জাপানের সম্পদ বুদ্বুদের বয়স সিকি শতাব্দী পেরোল। এ সময় জাপানের অর্থনীতিতে অস্থিরতা বিরাজ করেছে। দুটি দশক এর মধ্যে হারিয়ে গেছে। দেশটির অর্থনৈতিক পরিকল্পনার যে সমালোচনা হয়েছে, তার কিছুটা অযাচিতই বলতে হয়। স্রেফ প্রবৃদ্ধিই একমাত্র লক্ষ্য নয়। মানুষের জীবনযাত্রার মান নিয়েও আমাদের উদ্বিগ্ন হতে হবে। জাপানের জনসংখ্যা বাড়ার হার নেতিবাচক হয়ে গেছে। তবে তাদের উৎপাদনশীলতা বাড়ছে। কর্মক্ষম মানুষের জনপ্রতি উৎপাদনশীলতা বেড়েছে, বিশেষ করে ২০০৮ সালের পর থেকে, যা যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে বেশি। আর ইউরোপের চেয়ে তো অনেক বেশি।
তা সত্ত্বেও জাপানিরা বিশ্বাস করে, তারা এর চেয়েও ভালো করতে পারে। আমি একমত। জাপানের চাহিদা ও জোগানের মধ্যে সমস্যা আছে, প্রকৃত অর্থনীতি ও অর্থব্যবস্থাতেও। এই সমস্যা আমলে নিতে হলে তাকে এমন একটা অর্থনৈতিক পরিকল্পনা হাতে নিতে হবে, যেটা তাদের নীতি প্রণেতাদের গৃহীত পদক্ষেপের চেয়ে বেশি কার্যকর হবে। এই নীতি মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে পারেনি। একই সঙ্গে মানুষের আত্মবিশ্বাস ফিরিয়ে এনে প্রবৃদ্ধি কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় নিয়ে যেতে পারেনি।
বিপুল অঙ্কের কার্বন কর আরোপ করেই এ যাত্রা শুরু করা যেতে পারে। আর তার সঙ্গে যদি ‘সবুজ অর্থায়ন’ করা হয়, তাহলে তো কথাই নেই। এতে প্রবৃদ্ধির হার বেড়ে যাবে, অর্থনীতি নতুন মাত্রা পাবে। প্রায় নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, এটা একরকম প্রণোদনা হিসেবে কাজ করবে, যার ফলে সংকোচনমূলক মুদ্রানীতির প্রভাব কাটিয়ে ওঠা যাবে।
কার্বন কর থেকে যে টাকা পাওয়া যাবে, তা দিয়ে সরকারের ঋণ কমানো যাবে। আবার এ টাকা দিয়ে প্রযুক্তি ও শিক্ষা খাতেও বিনিয়োগ করা যায়। এমনকি জাপানের সেবা খাতে জোগান বাড়িয়ে এর উৎপাদনশীলতা বাড়ানো সম্ভব। এসব খরচ অর্থনীতিকে এমনভাবে উজ্জীবিত করতে পারে, যার মাধ্যমে দেশটি শেষমেশ মুদ্রা সংকোচন থেকে বেরিয়ে আসতে পারে।
বাইরের অনেক মানুষই জাপানের ঋণ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন। কিন্তু কথা হচ্ছে, বিদ্যমান নিম্ন সুদের হারে এই ঋণ অনায়াসে পুনর্ভরণ করা সম্ভব। কিন্তু সুদের হার যদি স্বাভাবিকের কাছাকাছি চলে আসে, তাহলে হয়তো সেটা সম্ভব হবে না। তবে এটা খুব শিগগিরই ঘটছে বলে মনে হচ্ছে না। ফলে জাপান দুটি নীতি গ্রহণ করে এই উদ্বেগের বিরুদ্ধে সুরক্ষা নিশ্চিত করতে পারে।
প্রথমত, জাপান কিছু ঋণ পারপেচুইটির সঙ্গে বিনিময় করতে পারে, যে বন্ডের নির্দিষ্ট মেয়াদ নেই। কিন্তু প্রতিবছর সামান্য কিছু সুদ দিতে পারে। এতে ঝুঁকিটা একদম সরকারের কাঁধে থাকবে না। অনেকেই উদ্বেগ প্রকাশ করতে পারেন, এতে মূল্যস্ফীতি বেড়ে যেতে পারে। কিন্তু জাপানের উল্টে যাওয়া অর্থনীতিতে মূল্যস্ফীতিই এখন সবচেয়ে বেশি দরকার। সুদের হার বেড়ে যেতে পারে—এমন আশঙ্কা একটু অতিকথনই বটে। তবে সরকার এত সতর্কতার মধ্যে প্রতিবছর তার ঋণের ৫ শতাংশ হারে বিনিময় করতে পারে, যতক্ষণ না মূল্যস্ফীতি বেশি বেড়ে যায়।
