জামিন পাওয়ার ‘আনন্দ’

বছরখানেক আগে আমার সঙ্গে হঠাৎ এক তরুণ দেখা করতে আসে। তার ভীত চাহনি, ক্লান্ত চেহারা, ঘর্মাক্ত মুখ দেখে অনুমান করি, কোনো সমস্যায় পড়েছে সে। কথা শুনে জানা গেল সে মফস্বলের একজন ছোট উদ্যোক্তা। সরকারি দলের সংসদ সদস্যের বিরুদ্ধে ফেসবুকে লেখার জন্য তার বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করেছেন স্থানীয় একজন আওয়ামী লীগ নেতা। গ্রেপ্তারের ভয়ে সে পালিয়ে বেড়াচ্ছে। আমার কাছে এসেছে পরামর্শ নিতে।

আমি শুকনো মুখে তাকে আদালতে আত্মসমর্পণের পরামর্শ দিই। সে জানতে চায়, তাহলে সে জামিন পাবে কি না। তাকে সত্যি কথা বলি। সে সমাজের সুবিধাভোগী শ্রেণির কেউ না, সমাজের প্রভাবশালী মানুষ তার জামিন পাওয়ার জন্য সরব হবে না, বাঘা আইনজীবীর সাহায্যও সে পাবে না। জামিন পাওয়ার সম্ভাবনা খুব কম তার, পেলেও অন্তত বছরখানেক লাগবে। কিন্তু তারপরও শেষ হবে না তার ভোগান্তি।

সে স্তব্ধ হয়ে বসে থাকে। জানায়, এক বছর জেলে থাকলে তার ব্যবসা বন্ধ হয়ে যাবে, তার পরিবারকে না খেয়ে থাকতে হবে। আমি কি তার জন্য কিছু করতে পারি?

পারি না। তত দিনে ফেসবুকে সামান্য এক কার্টুনের জন্য রাষ্ট্রের হেফাজতে থেকে প্রাণ হারিয়েছেন সাংবাদিক মুশতাক, কার্টুনিস্ট কিশোর সেই মামলায় তখনো জেলে। তঁাদের ওপর পুলিশের বীভৎস নির্যাতনের বিবরণ পত্রিকায় পড়ে ক্ষতবিক্ষত হয়ে আছে হৃদয়। এমন সময়ে একজন সম্ভাবনাময় তরুণ আমার সামনে বসে আছে নতমুখে! সে যে কথা ফেসবুকে লিখেছে, তার চেয়ে শতগুণে কঠিন সমালোচনা আমরা করতে পারতাম এরশাদ, খালেদা জিয়া, এমনকি ১৯৯৬ সালের শেখ হাসিনার সরকারের আমলে। আর এই সামান্য কথার জন্য ধ্বংস হয়ে যাবে তার জীবন!

আমি তাকে কিছু অর্থসাহায্য দেওয়ার প্রস্তাব দিই। সে করুণভাবে হেসে অস্বীকৃতি জানায়। দোয়া করবেন বলে উঠে দাঁড়ায়।

ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনে যখনই কারও গ্রেপ্তার হওয়ার সংবাদ পড়ি, সেই তরুণের মুষড়ে পড়া চেহারার কথা মনে পড়ে। গত মঙ্গলবার এই আইনে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন সাংবাদিক ফজলে এলাহী। সবাই সরব হওয়ায় তাঁর জামিন হয়েছে। গলার মালা দিয়ে তাঁকে জেলগেটে সহকর্মীরা বরণ করেছেন। তাঁরা কি জানেন, এই মালা আসলে একটা ধারাবাহিক শৃঙ্খলেরই ইঙ্গিত? জামিন হয়েছে, কিন্তু তাঁর মুক্তি হয়নি, মামলা প্রত্যাহারও হয়নি। এরপর থেকে তাঁকে নিয়মিত যেতে হবে আদালতে, কত টাকা খরচ হবে বৈধ ও অবৈধ কারণে, তারও কোনো সীমা নেই। এটা একটা শৃঙ্খল। আরও যা ভয়াবহ, মতপ্রকাশের ক্ষেত্রেও একটা শৃঙ্খলে তাঁকে থাকতে হবে বহু বছর। অপছন্দের কিছু দেখলেই তাঁর জামিন বাতিল করে জেলে ঢোকানো হতে পারে যেকোনো সময়।

