জি-৭ সম্মেলনের চাওয়া-পাওয়া

ভাবা হয়েছিল, বিশ্বের পরাক্রমশালী শিল্পোন্নত সাত জাতির দুই দিনের ২৭ ঘণ্টার আলোচনা আর হাজার হাজার বিরুদ্ধবাদীর বিক্ষোভ থেকে তেমন কিছুই বের হয়ে আসবে না। কিন্তু সম্মেলনের শেষ দিন চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেল জানালেন, সাত জাতির জোট দুই দিনের শীর্ষ সম্মেলনের শেষ দিন বেশ কিছু ব্যাপারে মতৈক্যে পৌঁছা গেছে। গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ কমানো ও কার্বন নিঃসরণ দুই সেন্টিগ্রেডের মধ্য সীমাবদ্ধ রাখা, জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার বন্ধ করে বিকল্প জ্বালানির ব্যবস্থা এবং দরিদ্র দেশগুলোতে পরিবেশ ও জলবায়ুদূষণ রোধে আর্থিক সহযোগিতা, ইউক্রেনে যুদ্ধের জের ধরে রাশিয়ার ওপর আরও অবরোধ, আফ্রিকার দেশগুলোতে জঙ্গিদের রুখতে সহযোগিতার প্রস্তাব গৃহীত হয়েছে। দীর্ঘদিন থেকেই পরিবেশ ও জলবায়ু রোধে এই জোটের মধ্যে মতপার্থক্য ছিল। ইউরোপের জলবায়ু ও পরিবেশ রক্ষণ সংগঠনগুলো এই ঐকমত্যকে অভিনন্দন জানিয়েছে, আর রাশিয়ার বিরুদ্ধে এই জোটের আরও অর্থনৈতিক অবরোধকে ইউরোপের অনেকেই এই অঞ্চলে উত্তেজনা আরও বাড়াবে বলে মনে করছেন।
জি-৭ সম্মেলন শেষে সেই ছাইচাপা উত্তেজনাটা আবার আস্তে আস্তে উত্তপ্ত হবে বলেই প্রতীয়মান হচ্ছে। প্রায় ২৫ বছর আগে পূর্ব আর পশ্চিম ইউরোপের মেধ্য স্নায়ুযুদ্ধের যে টানটান উত্তেজনা ছিল, তা বার্লিনের প্রাচীর পতনের পর অনেকটাই প্রশমিত হয়েছিল। সেই প্রাচীর শুধু যে পূর্ব আর পশ্চিম জার্মানির মধ্য ছিল তা নয়, সেই দেয়াল ছিল পূর্ব আর পশ্চিম ইউরোপের মধ্যে পুঁজিবাদী আর সাম্যবাদীদের দেয়াল। বিগত বছরগুলোতে পূর্ব ইউরোপের সাম্যবাদী দেশগুলোর অনেকেই বিলীন হয়েছে পুঁজিবাদী দেশে। তথাপি সেই উত্তেজনাটা ছিল না। কিন্তু পূর্ব ইউক্রেনের যুদ্ধ বা রাশিয়ার সমর্থনপুষ্ট বাহিনীর হাতে ক্রিমিয়া উপদ্বীপ দখলের পর থেকে পশ্চিমাদের সঙ্গে রাশিয়ার দূরত্বটা ক্রমে বাড়ছে।
নিজেদের ব্যবসা-বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য ১৯৭৫ সালে গঠিত সাত জাতিগোষ্ঠীতে রাশিয়া ১৯৯৮ সালে যুক্ত হয়ে আট জাতিগোষ্ঠী জোট হলেও ইউক্রেন যুদ্ধের জের ধরে পশ্চিমা দেশগুলো কর্তৃক ব্যবসা-বাণিজ্যে রাশিয়ার প্রতি নিষেধাজ্ঞা জারির প্রতিবাদে ২০১৪ সালের ২৫ মার্চ জি-৮ ত্যাগ করে। সম্প্রতি পশ্চিমাদের আকাশে বা সমুদ্র এলাকায় রাশিয়ার যুদ্ধবিমান বা যুদ্ধজাহাজ বা রাশিয়া কর্তৃক বেশ কিছু পশ্চিমা রাজনীতিবিদকে রাশিয়া সফরে নিষেধাজ্ঞা জারির ঘোষণা ক্রমেই উত্তেজনা বাড়াচ্ছে।
তবে রাশিয়াকে বাদ দিয়ে এই গোষ্ঠীর শীর্ষ সম্মেলনের সমালোচনা করেছেন সাবেক জার্মান চ্যান্সেলর হেলমুট স্মিড। তিনি ইউক্রেন যুদ্ধের জের ধরে পশ্চিমাদের আগুনে আরও তেল ঢেলে দেওয়ার ও ইউরোপে রাশিয়াকে একঘরে করে রাখার নীতির নিন্দা করেছেন। জার্মান ব্যবসায়ী নেতারা এবং সাবেক মন্ত্রী ও জার্মান-রাশিয়া ফোরামের সভাপতি ম্যাথিয়াস প্লাসসেকসহ অনেকেই এই শীর্ষ সম্মেলনে ভ্লাদিমির পুতিনকে আমন্ত্রণ না জানানোর সমালোচনা করেছেন। ম্যাথিয়াস প্লাসসেক ইউরোপীয় রাজনীতিতে উত্তেজনা প্রশমনের তাগিদ দিয়ে বলেছেন, এই সম্মেলনে রাশিয়াকে আমন্ত্রণ জানানোর যৌক্তিকতার কথা, ইউক্রেন-সংকটকে ঘিরে মিনস্কে যে সমঝোতা হয়েছে, তাকে আরও বাস্তবে রূপ দেওয়ার জন্য এই সম্মেলনে রাশিয়ার উপস্থিতি আরও ফলপ্রসূ হতো। এ ছাড়া প্রাচ্যের ও মধ্যপ্রাচ্যের সংকটময় দেশ সিরিয়া, ইরান বা আফগানিস্তানের মতো দেশগুলোয় রাশিয়ার সহযোগিতা ছাড়া কোনো সমাধান সম্ভব হবে না।
