জানে পানি নাই, চাঁদে আছে

প্রথমেই আপনার জানা সেই কৌতুকটা মনে করুন। আমরা যে কলম ব্যবহার করি, সেটা বলপয়েন্ট হোক আর ঝরনা কলমই হোক, কাজ করে মাধ্যাকর্ষণ শক্তি দিয়ে। মাধ্যাকর্ষণের জন্য এর কালি নিচের দিকে নামে। কাজেই আপনি যদি কলম ওপর দিকে ধরে লেখার চেষ্টা করেন, লেখা হবে না।

তো মহাকাশে মাধ্যাকর্ষণ শক্তি নেই। সেখানে কলম কাজ করবে না। আমেরিকানরা মহাশূন্যে নিয়ে যাওয়ার জন্য কলম আবিষ্কার করে ফেলল। খরচ হলো এক বিলিয়ন ডলার। রুশরা নিয়ে গেল দুই টাকার পেনসিল। এই দুদিন আগে একটা যুগান্তকারী আবিষ্কারের ঘোষণা এসেছে নাসা থেকে। চাঁদে পানি আছে।

১৯৬৯ সালে মানুষ চাঁদে গেছে; চাঁদের মাটি নিয়ে এসেছে; ৫১ বছর ধরে কী গবেষণা করেছে কে জানে। সোফিয়া নামের একটা নভোযান থেকে ইনফ্রারেড রশ্মি দিয়ে ছবি তুলে উপাত্ত বিশ্লেষণ শেষে নাসা এই সিদ্ধান্তে এসেছে যে চাঁদে পানি আছে। আর তা শুধু চাঁদের অন্ধকার দিকে আছে তা নয়, সূর্যালোকিত পিঠেও আছে।

আগে একটা কৌতুক বলে নিই।

শিক্ষক: জোসেফ প্রিসলি ১৭৭৪ সালে অক্সিজেন আবিষ্কার করেন।

ছাত্র: অক্সিজেন আবিষ্কারের আগে মানুষ শ্বাস নিত কীভাবে, স্যার?

সত্যি তো, ১৭৭৪ সালে অক্সিজেন আবিষ্কৃত হলো, ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধের সময় সিরাজউদ্দৌলা কিংবা রবার্ট ক্লাইভ শ্বাস নিতেন কীভাবে?

তো মানুষের চাঁদে যাওয়ার ৫১ বছর পর একটা নভোযান থেকে বিশেষ ধরনের টেলিস্কোপ দিয়ে উপাত্ত সংগ্রহ করে কম্পিউটারে ডেটা অ্যানালাইসিস শেষে বিজ্ঞানীদের সিদ্ধান্ত: চাঁদে পানি আছে।

এই আবিষ্কার যুগান্তকারী। কারণ, চাঁদের পানি ভবিষ্যতে রকেটে জ্বালানি ভরতে সাহায্য করবে। মানুষকে কষ্ট করে বেশি পরিমাণে পানি নিয়ে চাঁদে যেতে হবে না।

এই কথা শুনে নিশ্চয়ই আমেরিকানরা জানে পানি ফিরে পাচ্ছে। করোনার আঘাতে এ পর্যন্ত মারা গেছেন ২ লাখ ২৯ হাজার আমেরিকান। আক্রান্ত হয়েছেন প্রায় ৯০ লাখ আমেরিকান। বিল গেটস কবেই সতর্ক করে দিয়েছিলেন যে ভাইরাসের আক্রমণ আসন্ন। ভাইরাস গবেষণায় আমেরিকা অর্থ বরাদ্দ কমিয়ে দিয়েছে। জনস্বাস্থ্য নিশ্চিত করতে, সবার জন্য চিকিৎসা নিশ্চিত করতে ট্রাম্প প্রশাসনের কোনো উদ্যোগ ছিল না। আমেরিকায় গরিব মানুষের জন্য কোনো চিকিৎসা নেই। ওবামা কিছুটা চেষ্টা করেছিলেন। রিপাবলিকানরা সেসবের তীব্র সমালোচক। আমাদের টাকা কেন আমরা গরিব মানুষের চিকিৎসায় ব্যয় করব?

মানুষের চিকিৎসার জন্য, স্বাস্থ্যের জন্য বরাদ্দ নেই, কিন্তু মানুষ মারার জন্য ঠিকই বরাদ্দ আছে। আমেরিকানরা একবার ঠিক করেছিল, তারা চাঁদকে ধ্বংস করে দেবে। এটা করা হবে রাশিয়াকে দেখানোর জন্য যে দেখো, আমেরিকা কত কী পারে! বিবিসি বাংলা অনলাইন থেকে খবরের এই অংশটা উদ্ধৃত করে দিচ্ছি:

