জার্মানিতে ম্যার্কেলের পরে কে?

জার্মান ইতিহাসে সব থেকে বেশি সময় ক্ষমতায় থাকা চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেল

জার্মান ইতিহাসে সব থেকে বেশি সময় ক্ষমতায় থাকা চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেলের বিদায় বেলা ঘনিয়ে এল। চার মেয়াদে দীর্ঘ ১৬ বছর ক্ষমতাসীন থাকার পর আগামী সেপ্টেম্বরে অনুষ্ঠেয় জার্মানির ২০তম জাতীয় নির্বাচনে তিনি আর প্রার্থী হচ্ছেন না। ২০১৮ সালে তিনি তাঁর দল ক্রিশ্চিয়ান গণতান্ত্রিক দলের সভাপতির পদটিও স্বেচ্ছায় ছেড়ে দিয়েছিলেন।

জার্মানিতে এখন প্রবল আলোচনা, কে হবেন ম্যার্কেলের উত্তরসূরি। দীর্ঘ সময় ধরে জার্মানির রাজনীতিতে আঙ্গেলা ম্যার্কেলের যে ইমেজ তৈরি হয়েছে, সেই ইমেজের ধারেকাছে আপাতত কোনো রাজনীতিক নেই।

বিশ্বযুদ্ধোত্তর জার্মানির সমাজ ও রাজনীতিকেরা নিজেদের ধূসর ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়ে সর্বদাই ঐক্য, সংহতি ও গণতন্ত্রের পথে হেঁটেছেন এবং অর্থনৈতিক মুক্তির পথ খুঁজেছেন। এভাবেই জার্মান জাতি আর দেশ প্রতিবেশী আর বিশ্বের মানুষের কাছে নতুন মহিমায় উদ্ভাসিত হয়েছে। ১৯৪৯ সাল থেকেই জার্মানিতে মূলত দুটি রাজনৈতিক দল—ক্রিশ্চিয়ান গণতান্ত্রিক ও সামাজিক গণতন্ত্রী। এই দুটো দলই ঘুরেফিরে দেশ শাসন করে আসছে। তবে বেশির ভাগ সময়ই সরকার গঠনে উদার গণতান্ত্রিক দল, পরিবেশবাদী গ্রিন পার্টি, বাম দল বা ব্যাভেরিয়া প্রদেশের ক্রিশ্চিয়ান সোশ্যাল ইউনিয়নের মতো ছোট দলগুলোর সহায়তা প্রয়োজন হয়েছে।

তবে ব্যত্যয় ঘটে ২০১৭ সালের ১৯তম জাতীয় নির্বাচনের সময়। সেই বছর ২০১৩ সালে গঠিত চরম দক্ষিণপন্থী দল, অল্টারনেটিভ ফর জার্মানি নির্বাচনে ৭০ বছরের ঐতিহ্য ভেঙে দেয়। ধর্ম, বর্ণ, শরণার্থী, অভিবাসী এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নবিরোধী দলটি জার্মানির পার্লামেন্ট বুন্ডেসটাগে ৯৪ আসন দখল করে তৃতীয় বৃহত্তম রাজনৈতিক দল ও আইনসভায় প্রধান বিরোধী দলের আসন গ্রহণ করে। সেই বছর ক্রিশ্চিয়ান গণতান্ত্রিক দল, সামাজিক গণতন্ত্রী দল এবং ক্রিশ্চিয়ান সোশ্যাল ইউনিয়ন দলের জোট ক্ষমতায় আসীন হয়।

জার্মানির রাজনীতিতে ভারসাম্য রক্ষায় ম্যার্কেল নজিরবিহীন। ১৯৯০ সালে পূর্ব জার্মানির সাধারণ নির্বাচনে বিজয়ী প্রধানমন্ত্রী মেসায়ারের সরকারের মুখপাত্র হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। পদার্থবিদ্যার কৃতী ছাত্রী ম্যার্কেল সেই বছরই হেলমুট কোলের হাত ধরে ঐক্যবদ্ধ জার্মানির রাজনীতিতে প্রবেশ করেন। চ্যান্সেলর কোলের মন্ত্রিসভায় ১৯৯১ সালে পরিবারবিষয়ক এবং ১৯৯৪ সালে পরিবেশবিষয়কমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। পরে ১৯৯৮ সালে ক্রিশ্চিয়ান ডেমোক্রেটিক দলের সাধারণ সম্পাদক হন। ২০০০ সাল থেকে তিনি দলের সভানেত্রী। রক্ষণশীল ক্রিশ্চিয়ান ডেমোক্রেটিক ইউনিয়ন দলে অনেক ঝানু রাজনীতিক ছিল। প্রতিভা আর কৌশলের জোরে সবাইকে পাশ কাটিয়ে দেশটির রাজনীতিতে নিজের জায়গা তৈরি করে নেন ম্যার্কেল।

