জাপানে আমাদের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী ও দেশের ভাবমূর্তি

দেশের কথা বিদেশিদের সামনে সঠিকভাবে তুলে ধরতে হলে যে সংবাদ সম্মেলনের বিকল্প নেই, সেই সত্য জেনেছি দীর্ঘ প্রবাসজীবনে সংবাদকর্মী হিসেবে কাজ করার অভিজ্ঞতা থেকে।

বিদেশে আমার বসবাস বিরতিসহ চার দশক হতে চলল। এই দীর্ঘ সময়ে লক্ষ করেছি, বিদেশ সফরে গিয়ে বাংলাদেশের নেতারা বিদেশি সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলতে সহজ বোধ করেন না। দেখা যায়, বিদেশেও দেশের কিছু সাংবাদিকের সঙ্গে কথা বলে তাঁরা দেশে ফেরেন, কিংবা বিদেশি সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ পেলেও এড়িয়ে যান। আমাদের দূতাবাসগুলো যেন ধরে নেয় সংবাদ সম্মেলনের ব্যবস্থা করলে সেখানে বিদেশি সাংবাদিকেরা এমন প্রশ্ন করতে পারেন, যা বাংলাদেশের নেতাদের কাছে অপ্রীতিকর বা বিব্রতকর মনে হতে পারে। ফলে হয়তো দূতাবাসের কর্মকর্তাদের পেশাগত দিক থেকে অসুবিধার মুখে পড়তে হবে। সম্ভবত এ কারণেই বিদেশের সংবাদমাধ্যমে বাংলাদেশের নেতিবাচক দিকগুলো তুলে ধরা হলে সেগুলো শুধরে নেওয়ার পথ তেমন একটা থাকে না। দূতাবাসের প্রতিবাদপত্র ছাপা হলেও পাঠকেরা তা আমলে নেন না, কারণ তাঁরা জানেন প্রতিবাদপত্র পাঠানো কূটনীতিকদের গতানুগতিক পেশাগত দায়িত্বের অংশ।

ফলে নেতিবাচক ধারণা শুধরে নেওয়ার সবচেয়ে জুতসই পথ হচ্ছে বিদেশ সফরে গিয়ে সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য দেওয়ার সুযোগ পাওয়া গেলে সেটার পুরোপুরি সদ্ব্যবহার করা, যেমনটা কিছুদিন আগে টোকিও সফরে এসে করে গেলেন বাংলাদেশের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ শাহরিয়ার আলম। সাংবাদিকেরা যে সব সময় দোষ–ত্রুটি খুঁজে দেখায় তৎপর নন, সেই প্রমাণও তিনি সম্ভবত পেয়েছেন টোকিওর বিদেশি সাংবাদিকদের প্রেসক্লাবে বক্তব্য দিতে গিয়ে। তিনি এশিয়ার ভবিষ্যৎ বিষয়ে জাপানের নেতৃস্থানীয় অর্থনৈতিক দৈনিক নিক্কেই শিম্বুন আয়োজিত সিম্পোজিয়ামে যোগ দিতে এই মাসের শুরুতে জাপানে এসেছিলেন। সিম্পোজিয়ামে অংশগ্রহণের বাইরে তিনি জাপানের উন্নয়ন সহযোগিতা এজেন্সি জাইকার প্রেসিডেন্ট এবং জাপানের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতার বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা করেছেন।

জাপান ত্যাগ করার আগে গত বুধবার তিনি টোকিওর বিদেশি সাংবাদিকদের ক্লাবে আয়োজিত এক সাংবাদিক সমাবেশে ভাষণ দেন এবং বিদেশি ও জাপানি সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন। ভাষণে তিনি বলেন, দুই দেশের সম্পর্ক এখন বৈদেশিক সাহায্য থেকে সরে এসে ক্রমেই বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক সহযোগিতার আকার নিচ্ছে। তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশ জাপানের বিনিয়োগকে উদারভাবে স্বাগত জানাচ্ছে এবং জাপানের ব্যবসায়ী সমাজও বাংলাদেশে বিনিয়োগের ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা অনুধাবন করতে পারছে বলেই জাপানের অনেক কোম্পানি এখন বাংলাদেশে তাদের উপস্থিতি সম্প্রসারিত করে চলেছে। দৃষ্টান্ত হিসেবে বাংলাদেশে ৪৪৫টি জাপানি কোম্পানির ব্যবসায় নিয়োজিত থাকার উল্লেখ করে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বলেছেন যে বাংলাদেশ আশা করছে আগামী বছরগুলোতে এই সংখ্যা হাজার ছাড়িয়ে দুই হাজারের ঘরে পৌঁছে যাবে।

পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর সংক্ষিপ্ত বক্তব্যের পর উপস্থিত সাংবাদিকেরা বাংলাদেশ-জাপান সম্পর্ক এবং বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি ও নিরাপত্তাব্যবস্থা নিয়ে বিভিন্ন প্রশ্ন করেন। পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী গত বছর জুলাই মাসে ঢাকায় সন্ত্রাসী হামলায় জাপানিসহ অন্য কয়েকজন বিদেশি নাগরিকের নিহত হওয়ার বিষয়টি অল্প কথায় বলেন। জাপানি ও অন্যান্য বিদেশি সাংবাদিকেরা জানতে চেয়েছিলেন সন্ত্রাস দমনে বাংলাদেশের সাফল্য-ব্যর্থতা সম্পর্কে, বিদেশিদের নিরাপত্তা কীভাবে বাংলাদেশ সরকার নিশ্চিত করছে সে বিষয়ে এবং তরুণেরা কেন ধর্মীয় সন্ত্রাসবাদের দিকে ঝুঁকছে সে সম্পর্কে।

