জি-২০ জোটের সম্মেলন ও সংঘাত

জি-২০ জোটের বিরোধীদের মিছিল
জি-২০ জোটের বিরোধীদের মিছিল

ব্যস্ত বন্দর নগরী হামবুর্গে নেমেই অবাক হতে হয়, যেন এক ভুতুড়ে শহর। সকাল নয়টায় ট্রেনস্টেশন থেকে শহরের কেন্দ্রে যাওয়ার প্রশস্ত সব সড়ক শূন্য। যত দূর দৃষ্টি যায় শুধু পুলিশের নানা ধরনের বাহন আর আকাশে বিকট আওয়াজ করে অনবরত চক্কর দিচ্ছে অসংখ্য হেলিকপ্টার। রাস্তার আশপাশে সবুজ চত্বরে-পার্কে অসংখ্য মানুষ বিছানা পেতে বিশ্রাম নিচ্ছে। আগের দিন গভীর রাত পর্যন্ত বন্দর এলাকার বিখ্যাত ফিশ মার্কেট এলাকায় ‘ওয়েলকাম টু হেল’ শীর্ষক বিক্ষোভ চলাকালে কয়েক শ বিক্ষোভকারী ও পুলিশ আহত হয়েছে। জি-২০ জোটের নীতির বিরুদ্ধে সারা জার্মানিসহ ইউরোপের নানা অঞ্চল থেকে হাজার হাজার বিক্ষোভকারী হামবুর্গে এসেছেন।

তবে ৭ জুলাই জি-২০ জোটের সম্মেলনের শুরুর দিন সকালে সারা শহর শান্ত। সকালে শহরের কেন্দ্রে কংগ্রেস সেন্টারে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বিক্ষোভকারীদের ততটা চোখে পড়েনি। কিন্তু সন্ধ্যায় জি-২০ জোটের অতিথিদের জন্য এলব নদীর তীরে সদ্য তৈরি এলব ফিলামোনি সাংস্কৃতিক কেন্দ্রে জার্মান সংগীতজ্ঞ বিটোফেনের নবম সিম্ফনি কনসার্ট শুরু হওয়ার আগে থেকেই আবার হাজার হাজার বিক্ষোভকারী বন্দর এলাকার রাস্তায় নেমে এসেছিল। নেচে, গেয়ে, বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে তারা হামবুর্গের রাস্তা দখলে নিয়েছিল। ৭ জুলাই সন্ধ্যায় আবার বন্দরনগরীর বাম ও বিকল্প চেতনাে মানুষের এলাকা সানসেনে বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ রণক্ষেত্রে পরিণত হয়েছিল। এই বিক্ষোভ বিশ্বের অর্থনৈতিক বৈষম্য, যুদ্ধ ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে। পুঁজিবাদী দেশের আলো-বাতাসে জীবনযাপন করলেও নতুন প্রজন্মের লাখো তরুণ-তরুণী হামবুর্গের রাস্তায় নেমে এসেছে জি-২০ সম্মেলনের অবিবেচক পুঁজিবাদী নীতির প্রতিবাদ করতে।

১৯টি দেশ, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ এই জোটের এই বছরের সভাপতি জার্মানি। উন্নত ও অর্থনীতিতে অগ্রসর ১৯টি দেশের রাষ্ট্রপ্রধান ও প্রতিনিধিরা ৭ ও ৮ জুলাই হামবুর্গে উপস্থিত হয়েছিলেন। সদস্যরাষ্ট্রগুলো হলো যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জার্মানি, ফ্রান্স, ইতালি, ভারত, চীন, কানাডা, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, রাশিয়া, অস্ট্রেলিয়া, ব্রাজিল, মেক্সিকো, ইন্দোনেশিয়া, তুরস্ক, সৌদি আরব, আর্জেন্টিনা ও দক্ষিণ আফ্রিকা।

 ১৯৯৯ সালে বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দার পর ওই বছরই বার্লিনে এই জোটের সম্মেলন শুরু হয়েছিল। শুরুতে এই জোটের লক্ষ্য ছিল সম্মিলিত ও পারস্পরিক অর্থনৈতিক সহযোগিতা এবং বাণিজ্যের মাধ্যমে বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দা রোধ করার প্রক্রিয়া নির্ণয় করা। পরে পরিবর্তিত বিশ্বে অর্থনীতি ছাড়াও জলবায়ু, জ্বালানি, বাণিজ্য বিনিময়, চাকরির বাজার, উন্নয়নমূলক সহযোগিতা, সন্ত্রাসবাদ এবং সর্বশেষ শরণার্থী প্রভৃতি সমস্যা নিয়ে সহযোগিতার বিষয়গুলো আলোচ্যসূচিতে এসেছে। বিশ্বের মোট জনসংখ্যার তিন-চতুর্থাংশের অধিবাসীদের প্রতিনিধিদের এই সম্মেলনে বিশ্ব অর্থনীতি, বাণিজ্য, জলবায়ু, রাজনৈতিক সংকট বিষয়াদি নিয়ে আলোচনা হয়েছে।