১৬ বছরের শাসনামলের পুরোটা অবশ্য ম্যর্কেলের জন্য মৃসণ ছিল না। ২০১৪ সালে ১০ লাখ শরণার্থীকে আশ্রয় দান, ২০১৭ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ডোনাল্ড ট্রাম্পের ক্ষমতাগ্রহণের পর অব্যাহতভাবে জার্মানি ও ইইউর সমালোচনা ও অযাচিত চাপ, জার্মানির গাড়ি ও ইস্পাত শিল্পের ওপর অতিরিক্ত কর, ২০২০ সালে যুক্তরাজ্যের ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন ছেড়ে চলে যাওয়া, জার্মানি থেকে মার্কিন সৈন্যদের অপসারণের সিদ্ধান্ত, রাশিয়ার সঙ্গে গ্যাস পাইপলাইন স্থাপন নিয়ে ঠান্ডাযুদ্ধ, সর্বশেষ করোনা পরিস্থিতিতে নানা সিদ্ধান্ত ও করোনা প্রতিরোধী টিকা নিয়ে দীর্ঘসূত্রতা প্রভৃতি সংকট তাঁকে মোকাবিলা করতে হয়।

আঙ্গেলা ম্যার্কেলকে নিয়ে বার্লিন হুমবোল্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক হ্যারফিল্ড মুঙ্কলার কিছুদিন আগে ডের টাগেসস্পিগেল পত্রিকাটিকে বলেছিলেন, ‘জার্মানি রাজনীতির ললাটে সৌভাগ্যের প্রতীক ছিলেন ম্যার্কেল। তাঁর মতো রাজনৈতিক উত্তরাধিকারী এই মুহূর্তে আমি দেখছি না।’

ম্যার্কেলের দল ক্রিশ্চিয়ান গণতান্ত্রিক দল থেকে সেপ্টেম্বরে চ্যান্সলর পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবে দলটির বর্তমান সভাপতি ও জার্মানির বৃহত্তম জনবহুল রাজ্য নর্থ রাইন ভেস্টফালিয়ার মুখ্যমন্ত্রী আরমিন ল্যাশেট (৬০)। প্রথম জীবনে আইন ও সাংবাদিকতা পেশায় যুক্ত থাকা ল্যাশেটকে অভিবাসীবান্ধব রাজনীতিক বলে গণ্য করা হয়। ২০১৭ সাল থেকে তিনি নর্থ রাইন ভেস্টফালিয়া রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী।
জার্মানির দ্বিতীয় বৃহত্তম দল সামাজিক গণতন্ত্রী দলটি থেকে চ্যান্সেলর পদে মনোনয়ন লাভ করেছেন ৬২ বছর বয়স্ক ওলাফ শুলজ। বর্তমান তিনি জোট সরকারের অর্থমন্ত্রী। একসময় বন্দর শহর হামবুর্গের মেয়র ছিলেন। চ্যান্সেলর গেরহার্ড শ্রোয়েডারের আমলে তিনি ছিলেন সামাজিক গণতন্ত্রী দলের সাধারণ সম্পাদক। ম্যার্কেলের জোট সরকারে শ্রম ও সমাজকল্যাণমন্ত্রীর দায়িত্বও পালন করেছেন। ২০১৮ সাল থেকে তিনি জোট সরকারের অর্থমন্ত্রী ও সহকারী চ্যান্সেলরের দায়িত্ব পালন করছেন।

এই মুহূর্তে জার্মানির সবচেয়ে জনপ্রিয় দল পরিবেশবাদী সবুজ দল। চ্যান্সেলর পদে দলটি থেকে মনোনয়ন পেয়েছেন ৪০ বছর বয়স্ক আনালেনা বার্বক। হ্যানোভারে জন্মগ্রহণকারী এই নারী রাষ্ট্রবিজ্ঞান এবং পাবলিক ল বিষয়ে হামবুর্গ বিশ্ববিদ্যালয় ও লন্ডন স্কু অব ইকনোমিক্স থেকে পাবলিক ইন্টারন্যাশনাল ল বিষয়ে পড়াশোনা করছেন। ২০১৩ সাল থেকে তিনি জার্মান পার্লামেন্টে সবুজ দলের পার্লামেন্ট সদস্য।

জার্মানির ২০তম নির্বাচনের পাঁচ মাস আগে বিভিন্ন নির্বাচনী জরিপে দেখা যাচ্ছে, পরিবেশবাদী সবুজ দল ২৯ শতাংশ, ক্রিশ্চিয়ান গণতান্ত্রিক দল ২৪ শতাংশ, সামাজিক গণতান্ত্রিক দল ১৫ শতাংশ, লিবারেল গণতন্ত্রী দলটি ১১ শতাংশ, বাম দল ৬ শতাংশ এবং কট্টরবাদী অল্টারনেটিভ ফর জার্মানি ৯ শতাংশ ভোট পাবে।

জার্মান রাজনীতির ইদানীংকালের ঐতিহ্য অনুযায়ী, মূল দলগুলোর কেউ একক সংখ্যাগরিষ্ঠ পাবে বলে মনে হয় না। সে ক্ষেত্রে আবারও হয়তো গঠিত হবে জোট সরকার।

সরাফ আহমেদ প্রথম আলোর জার্মান প্রতিনিধি
[email protected]