যুক্তরাষ্ট্র একবার সত্যি সত্যিই চাঁদের ওপর পারমাণবিক বোমার বিস্ফোরণের কথা চিন্তা করেছিল। উদ্দেশ্য ছিল এর মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক শক্তি প্রদর্শন করা। বিশেষ করে রাশিয়াকে ভয় দেখানো। যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসার অত্যন্ত গোপনীয় এই পরিকল্পনার নাম ছিল ‘এ স্টাডি অব লুনার রিসার্চ ফ্লাইটস’ অথবা ‘প্রজেক্ট এ ১১৯’। (৩০ সেপ্টেম্বর ২০১৮)

১৯৬০ থেকে ১৯৭৩ পর্যন্ত অ্যাপোলো প্রকল্পে আমেরিকা খরচ করেছে সরাসরি ২৮ বিলিয়ন ডলার। মুদ্রাস্ফীতির কারণে তার বাস্তব মূল্য দাঁড়িয়েছিল ২৮৩ বিলিয়ন ডলার। মানে হলো ২৮ হাজার ৩০০ কোটি ডলার। আর চলতি বছর ২০২০-এ নাসার জন্য বরাদ্দ হয়েছে ২২ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলার। ২ হাজার ২৬০ কোটি ডলার। মানে প্রায় দুই লাখ কোটি টাকা। বাংলাদেশের ২০২০-২১ সালের বাজেট ৫ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকা, তার সঙ্গে তুলনা করলে ব্যাপারটা কিছুটা বোঝা যাবে।

আমেরিকা করোনাভাইরাসের সঙ্গে পারে না। মানুষ করোনাভাইরাসের সঙ্গে পারে না। কিন্তু মানুষ চাঁদে গেছে ৫১ বছর আগে। আবারও চাঁদে যাওয়ার অভিযান শুরু হচ্ছে। এবার নারীও যাবেন। এরপর ২০৫০ সালের মধ্যে মানুষ মঙ্গলেও যাবে। তো সে জন্যই চাঁদে পানি পাওয়ার খবরে আপনার জানে পানি আসা উচিত। কারণ, পানি থাকা মানেই সেখানে বসবাসের সম্ভাবনা বেড়ে যাওয়া। মানুষ চাঁদে থাকবে নাকি মঙ্গলে থাকবে, সেই গবেষণা অবশ্যই এগিয়ে নিতে হবে। পৃথিবীটা মনুষ্য বসবাসের অযোগ্য হয়ে উঠছে। জলবায়ু দ্রুত বদলে যাচ্ছে। তুষার গলে যাচ্ছে, সমুদ্রের পিঠ উঁচু হচ্ছে। রাতের তাপমাত্রা এরই মধ্যে ১ ডিগ্রি বেড়ে গেছে।

তবে স্টিফেন হকিং যেমনটা মনে করেন, পৃথিবী বাইরের কোনো এলিয়েন এসে ধ্বংস করবে না, পৃথিবী ধ্বংস হবে মানুষেরই হাতে। যত পরিমাণ মারণাস্ত্র পৃথিবীতে মজুত করা আছে, কোনো একজন পাগলা শাসক কিংবা কোনো মানসিক অসুস্থ নৈরাজ্যবাদী যদি কোনো একটা পরমাণু বোমার গোপন চাবি বা পাসওয়ার্ড পেয়ে যায় আর বোতাম টিপে দেয়, তাহলে সারা পৃথিবীর সব মারণাস্ত্র পরস্পরের দিকে ছুটতে শুরু করবে আর পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে। তো পৃথিবী যদি ধ্বংস হয়ই, মানুষের তো বসবাসের জন্য বিকল্প জায়গা লাগবে। চাঁদে পানি আছে শুনে তাই আমাদের জানে পানি আসা উচিত। মানুষ অন্য গ্রহ-উপগ্রহে গিয়ে হলেও তার ধারাবাহিকতা ধরে রাখবে। চাঁদে যে পরিমাণ পানি আছে, তা আগে ধারণা করা পরিমাণের চেয়ে অনেক বেশি। তা সত্ত্বেও তা সাহারা মরুভূমির চেয়ে অনেক কম।

আমরা যখন বন্যার পানিতে ভাসছি, বৃষ্টি হলেই যখন ঢাকা শহর পানির নিচে তলিয়ে যায়, তখন সাহারা মরুভূমির চেয়ে কম পানি চাঁদের গায়ে আছে, এই সম্ভাবনায় খুশি হতে গিয়ে একটা প্রশ্ন মাথায় এসেই যায়। সেটা হলো, চাঁদে কিংবা মঙ্গলে গিয়ে থাকার চেয়ে পৃথিবীটাকেই সুন্দর করা, মানুষের বসবাস উপযোগী রাখা কি অনেক সহজ, অনেক সস্তা ছিল না?

তাহলে চাঁদে পানি পাওয়ার খবর কেন এত গুরুত্বপূর্ণ? এটার গুরুত্ব বেশি মানেই হলো পৃথিবীটা যে বাঁদরের হাতে তরবারির নিচে নিজের মাথা পেতে রেখেছে, সে বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া।


আনিসুল হক: প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক ও সাহিত্যিক