জামাল খাসোগি হত্যাকাণ্ডের বিচারে আঞ্চলিক রাজনীতির হিসাব

সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান

সৌদি সাংবাদিক জামাল খাসোগি হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে যুক্তরাষ্ট্রের বাইডেন প্রশাসন একটি গোয়েন্দা প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এটি রচিত হয়েছে ওয়াশিংটনের মধ্যপ্রাচ্য নীতির আলোকে। প্রথাগতভাবে মার্কিনদের মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক নীতি সৌদি রাজপরিবার এবং ইসরায়েলের নিরাপত্তাকে ঘিরে আবর্তিত। মধ্যপ্রাচ্যে রাশিয়া, চীন ও স্বল্প পরিসরে তুরস্কের প্রভাব বৃদ্ধির উত্থানের প্রেক্ষাপটে যুক্তরাষ্ট্রের ভূরাজনৈতিক-অর্থনৈতিক স্বার্থের বিবেচনায় সৌদি রাজপরিবারের গুরুত্ব বেড়েছে। এই কারণেই  ওয়াশিংটন সৌদি যুবরাজের বিরুদ্ধে এখনো পর্যন্ত কোনো নিষেধাজ্ঞামূলক পদক্ষেপ নেয়নি।

নিউইয়র্ক টাইমস–এর খবরে প্রকাশ, গত ২৬ ফেব্রুয়ারি বাইডেন প্রশাসন সাংবাদিক জামাল খাসোগি হত্যাকাণ্ড নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। সেই প্রতিবেদনে সৌদি যুবরাজকে  হত্যাকাণ্ডের অনুমোদনকারী হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে, হত্যাকারী হিসেবে নয়। প্রথমে প্রকাশ করা প্রতিবেদন সরিয়ে নিয়ে দ্বিতীয় দফায় প্রকাশিত প্রতিবেদনে প্রথম প্রতিবেদনে উল্লিখিত ৩ জনের নাম ছিল না। ওই তিনজনই সৌদি ক্ষমতাধরদের নিকটজন।

সৌদি সরকারের পক্ষ থেকে খাসোগির হত্যাকাণ্ডকে অতীত হিসেবে ঘোষণা করে সামনে এগিয়ে যাওয়ার কথা বলে মার্কিন প্রতিবেদনকে নাকচ করা হয়েছে। সৌদি যুবরাজের জন্য এই মার্কিন প্রতিবেদন একটি স্পষ্ট বিজয়।

কারণ, প্রথমত, হত্যাকাণ্ডের প্রত্যক্ষ অভিযোগ থেকে তাঁকে ‘অব্যাহতি’ দিয়ে খুনের দায় তাঁর সহযোগীদের ওপর চাপানো হয়েছে। সাময়িক কিছু অস্বস্তি এবং মতবিরোধ সত্ত্বেও বাইডেন প্রশাসন যে সৌদি যুবরাজের ওপর ভরসা করতে চায়, তা–ও স্পষ্ট। অর্থাৎ প্রিন্স নাইফসহ রাজপরিবারের সালমানবিরোধীদের রাজনীতিতে ফিরে আসা এখন অনেকটাই অসম্ভব। দ্বিতীয়ত, খাসোগির হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে আঙ্কারার অবস্থান বাতিল করা। খাসোগি হত্যাকাণ্ড নিয়ে শুরু থেকেই আঙ্কারার তির এমবিএসের দিকে। মনে করা হয়, আঙ্কারার হাতে খাসোগি হত্যাকাণ্ডের অডিও–ভিডিও রেকর্ড আছে। সেগুলো সিআইএসহ পশ্চিমের নানা দেশের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের সরবরাহ করলেও পশ্চিমারা সৌদি যুবরাজ সম্পর্কিত নীতিতে অটল থেকেছে। তাই মার্কিন প্রতিবেদন প্রকাশের এক সপ্তাহ পরেও আঙ্কারা নীরব। এর কারণ খাসোগি হত্যাকাণ্ড সম্পর্কিত ওয়াশিংটনের অবস্থান। আঙ্কারা খাসোগি হত্যাকাণ্ডকে আশ্রয় করে সিরিয়া, লিবিয়া ও তুরস্কের ওপর আরোপিত ঘোষিত-অঘোষিত মার্কিন-সৌদি অর্থনৈতিক অবরোধ বিষয়ে দর–কষাকষি করবে।