এত কিছুর পরও আমরা কাউকে শুধু জামিন পেলেই উল্লসিত হতে দেখি। আমার ফেসবুকে প্রায় নিয়মিত দেখি এমন উল্লাসের ছবি আর খবর। এমন একটা অবস্থা হয়েছে যে হয়রানিমূলক মামলা করা হয়ে দাঁড়িয়েছে ক্ষমতাশালী মানুষের ‘অধিকার’ আর জামিন হয়ে দাঁড়িয়েছে কৃপামূলক ‘অনুদান’। এমন মামলা করার জন্য নানা অস্ত্র আছে আইনের জগতে। মানহানির আইন আছে, রাষ্ট্রদ্রোহের আইন আছে, আছে সন্ত্রাস আইন। তবে এ জন্য সবচেয়ে অব্যর্থ অস্ত্র হচ্ছে ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট। বহুবার বহুভাবে এই আইনের বিরুদ্ধে বলেছেন দেশি-বিদেশিসহ সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষ। সমালোচনা তীব্র হলে সরকারের মন্ত্রীরা এটি সংস্কার করা হবে বলে আশ্বাস দিয়েছেন। সমালোচনা করে করে মানুষ ক্লান্ত হয়ে গেলে তাঁরা সেই আশ্বাস ভুলে গেছেন। নতুন নতুন মামলা হয়েছে অব্যাহত গতিতে।

যথেচ্ছভাবে ব্যবহার করার সুবিধার দিক দিয়ে ডিজিটাল সিকিউরিটি আইন সবচেয়ে হয়রানিমূলক একটি আইন। এই আইনে কম্পিউটার ব্যবহারমূলক অপরাধসংক্রান্ত বিধানগুলো রাখার কিছু যুক্তি থাকতে পারে, কিন্তু বাক্স্বাধীনতাসংক্রান্ত বিধানগুলো রাখার কোনো যুক্তি নেই। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার মানের চেয়ে এই আইন কোথায় কোথায় পিছিয়ে আছে, তা বহু মানসম্মত গবেষণায় সুনির্দিষ্টভাবে দেখানো হয়েছে। এরপরও সরকার এই আইনের সংস্কার করেনি, এর কঠোর প্রয়োগ থেকে বিরত থাকেনি।

২.

মানুষ আবার এটাও জানে যে ডিজিটাল আইনে মামলা করতে পারে শুধু সরকারপক্ষের লোকজন। যারা এটা জানে না, কালেভদ্রে তারা সরকারের পক্ষের লোকদের চরম অশালীন বক্তব্যের বিরুদ্ধে মামলা করতে গেছে, কোনো দিন তাতে কেউ গ্রেপ্তার হয়নি, অনেক সময় পুলিশ এমনকি আদালতও মামলা আমলে নেননি। খুনের মতো গুরুতর মামলা হলে সরকারপক্ষের লোকদের কালেভদ্রে বিচার হয়েছে, তারপরও সরকারপক্ষের লোকেরা নানা সুবিধা পেয়ে জেলের বাইরে থেকেছে, এমন ঘটনাও আছে এ দেশে।

আইনের এই ভিন্ন প্রয়োগ মামলা দায়ের, গ্রেপ্তার, জামিন ও বিচারের ক্ষেত্রে দৈনন্দিন বাস্তবতা হয়ে দাঁড়িয়েছে। আইনের ভিন্ন চোখের প্রকাশ্য ঘোষণাও এখন শুনি আমরা মাঝেমধ্য। যেমন: সপ্তাহ দুয়েক আগে আইনমন্ত্রী বলেছিলেন, কোনো সাংবাদিকের বিরুদ্ধে ডিজিটাল আইনে মামলা হলে পুলিশ তাঁকে তাৎক্ষণিকভাবে গ্রেপ্তার করতে পারবে না, সাইবার সেল তদন্ত করে মামলা করার উপাদান পেলে মামলাটি গ্রহণ করা হবে।

যত দূর মনে পড়ে, এ ধরনের কথা সরকারের পক্ষ থেকে আমরা আগেও শুনেছি। কিন্তু আইনমন্ত্রী নিজেই যখন এমন বক্তব্য দেন, তখন তা আমাদের বিমূঢ় করে তোলে। তিনি আইনজ্ঞ ছিলেন, নিজের আইনি জ্ঞান নিয়ে তিনি প্রবল আত্মবিশ্বাসী, এটিও মনে হয় তাঁর কথা শুনে। তাঁর কাছে সবিনয় জানতে ইচ্ছা করে, সাংবাদিকেরা অবশ্যই এই সুবিধা পেতে পারেন, কিন্তু কেন অন্য সবাই নন?