এর বিকল্প হিসেবে সরকার সুদবিহীন বন্ডের সঙ্গেও ঋণ বিনিময় করতে পারে। অর্থাৎ সরকারি বন্ডের মনেটাইজেশন, যেটা নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে ভয় রয়েছে। আর সুদযুক্ত পারপেচুইটির চেয়ে যদি মনেটরি ফিন্যান্সের কারণে মূল্যস্ফীতি বেশি বাড়ে, তাহলে এটা এই নীতিবিরোধী যুক্তি হিসেবে ধোপে তেমন একটা টেকে না। এটা শুধু ধীরে চলো নীতির পক্ষের যুক্তি।
সুদের হারে লাগাম দেওয়ার দ্বিতীয় পথ হলো এটা স্বীকার করা যে সরকার নিজেই নিজের বড় পাওনাদার। ওয়াল স্ট্রিটের অনেকেই এটা বোঝেন না, নেট ঋণটাই আসল কথা, সমাজ যেটা সরকারের কাছে পায়। সরকার যদি নিজের পাওনা পরিশোধ করে, তাহলে কেউই পার্থক্যটা বুঝতে পারবে না। কিন্তু ওয়াল স্ট্রিটের যে মানুষেরা ঋণ-জিডিপির অনুপাতের সংবাদ পড়েন, তাঁরা নিশ্চিতভাবেই জাপানের ব্যাপারে ভালো বোধ করবেন।
এত কিছু সত্ত্বেও যদি চাহিদা না বাড়ে, তাহলে সরকার ভোক্তা কর কমিয়ে বিনিয়োগ ঋণের কর বাড়িয়ে দিতে পারে। নিম্ন ও মধ্য আয়ের মানুষের কল্যাণে নানা কর্মসূচি নিতে পারে। প্রযুক্তি ও শিক্ষায় আরও বিনিয়োগ করতে পারে। আর এ অর্থায়ন সে নতুন টাকা ছাপিয়ে করতে পারে। অর্থনীতির পুরোনো ঘরানার মানুষেরা মূল্যস্ফীতি নিয়ে মাথা ঘামাতে পারেন, কিন্তু এই ভীতিটা জাপানের বেলায় সত্য হওয়া দরকার।
জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে অবশ্য ভিন্ন পথ নিয়েছেন। তিনি যুক্তরাষ্ট্রসহ প্রশান্ত মহাসাগরের তীরবর্তী আরও ১০টি দেশের সঙ্গে ট্রান্স-প্যাসিফিক পার্টনারশিপ বাণিজ্য চুক্তি সমর্থন করছেন। তিনি বিশ্বাস করেন, এই চুক্তি হলে প্রয়োজনীয় সংস্কার করা সম্ভব হবে। বস্তুত, জিডিপিতে এসব সংস্কারের প্রভাব খুব কমই অনুভূত হবে। কারণটা খুব সাদামাটা, কৃষি থেকে জাপানের উৎপাদনের খুব সামান্য অংশই আসে। তা সত্ত্বেও এই সংস্কার কাঙ্ক্ষিত। এটা হলে তরুণ জাপানিরা নিজেদের অভিনবত্ব দেখাতে পারবেন (যদিও সেটা বের করে আনার জন্য টিটিপি খুব ভালো পথ নয়)।
অন্যদিকে আবে শ্রমিকদের মধ্যে নারীদের পূর্ণাঙ্গ ও সমতাভিত্তিক অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার চেষ্টা করছেন, কাজটা তিনি ঠিকই করছেন। এটা সফল হলে উৎপাদনশীলতা ও প্রবৃদ্ধি বাড়বে।
এখন কথা হলো, সিকি শতক ধরে মন্দা থাকলেও জাপান এখনো বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ। যে নীতির কারণে সেখানকার জীবন মানের উন্নয়ন হবে, তাতে বৈশ্বিক অর্থনীতির বিভিন্ন প্রান্তে চাহিদা ও প্রবৃদ্ধির হারও বাড়বে। একইভাবে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হচ্ছে, জাপান যেমন সারা পৃথিবীতে অভিনব পণ্য ও প্রযুক্তি ছড়িয়ে দিয়েছে, তেমনি সে বিভিন্ন দেশে নীতিও সরবরাহ করতে পারে। যে নীতি অন্যান্য উন্নত দেশের মানুষের জীবনমানও উন্নত করতে পারে।
অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন, স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট।
জোসেফ ই স্টিগলিৎস: নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত মার্কিন অর্থনীতিবিদ।