বাইডেন প্রশাসন কেন সৌদি যুবরাজের সঙ্গীদের ওপর দোষ চাপাল? প্রথম উদ্দেশ্য মার্কিন ‘প্রগতিশীলদের’ শান্ত করা। দ্বিতীয়ত, হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে একটি মীমাংসায় পৌঁছে সৌদি যুবরাজের সঙ্গে বাইডেনের স্থবির সম্পর্ক সচল করা। ‘মার্কিন প্রগতিশীলদের’ একটি অংশের অব্যাহত চাপের মুখে বাইডেন নির্বাচনী প্রচারণার সময় বলেছিলেন ইয়েমেনের ওপর যুদ্ধ চাপিয়ে দেওয়া এবং খাসোগি হত্যাকাণ্ডের জন্য সৌদি যুবরাজকে মাশুল দিতে হবে।

ট্রাম্পের শ্রেতাঙ্গ উগ্রবাদের বিরুদ্ধে এই প্রগতিশীলদের ভোটব্যাংক শুধুই ভোটের হিসাবে নয়, বুদ্ধিবৃত্তিক জায়গা থেকেও বাইডেনকে সাহায্য করেছে। কর্নেল ওয়েস্ট, নোয়াম চমস্কি, আঞ্জেলা দেভিস থেকে বড় বড় তাত্ত্বিকেরা ট্রাম্পের বিরুদ্ধে বাইডেনকে ভোট প্রদানে গণমানুষকে উৎসাহিত করেছিলেন।

বৃহৎ অর্থে খাসোগির হত্যাকাণ্ড প্রশ্নে ট্রাম্প-বাইডেন একই অবস্থান ধরে রেখেছেন। ট্রাম্প সরাসরি বিন সালমানের পক্ষ নিয়েছিলেন আর বাইডেন কৌশলে সৌদি যুবরাজকে অব্যাহতি দিতে চাইছেন।

তবে সৌদি-মার্কিন সম্পর্ক শুধুই ইয়েমেন যুদ্ধ এবং খাসোগি হত্যাকাণ্ডের আলোকে দেখার সুযোগ নেই। এই সম্পর্ক গভীর এবং ঐতিহাসিক। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকেই সৌদি আরবের ওপর নির্ভর করে ‘মুসলিম বিশ্ব’ শাসন করে আসছে মার্কিনরা। স্নায়ুযুদ্ধের পুরো সময়টা সৌদি রাজপরিবার সোভিয়েতের বিরুদ্ধে দেশে দেশে ধর্ম রক্ষার নামে সমাজবাদী চিন্তার বিরুদ্ধে মুসলমানদের ঐক্যবদ্ধ করেছিল। তাই শুধুই অর্থনৈতিক কারণে নয়, রাজনৈতিক কারণেও মার্কিনদের কাছে সৌদি রাজপরিবারের গুরুত্বের অনস্বীকার্যতা অনুধাবন করেই মোহাম্মদ বিন সালমান নিজের আখের গোছাচ্ছেন। মধ্যপ্রাচ্যের বর্তমান পরিবর্তিত রাজনৈতিক অবস্থায় বেশ কিছু কারণে মার্কিনদের কাছে তাঁর প্রয়োজন আছে।