আর এই পরিস্থিতির আঙ্গিকে ৬ ও ৭ জুন জার্মানিতে বসেছিল সাত জাতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, জাপান, ফ্রান্স, ইতালি ও জার্মানিভুক্ত জি-৭ শীর্ষ সম্মেলন। সম্মেলনের মূল আলোচ্য বিষয় হলো ব্যবসায়িক আর অর্থনৈতিক লেনদেনের মাধ্যমে টেকসই অর্থনীতি বা কীভাবে আরও প্রবৃদ্ধির বিস্তার ঘটানো যায়। সাত জাতি জোটের এই গোষ্ঠী শুরুতে অর্থনৈতিক উন্নয়ন, মুদ্রা ও পুঁজি লেনদেনবিষয়ক বিষয়ে তাদের কার্যক্রম চালু করলেও পরে জনসংখ্যা উন্নয়ন, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, পররাষ্ট্রনীতি, পরিবেশ, জলবায়ু পরিবর্তন, জ্বালানি, সন্ত্রাস দমন, আন্তর্জাতিক আইন, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, সন্ত্রাস, আন্তর্জাতিক বাণিজ্য প্রভৃতি বিষয়কেও তারা তাদের কার্যসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করেছে।
অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলোর অর্থমন্ত্রী ও ব্যাংকগুলোর প্রধানেরা সম্মেলনের আগেই বৈঠকে বসেছিলেন সম্মেলনের প্রতিপাদ্য রূপায়ণের কাজে। বিশ্বজুড়ে অর্থনীতির চাকা স্থবির না হয়ে গেলেও সদস্য রাষ্ট্রগুলোর চাহিদা মোতাবেক প্রবৃদ্ধি বা অর্থনৈতিক উন্নয়ন ঘটছে না বিধায় তাদের ভাষায় অর্থনৈতিক সংস্কারের তাগাদা বা রাষ্ট্রীয় ও ব্যক্তি পুঁজির বিকাশসহ ব্যাংকব্যবস্থায় পরিবর্তন আনা, কর দেওয়ার ক্ষেত্রে সামঞ্জস্য আনয়ন ও কর ফাঁকি দাতাদের বিষয় ও অবৈধভাবে পুঁজি স্থানান্তরের বিষয়সহ ১৫টি বিষয় আলোচনার জন্য নির্ধারিত ছিল।
মূল ব্যাপারটা পুঁজিবাদের বাজার সম্প্রসারণ। বিশ্বব্যাপী শিল্পায়ন ও পুঁজি বৃদ্ধির প্রতিযোগিতায়, অতিরিক্ত মুনাফা লাভ, অতিরিক্ত প্রবৃদ্ধির জন্য জি-৭–ভুক্ত দেশগুলোর অনেকেই সামাজিক–অর্থনৈতিক বাজারকাঠামো অনেকটাই সংকুচিত করেছে। শ্রমিক সুরক্ষা আইনের লাগাম টেনে ধরেছে, তাতে সাধারণ শ্রমজীবী মানুষের অর্থনৈতিক সক্ষমতা ক্রমেই কমছে। শ্রমজীবী মানুষের ওপর করের লাগাম টানা হলেও, বড় করপোরেট ব্যাংক প্রতিষ্ঠানগুলো, শেয়ার ব্যবসায়ীরা উৎপাদনবিহীন আয় করে সহসাই বিশাল অর্থসম্পত্তির মালিক হয়েছেন, তাঁদের প্রতি আয়করব্যবস্থায় রেয়াত দেওয়া হয়েছে। এতে বাড়ছে বৈষম্য ও সামাজিক বঞ্চনা।
মহানুভবতা, মানবিকতা আর বিশ্বায়নের কথা বলা হলেও আদতে পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার মাত্র ১৪ শতাংশ মানুষের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ও উন্নয়নের লক্ষ্যে এই জি-৭ গোষ্ঠীর নানা কর্মসূচি ও সিদ্ধান্ত নিয়েও খোদ সদস্যভুক্ত দেশগুলোর জনগণের মধ্য ক্ষোভ রয়েছে। এই পুঁজিবাদী দেশগুলোতেও পুঁজির সুষম বিকাশ ও বণ্টনব্যবস্থা না থাকায় ধনী আর দরিদ্রের তারতম্যটা বেড়েই চলেছে।
নিজেদের মধ্যে অর্থনৈতিক লাভের বিলিবণ্টন নিয়ে মতদ্বৈধ তাদের অনেক দিনের। সারা বিশ্বের ওপর অর্থনৈতিক খবরদারির ক্ষেত্রে তারা অভিন্নমত হলেও নিজেদের মধ্যে স্বার্থের সংঘাত কখনো দূর হয়নি। সোজা কথায় বলা যায়, নিজেদের অর্থনৈতিক উন্নয়নে এই আয়োজন অনেকটাই রাজায়-রাজায় যুদ্ধ বা সলা–পরামর্শ। এদের কৌশল ও উন্নয়ন গরিব বা উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য কোনো সুফল বয়ে আনবে না, শুধু পরিবেশ ও জলবায়ুবিষয়ক ঐকমত্য আগামীর জন্য মাইলফলক হয়ে রইবে।
সরাফ আহমেদ: প্রথম আলোর জার্মানি প্রতিনিধি।
[email protected]