প্রশ্নের উত্তরে শাহরিয়ার আলম বলেন, এক বছর আগে ঢাকায় সন্ত্রাসী হামলার পর থেকে সন্ত্রাসবাদ নির্মূলে নানা রকম প্রচেষ্টা বাংলাদেশ চালিয়ে যাচ্ছে এবং সরকারের এই দৃঢ় অবস্থান ইতিমধ্যে পরিস্থিতির যথেষ্ট উন্নতি ঘটাতে সাহায্য করেছে। তিনি বলেন, যেহেতু সন্ত্রাসী হয়ে কেউ জন্মগ্রহণ করে না, ফলে দেশের যুবসমাজের একটি অংশ কেন সন্ত্রাসবাদের দিকে আকৃষ্ট হচ্ছে তা নির্ধারণ করা গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশ সরকার সেই লক্ষ্যে ধর্মীয় নেতৃত্বসহ সমাজের বিভিন্ন অংশের প্রতিনিধিদের সঙ্গে নিয়ে সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলার কার্যকর পদক্ষেপ নিতে শুরু করেছে। তিনি বলেন, বাংলাদেশের আইন প্রয়োগকারী সংস্থা সন্ত্রাস দমনে দেশের ভেতরেই কেবল নয়, দেশের বাইরেও কার্যকর অবদান রেখে গেলেও বিদেশে এর মূল্যায়ন সেভাবে হচ্ছে না। বিদেশের রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও সংবাদমাধ্যম তাদের চোখে দেখা মানবাধিকার নিয়ে খুব বেশি ব্যস্ত থাকায় এমনকি নিজের দেশের সন্ত্রাসীরাও কখনো কখনো সঠিক তথ্য পাওয়া সত্ত্বেও নাগালের বাইরে থেকে যাচ্ছে বলে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী সন্দেহ ব্যক্ত করেন।

লন্ডনের সাম্প্রতিক সন্ত্রাসী হামলার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, সন্ত্রাস দমন তৎপরতায় চালানো কার্যক্রমে বাংলাদেশের নিরাপত্তা বাহিনী একসময় পূর্ব লন্ডনের একটি মসজিদ থেকে সন্ত্রাসী কার্যকলাপে অর্থসহায়তা দেওয়ার বিষয়টি জানতে পেরে ব্রিটিশ প্রতিপক্ষকে জানানো সত্ত্বেও ব্রিটেন কোনো রকম পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। বাংলাদেশের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বলেছেন যে তিনি মনে করেন, সেই তথ্যের ভিত্তিতে পদক্ষেপ নেওয়া হলে মর্মান্তিক ঘটনা এড়ানো হয়তো সম্ভব হতো।

পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আশা প্রকাশ করেন যে এক বছর আগের মর্মান্তিক ঘটনার পর জাপান বাংলাদেশে উন্নয়ন কর্মকাণ্ড কিছুটা গুটিয়ে নিলেও ভবিষ্যতে দ্রুতই সেই নেতিবাচক প্রবণতা কেটে যাবে এবং দুই দেশ আবারও বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক আরও এগিয়ে নিতে সক্ষম হবে। জাপান-বাংলাদেশ সম্পর্কের বাইরে সাম্প্রতিক বিশ্ব পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের অবস্থান এবং বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গা শরণার্থীদের বিষয়েও বিদেশি সাংবাদিকেরা তাঁর কাছে জানতে চেয়েছিলেন। সৌদি আরবের সঙ্গে কাতারের আকস্মিক টানাপোড়েন নিয়ে কোনো মন্তব্য করা থেকে তিনি বিরত থাকেন। তিনি বলেন, গভীর উদ্বেগ নিয়ে বাংলাদেশ সেদিকে নজর রাখছে। অন্যদিকে তিনি রোহিঙ্গা শরণার্থীদের বিষয়ে মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের আলোচনা চালিয়ে যাওয়ার বিষয় উল্লেখ করেন।

সার্বিকভাবে বলা যায়, বিদেশি সাংবাদিকদের সামনে বাংলাদেশের ইতিবাচক ছবি তুলে ধরতে তিনি সক্ষম হয়েছেন এবং উপস্থিত সাংবাদিকেরাও অন্য এক বাংলাদেশকে জানতে পেরেছেন, দেশটির যে পরিচয় তাঁদের কাছে সব সময় পৌঁছায় না। ফলে বিদেশে সংবাদ সম্মেলনের প্রসঙ্গ এলেই আঁতকে ওঠা নয়, বরং সেই সুযোগ কাজে লাগিয়েই যে দেশের ভাবমূর্তি আরও কিছুটা ঊর্ধ্বে তুলে ধরা সম্ভব, টোকিওতে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলন সেই সত্যতাই তুলে ধরছে।

মনজুরুল হক: শিক্ষক  সাংবাদিক