প্রথমত, ইরানকে মোকাবিলার জন্য। ইরান ইরাকে, সিরিয়ায়, ইয়েমেনে শিয়া গোষ্ঠীকে সংঘবদ্ধ করেছে। অস্ত্র সরবরাহ করে যুদ্ধে নামিয়েছে। ইরানের এই কার্যকলাপ মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন স্বার্থে বড় আঘাত হানতে পারেনি বরং সৌদি বলয়কে ইরানের বিরুদ্ধে সংঘটিত করেছে। শিয়া-সুন্নি বিভেদকে শক্তিশালী করেছে। এই দ্বন্দ্ব নিঃসন্দেহে পশ্চিমের কোষাগার স্বাস্থ্যবান করবে এবং মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েলবিরোধীদের বিনাশ করবে। তাই ইরানের বিরুদ্ধে সুন্নি দুনিয়ার আগত নেতা হিসেবে মোহাম্মদ বিন সালমান ওয়াশিংটনের কাছে মূল্যবান।

দ্বিতীয়ত, আরব বিশ্বের আধুনিকীকরণ। এ বিষয়ে নানা পক্ষ–বিপক্ষ বিদ্যমান। তালাল আসাদ, পার্থ চ্যাটার্জি, দীপেশ চক্রবর্তী, আশিস নন্দী প্রমুখ আধুনিকতাকে বৃহৎ অর্থে পশ্চিমাকরণ নামে সংজ্ঞায়িত করেছেন। সে হিসেবে সৌদি যুবরাজ পশ্চিমাদের সব আধুনিকায়ন মেনে নিয়েছেন। ‘মধ্যযুগীয় ইসলাম’ থেকে বের হয়ে ‘আধুনিক ইসলাম’ নির্মাণে এগিয়ে যাচ্ছেন। এই ‘আধুনিক পুঁজিবাদী ইসলাম’ পশ্চিমের চিত্রিত ইসলাম থেকেই খুব ভিন্ন নয়।

তৃতীয়ত, ইসরায়েলকে স্বীকৃতি। এক শ বছর ধরে আরবেরা ফিলিস্তিনিদের মুক্তির জন্য আন্দোলন করে যাচ্ছে। বহুবার যুদ্ধে নেমেছে। যুদ্ধকে ঘিরে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবন গঠন হয়েছে। কবিতা, উপন্যাস আর উপনিবেশবাদবিরোধী আখ্যানের সুর রচিত হয়েছে। কিন্তু মোহাম্মদ বিন সালমান সেই সুর ত্যাগ করেছেন। অনেক মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্রকে ইসরায়েলের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক এবং ফিলিস্তিনিদের পকেট রাষ্ট্র মেনে নেওয়ার জন্য চাপ প্রয়োগ করেছেন।

জামাল খাসোগি হত্যাকাণ্ড মার্কিন-সৌদি দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ককে ক্ষতিগ্রস্ত করবে না। তবে এই হত্যাকাণ্ড নিয়ে সৌদি যুবরাজের প্রতি মার্কিনিদের নরম ও ‘সমঝোতামূলক’ সুর নিঃসন্দেহে বিচারকে প্রভাবিত করবে। মার্কিনিরা আদতে খাসোগির হত্যাকাণ্ডের বিচার করতে চায় কি না, সেটাই এখন মূল্যবান প্রশ্ন। বৃহৎ অর্থে খাসোগির হত্যাকাণ্ড প্রশ্নে ট্রাম্প-বাইডেন একই অবস্থান ধরে রেখেছেন। ট্রাম্প সরাসরি বিন সালমানের পক্ষ নিয়েছিলেন আর বাইডেন কৌশলে সৌদি যুবরাজকে অব্যাহতি দিতে চাইছেন। এই কৌশলের আশ্রয় নিয়ে সম্ভবত বাইডেন সৌদি রাজতন্ত্রের সমালোচক এবং মধ্যপ্রাচ্যের গণতন্ত্রকামীদের এমন বার্তা দিয়েছেন যে খুন, অপহরণ, দমন–পীড়ন যা–ই হোক, ইসরায়েলের মতোই সৌদি রাজপরিবার সব সমালোচনার ঊর্ধ্বে থাকবে।

রাহুল আনজুম: মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক গবেষক