জি-২০ জোটকে নিয়ে গবেষণাকারী টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানী জন ক্রিটন জানিয়েছেন, এই জোটের সদস্যভুক্তি নিয়েও অনেক সমালোচনা আছে। ১৯৯৯ সালে জোট শুরুর প্রারম্ভে আমেরিকার ও কানাডার অর্থমন্ত্রী যথাক্রমে লরেন্স সামার্স ও পাউল মার্টিন যৌথভাবে এই ধনী সদস্য মনোনয়ন করেছিলেন। পরিবর্তিত বিশ্ব অর্থনৈতিক পরিস্থিতির নিরিখে নতুন করে সদস্য অন্তর্ভুক্তির ব্যাপারে অনেক সদস্যের আপত্তি আছে। কয়েক বছর আগে ওয়াশিংটনে সদস্যভুক্তি নিয়ে উত্তপ্ত আলোচনায় সাবেক ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ঠান্ডা প্রকৃতির মানুষ অর্থনীতিবিদ মনমোহন সিং আলোচনার টেবিলে স্পেনের প্রতিনিধিকে ইঙ্গিত করে বলেছিলেন, এই আলোচনা বৈঠকে তাঁদের কী করণীয় আছে! জার্মানির সাবেক অর্থসচিব কায়ো কখ ভেসার, যিনি জোট শুরুর প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত ছিলেন, তিনি সম্প্রতি বলেছেন, যাঁরা এই জোটের সদস্য তাঁরা নিজেদের ধন্য মনে করেন আর অন্যরা এই জোটকে ঘৃণা করেন।

তবে এ ধরনের পুঁজিবাদী জোটের বিরোধী প্রায় ৭০টি সংগঠন সম্মেলনের প্রাক্কালে হামবুর্গে বলেছে, জি-২০ জোট একধরনের সুবিধাবাদীদের ক্লাব। ‘সবার জন্য বিশ্বায়ন’ স্লোগান সামনে রেখে এই জোট একচেটিয়া মুনাফা অর্জনের চেষ্টায় রত আছে। তারা জানিয়েছে, বিশ্বব্যাপী ক্রমবর্ধমান সামাজিক অসমতা, যুদ্ধ, দেশত্যাগ, জলবায়ু ও বাণিজ্য বিনিময় নিয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্প, ভ্লাদিমির পুতিন, রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান, জ্যাকব জুমার মতো নেতারা লাল কার্পেটের ওপর দিয়ে হেঁটে গিয়ে সমস্যাবিষয়ক আলোচনা করার ভান করলেও তাঁরা মূলত স্বৈরাচার আর আমরা এই ধরনের স্বৈরাচারী রাজনীতিকে সব সময় ধিক্কার জানাব।

বলা বাহুল্য, বিগত বছরগুলোতে জি-২০ ভুক্ত দেশগুলোর অনেকে নিউ লিবারেল অর্থনীতি এবং তাঁদের ক্ষমতা প্রয়োগে বিশ্বের অনেক সমস্যার সমাধান করেছেন, অন্যদিকে বিশ্বের অনেক অর্থনৈতিক সমস্যা ও যুদ্ধ তাঁদের নীতির কারণেই ঘটেছে। এই জোটের অন্যতম চার দেশ যুক্তরাষ্ট্র, চীন, ফ্রান্স ও জার্মানি পৃথিবীর বৃহৎ অস্ত্র বিক্রেতা দেশ হিসেবে বিবেচিত। এই দেশগুলোর তৈরি অস্ত্রই পৃথিবীর নানা প্রান্তরের ছোট-বড় যুদ্ধে ব্যবহৃত হচ্ছে। আর যুক্তরাষ্ট্রে ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্ষমতায় আসার পর বিশ্বব্যাপী অস্ত্র ক্রয়ের প্রতিযোগিতা ও যুদ্ধঝুঁকি বেড়েই চলেছে।

হামবুর্গে জি-২০ সম্মেলন চলাকালে এই জোটের নীতিবিরোধী আন্তর্জাতিক সংগঠন, বামপন্থী দলসমূহ, সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা হামবুর্গে ৬ জুলাই থেকে দুই দিনব্যাপী বিকল্প সম্মেলন করেছেন। তাঁরা বলেছেন, এই জোট সদস্যভুক্ত দেশগুলোর আরও অর্থনৈতিক প্রাপ্তির সুবিধা ছাড়া আর কিছুই নয়। জোটের নিজেদের মধ্যে বাণিজ্য বিনিময় ব্যবস্থার প্রচলন শুধু অর্থনৈতিক অসামঞ্জস্য বাড়াচ্ছে। এর অধিকাংশ দেশের কারণেই বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিস্থিতির অবনতি ঘটেছে।

সম্মেলনের শেষ দিনে ঘোষণাপত্রে, বিনিময় ও বাণিজ্যের ক্ষেত্রে সংরক্ষণনীতির বিরোধিতা করে একযোগে কাজ করার ব্যাপারে মতৈক্য হয়েছে। কিন্তু প্যারিস জলবায়ু চুক্তি সংরক্ষণ থেকে ১৯ দেশ একসঙ্গে কাজ করার অঙ্গীকার করলেও যুক্তরাষ্ট্র এই চুক্তি বর্জন করেছে। এই বর্জন নিয়ে জার্মান চ্যান্সেলর বলেন, ‘প্যারিস চুক্তি নিয়ে ট্রাম্পের অবস্থান দুঃখজনক। আমরা ১৯ সদস্য দেশ জলবায়ু নিয়ে একযোগে কাজ করব। তবে ট্রাম্প একসময় তাঁর অবস্থান বদলাবেন বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন ফরাসি প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁ।

সম্মেলনের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ নিয়ে জার্মান চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেল বলেছেন, এই জোটের সুফল সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছাচ্ছে না, আর জোটের বিরুদ্ধে শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভকে আমাদের অনুধাবনে নিয়ে ভবিষ্যতে আরও প্রত্যয়ী হতে হবে। এই একই কথা বলতে চেয়েছেন হামবুর্গের রাজপথের বিক্ষোভকারীরাও।

সরাফ আহমেদ: প্রথম আলোর জার্মান প্রতিনিধি।