে ভাষাবিদ্বেষ নয়, জাতিবিদ্বেষ নয়, ধর্মবিদ্বেষ নয়; বরং সর্বভাষার সর্বজনের জান–জবানের অধিকারের কথাই শহীদ মিনার বলবে। সটান শিরদাঁড়া তবু নতমুখ ভঙ্গিমা দিয়ে বলে, জাতীয়তাবাদের উদ্ধত গর্ব এ নেবে না। মুক্তিযুদ্ধের জাতীয় স্মৃতিসৌধ মহাকাব্যিক, শহীদ মিনার লোকগানের মতোই সহজিয়া। জাতীয় স্মৃতিসৌধ রাষ্ট্রিক, শহীদ মিনার সামাজিক। সম্ভবত, বিশ্বে এতো বেশি সংখ্যার প্রতীক খুব কমই আছে, যা সর্বধর্ম-জাতি-মতের শ্রদ্ধা পায়। শহীদ মিনার সবার। কে সেখানে যাবে আর কে যাবে না, তা ঠিক করার অধিকার একমাত্র জনগণের। রাষ্ট্র বা পুলিশের এখানে কিছু করার দরকার নেই।
একুশের শক্তি কমে না। দুই বাংলার বাঙালি ছাড়াও বাংলাদেশ ও ভারতের অপরাপর জাতির মানুষও এর প্রেরণাতেই মাতৃভাষার অধিকার দাবি করে আসছে। সম্প্রতি ভারতে হিন্দি ভাষার বিরুদ্ধে বাংলা, অসমিয়া, তামিল ভাষাসংগ্রামীরা একুশের নাম নিচ্ছেন। একুশের অমরতা কেবল কথার কথা না। এর সম্ভাবনা এখনো অফুরান—দেশে বা বিদেশে।
ফারুক ওয়াসিফ: সাংবাদিক ও লেখক।
[email protected]