জাপানে সবার মুখে ঢাকা হত্যাকাণ্ড

জাপানে এখন সবচেয়ে আলোচিত সংবাদ হচ্ছে বাংলাদেশে সন্ত্রাসবাদীদের নৃশংসতা, যে নৃশংসতার কোপানলে প্রাণ দিতে হয়েছে
সাতজন নিরপরাধ জাপানি নাগরিককে। টেলিভিশন, সংবাদপত্র আর বিভিন্ন সামাজিক নেটওয়ার্কেই সেই আলোচনা সীমিত নেই, এমনকি তা ছড়িয়ে পড়েছে সরকারের বিভিন্ন দপ্তর, সওদাগরি কোম্পানির কার্যালয় আর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে।
মানুষ ভেবে পাচ্ছেন না মানুষের পক্ষে কী করে এতটা নিষ্ঠুর আর নির্দয় হওয়া সম্ভব, যখন কিনা মায়ের বয়সী কোনো নারীকেও জবাই করে বধ করায় কোনো রকম পাপবোধ তাদের মনে দেখা দেয় না। আর বাংলাদেশ সম্পর্কে যাঁরা কিছুটা অবগত, তাঁদের অনেকে ভেবেই পাচ্ছেন না কী করে সেই দেশটির কিছু মানুষের পক্ষে এ রকম বর্বর পশুতে পরিণত হওয়া সম্ভব। একই সঙ্গে জাপান-বাংলাদেশ সম্পর্কের ভবিষ্যৎ নিয়েও তাঁরা এ কারণে উদ্বিগ্ন যে, পুরো ঘটনার ফলে এখন হয়তো বাংলাদেশের ভ্রান্ত এক ছবি জাপানিদের মনের পর্দায় জায়গা করে নেবে, যার ফল হয়তো হবে সুদূরপ্রসারী।

>রাষ্ট্রদূত হরিগুচির মতে, পুরো ঘটনার সবচেয়ে ক্ষতিকর দিকটি হচ্ছে এ রকম ধারণা তৈরি হওয়া যে, বাংলাদেশকে সাহায্য করার উদ্দেশ্য নিয়ে যাঁরা সেখানে গিয়েছিলেন, তাঁদের হত্যা করাই ছিল লক্ষ্য

কথা হয়েছে বাংলাদেশে জাপানের সাবেক রাষ্ট্রদূত মাৎসুশিরো হরিগুচির সঙ্গে। তিনি বললেন, জাপানে বাংলাদেশ সম্পর্কে যাঁরা জানেন না, সেই সব সাধারণ জাপানির মধ্যে এই হত্যাকাণ্ড বিরূপ ধারণার জন্ম দিতে পারে। তবে একই সঙ্গে তিনি বলেন, এ রকম দুঃখজনক ঘটনার পুনরাবৃত্তি বন্ধ করা গেলে বিরূপ সেই প্রতিক্রিয়া দীর্ঘমেয়াদি না-ও হতে পারে। রাষ্ট্রদূত হরিগুচির মতে, পুরো ঘটনার সবচেয়ে ক্ষতিকর দিকটি হচ্ছে এ রকম ধারণা তৈরি হওয়া যে, বাংলাদেশকে সাহায্য করার উদ্দেশ্য নিয়ে যাঁরা সেখানে গিয়েছিলেন, তাঁদের হত্যা করাই ছিল লক্ষ্য। সে রকম ঘটনা কেবল বর্বরতাই নয়, বরং একই সঙ্গে হচ্ছে ন্যূনতম মূল্যবোধেরও বিপরীত। ফলে তা জাপানের পুরো উন্নয়ন সাহায্য ধারণার মূলেও আঘাত করতে পারে। এতে করে নীতিনির্ধারকদের মধ্যেও একধরনের হতাশা দেখা দিতে পারে।
তবে জাপানের বিশিষ্ট সাংবাদিক ও শিক্ষাবিদ এবং প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবের ভাষণ লেখকদের একজন তোমোহিকো তানিগুচি মনে করেন না যে জাপানি স্বেচ্ছাসেবীদের হত্যা দেশের মানুষকে উন্নয়নশীল বিশ্বের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে নিয়োজিত হওয়ায় নিরুৎসাহিত করবে। তিনি বরং মনে করছেন, বর্বরতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হিসেবে এবং নিহত ব্যক্তিদের অনুসৃত আদর্শ সমুন্নত রাখতে জাপানের আরও বেশি মানুষ এখন সেই পথ অনুসরণ করবেন। দৃষ্টান্ত হিসেবে তিনি ৮০ বছর বয়সী জাইকা পরামর্শকের প্রসঙ্গটি তুলে ধরেন, নিজের জীবন বিপন্ন করে জীবনের শেষ বেলাতেও যিনি বাংলাদেশের পরিবহন সমস্যা সমাধানে কাজ করে গেছেন। তোমোহিকো তানিগুচি মনে করেন, এঁরাই জাপানকে পথ দেখান এবং ভবিষ্যতেও তাঁদের দেখানো পথে জাপান এগিয়ে যাবে।
সেইশিন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, উন্নয়ন বিশেষজ্ঞ মাসাআকি ওহাশি অনেক দিন ধরে বাংলাদেশ নিয়ে কাজ করছেন। তাঁর ধারণা, বাংলাদেশে জাপানের সম্পৃক্ততা এখন হয়তো কিছুটা হলেও সংকুচিত হয়ে আসবে। অন্যদিকে জাপানের সাধারণ নাগরিকদের মধ্যে বাংলাদেশ সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা বিস্তৃত হলে তা কেবল সরকারি পর্যায়েই নয়, বেসরকারি খাত ও এনজিও কর্মকাণ্ডকেও প্রভাবিত করতে পারে।
রেডিও জাপানের সাবেক একজন সাংবাদিক আই নিমি বলেন, সন্ত্রাসবাদীরা তাদের বর্বরতার মধ্যে দিয়ে বাংলাদেশের যে পরিচিতি এখন বিশ্বের সামনে তুলে ধরছে, তা দেশটির আসল পরিচয় নয়। বাংলাদেশিদের সঙ্গে কাজ করার অভিজ্ঞতার আলোকে তিনি বুঝতে সক্ষম হয়েছেন কট্টর মৌলবাদী হিসেবে যা বোঝায়, বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ সে রকম নন। বরং ইসলামের সহনশীল ও পরমতসহিষ্ণু একটি ধারা এঁদের জীবনে বহমান। ফলে সন্ত্রাসবাদী হামলার সংবাদ একদিকে যেমন তাঁকে মর্মাহত করেছে, অন্যদিকে সেই খবর শুনে অবাকও তিনি হয়েছেন। তিনি মনে করেন, দেশের এই ভুল প্রতিনিধিত্ব শুধরে নিতে হলে বাংলাদেশের সরকার ও নাগরিকদেরই এগিয়ে আসতে হবে। জাপান ও বাংলাদেশের বন্ধুত্ব যেহেতু অনেক মানুষের অবদানের ফলাফল, আই নিমি তাই মনে করেন সেই অর্জন সহসা নষ্ট হবে না।
টোকিও, ৩ জুলাই ২০১৬
মনজুরুল হক: শিক্ষক ও সাংবাদিক।