বাংলাদেশের সংবিধানে অন্যতম মৌলিক অধিকার হচ্ছে আইনের চোখে সমতা। সংবিধানের ২৭ ধারায় এ-ও বলা আছে যে সবাই সমান আইনগত সুরক্ষা পাবেন। সংবিধানের এমন স্পষ্ট বিধান থাকার পর প্রয়োগক্ষেত্রে আমরা ক্ষমতাশালী, অর্থবান ও প্রভাবশালীদের নানা সুবিধা পেতে দেখি। এখন হয়রানিমূলক মামলা থেকে সুরক্ষার অধিকার থেকে বলেকয়ে সাংবাদিক ছাড়া অন্য সবাইকে বঞ্চিত করার কি যৌক্তিকতা থাকতে পারে?

আরও পড়ুন

৩.

যথেচ্ছভাবে ব্যবহার করার সুবিধার দিক দিয়ে ডিজিটাল সিকিউরিটি আইন সবচেয়ে হয়রানিমূলক একটি আইন। এই আইনে কম্পিউটার ব্যবহারমূলক অপরাধসংক্রান্ত বিধানগুলো রাখার কিছু যুক্তি থাকতে পারে, কিন্তু বাক্স্বাধীনতাসংক্রান্ত বিধানগুলো রাখার কোনো যুক্তি নেই। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার মানের চেয়ে এই আইন কোথায় কোথায় পিছিয়ে আছে, তা বহু মানসম্মত গবেষণায় সুনির্দিষ্টভাবে দেখানো হয়েছে। এরপরও সরকার এই আইনের সংস্কার করেনি, এর কঠোর প্রয়োগ থেকে বিরত থাকেনি।

এই আইনের সবচেয়ে বড় ভুক্তভোগী হচ্ছে সমাজের প্রান্তিক পর্যায়ের তরুণেরা। শুরুতে আমি যার কথা লিখেছি, সে এমনই একজন তরুণ। আমি এ রকম আরও কয়েকজন ভুক্তভোগী তরুণের কথা জানি। একেকটা মামলায় সর্বস্বান্ত বা পুরো জীবন অনিশ্চিত হয়ে গেছে তাদের। আমরা কজন তাদের খবর রাখি। রাষ্ট্রের কোনো প্রতিষ্ঠান তাদের ক্ষেত্রে আইনের সমান প্রয়োগ নিশ্চিত করতে ভূমিকা রাখে?

দেশে আরও নতুন নতুন নিবর্তনমূলক আইন হচ্ছে। উপাত্ত সুরক্ষা আইন, ডিজিটাল, সোশ্যাল মিডিয়া অ্যান্ড ওটিটি প্ল্যাটফর্ম রেগুলেশন, ওটিটি কনটেন্টভিত্তিক পরিষেবা পরিচালনা নীতিমালা নামের এসব আইনের অন্যতম উদ্দেশ্য হচ্ছে, এমনকি ব্যক্তিগত যোগাযোগ ও তথ্য বিনিময়ের ওপরও নজরদারি করা, সেখানেও ইচ্ছেমতো মামলা ও হয়রানি করার সুযোগ সৃষ্টি করা, ভয় ও আতঙ্কের পরিবেশকে আরও সুশক্ত করা। যেকোনো আইনের মতো এর শিকারও হবে সমাজের সবচেয়ে সুবিধাবঞ্চিত মানুষ। যাদের একটা প্রভাব, যোগাযোগ আছে, এসব আইনে তারা ভুক্তভোগী হলে হয়তো তারা জামিন পাবে। কিন্তু আমরা জানব না, যাদের জামিন হয়নি তাদের কথা। জেলের ভেতর তাদের মানবেতর জীবনের কথা, সেখানে সামান্য বৈধ সুযোগ-সুবিধা লাভের জন্য তাদের পরিবারের সর্বস্বান্ত হওয়ার কথা।

আমরা অনেকেই এই সংকটের চিত্রটা জানি না, আরও অনেকে জানতে চাই না। কিন্তু একটা জিনিস আমাদের বোঝা উচিত, জামিন পাওয়া যে দেশে উদ্‌যাপন করা বা উচ্ছ্বসিত হওয়ার বিষয়ে পরিণত হয়, সেখানে আইনের শাসন হয়তো আছে কিছুটা, তার চেয়ে বেশি আছে অরাজকতার শাসন।

আর কত মানুষের হাহাকার ঘন হয়ে উঠলে অবসান হবে এসব অরাজকতার?

আসিফ নজরুল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক