জিনস পরব নাকি বই পড়ব?

অলংকরণ: তুলি
অলংকরণ: তুলি

একটা ভিডিও ক্লিপ দেখলাম অনলাইনে। টেলিভিশন সাংবাদিক ছেলেমেয়েদের জিজ্ঞেস করছেন, একুশে ফেব্রুয়ারিতে কী হয়েছিল। অনেকেই উত্তর দিতে পারছিল না। একজন বলল, যুদ্ধ হয়েছিল। কার সঙ্গে যুদ্ধ, কিসের যুদ্ধ, তা অবশ্য বলতে পারল না। নামকরা একটা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া একজন স্বীকার করে নিলেন, তিনি জানেন না ঠিকমতো। তবে তিনিও এসেছেন শহীদ মিনারে, শ্রদ্ধা জানাতে।
পাশাপাশি আরেকটা খবরে চোখ পড়ল। প্রথম আলোয় বেরিয়েছে খবরটি ২৪ ফেব্রুয়ারি। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, ‘ইউরোপে রেনেসাঁর জন্ম দিয়েছে যে মধ্যবিত্ত, সেই মধ্যবিত্ত এ দেশে হয়নি। এ দেশের মধ্যবিত্ত ৮০ হাজার টাকা দিয়ে আইফোন কেনে, কিন্তু বই কেনে না। টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করতে এ মধ্যবিত্ত কোনো কাজে আসবে না।’ মধ্যবিত্তের বিকাশ প্রসঙ্গে ড. বিনায়ক সেন বলেছেন, ‘ভোগবাদকে প্রাধান্য না দিয়ে মানবিক সমাজ কীভাবে গঠন করা যায়, সেটা দেখতে হবে। জ্ঞানভিত্তিক মধ্যবিত্ত সমাজ তৈরি হলে দ্রুত উচ্চ মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হতে পারব।’ তিনি বলেন, ‘জিনস, টয়লেট টিস্যু ব্যবহার করলেই শুধু প্রকৃত মধ্যবিত্ত হওয়া যায় না। জ্ঞানের বিকাশও থাকতে হবে সেই সমাজে।’
এই কথাগুলো যেন আমাদের ভাবায়।
আমরা স্কুলে যাচ্ছি, আমাদের স্কুলে যাওয়া শিশুর হার ৯৮ শতাংশের বেশি। এবং এই ছেলেমেয়েদের বাবা-মায়ের চোখে অনেক স্বপ্ন। কিন্তু স্বপ্নটা কী? ছেলেমেয়ে ডাক্তার হবে, ইঞ্জিনিয়ার হবে, অন্তত ভদ্রলোক হবে! ভদ্রলোক কথাটা নিয়ে ভাবতে গিয়ে মনে পড়ছে বুদ্ধদেব দাশগুপ্তর ছবি নিম অন্নপূর্ণার কথা। ওই ছবিতে প্রথমেই একটা নেপথ্য কণ্ঠ বলে—বহু দিন আগে দেখা, স্মৃতি থেকে বলছি—ব্রজ ভদ্রলোক। কারণ সে নিয়মিত খবরের কাগজ পড়ে। কমলকুমার মজুমদারের গল্প নিম অন্নপূর্ণা থেকে এই ছবিটি নির্মিত। এই গল্প যতবার পড়ি, আমার হৃদয় কে যেন ব্লেড দিয়ে চিরে ফেলে। এই গল্পে ব্রজ, তাঁর স্ত্রী প্রীতিলতা, দুই মেয়ে যূথী আর লতি—তাঁরা ভদ্রলোক, বামুন—যুদ্ধের বাজারে তাঁদের ঘরে ভাত বাড়ন্ত। ব্রজ বাইরে যান, কিন্তু একটু চাল আনতে পারেন না। যূথী পাশের বাড়ির টিয়া পাখির খাঁচা থেকে ছোলা চুরি করতে গিয়ে পাখির আক্রমণে আহত হয়। তাদের বারান্দায় আশ্রয় নেয় একটা থুড়থুড়ে বুড়ো ভিখিরি। তার ঝোলাটিকে সে সামলে রাখে। আর বোধ হয় যক্ষ্মায়, বিকট শব্দে কাশে। ছেলেমেয়েরা ভাত পাচ্ছে না, সবাই মিলে উপোস, প্রীতিলতা সেই বুড়ো ভিখিরিটিকে ধাক্কা মেরে তার ঝোলা অপহরণ করে নিয়ে আসেন। ‘হঠাৎ হাঁড়ি উনুনে চড়েছে, তলায় আগুন—এসব দেখে তারা যেন পরির রাজ্যে চলে গেল।’ বৃদ্ধ ভিক্ষুক মারা গেছে, ভদ্রলোকের বাড়িতে চাল ফুটছে।
এই গল্প পড়ে বুকে বড় ব্যথা পাই। কারণটা কী? অনেক কারণের একটা কিন্তু ওই পরিবারটি ভদ্রলোক, পত্রিকা পড়ে, অর্থাৎ কিনা মধ্যবিত্ত। মধ্যবিত্ত ভাতের জন্য ভিখিরির চালের ঝোলায় হাত দেবে, এটা মানতে খুব কষ্ট হয়। নিজের শ্রেণিগৌরবে লাগে। আবার খুব মনে হয়, এত অভাব কেন? আমার নিজের লেখা নাটক নাল পিরানেও তো যখন গ্রামের গরিব পরিবারের চুলায় চাল চড়ানো হয়, তখন শিশুটা তার ফোকলা দাঁত বের করে হাসে, ‘আইজ ভাত খামো!’
আমরা তো সেই অভাবের দিনগুলো থেকে বেরিয়ে আসছি। সেই তীব্র অভাব, যা আমি আমার ছোটবেলায় কার্তিক মাসের দিনগুলোয় দেখেছি উত্তরবঙ্গের জনপদে, তা আজ নেই। তাদের ছেলেমেয়েরা স্কুলে যায়। তাদের পায়ে স্যান্ডেল। কাঁচা রাস্তা পেরিয়ে পৌঁছানো একটা গ্রামে রাতে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হচ্ছিল, দর্শক সারিতে একজনও তরুণ পেলাম না, যার পরনে লুঙ্গি। প্রায় সব তরুণের পরনেই জিনস। ড. বিনায়ক সেন বলেছেন, জিনস পরলেই মধ্যবিত্ত হয় না। আমিও বলব, ওই তরুণেরা, যাদের হাতে মোবাইল ফোন আছে, কারও কারও ফোনটা স্মার্ট, এখনো তারা মধ্যবিত্ত হয়নি। আমি খবরের কাগজের লোক, আমি বরং জিজ্ঞেস করব, বন্ধুরা, তোমরা কি খবরের কাগজ পড়ো?
আচ্ছা, ওরা না হয় অজপাড়াগাঁর ছেলেমেয়ে। কেউবা গার্মেন্টসের কারণে, কারও-বা আত্মীয়স্বজন অভিবাসী বলে একটু সচ্ছলতার মুখ দেখেছে। কিন্তু আমাদের শহরের ছেলেমেয়েদের কী অবস্থা? আমরা যারা লুট করছি—ব্যাংক কিংবা শেয়ারবাজার; আমরা যারা দস্যুবৃত্তি করছি—ভূমিদস্যুতা, নদীদস্যুতা, বনদস্যুতা; আমরা যারা ঘুষ খাচ্ছি, টাকা কামাচ্ছি—পোস্টিং দিয়ে, কাজ দিয়ে, ঠিকাদারি করে, না পারলে অপহরণ করে মুক্তিপণ চেয়ে—তাদের ছেলেমেয়েদের কী অবস্থা? এই দেশে এখন প্রতি দশজনে একজন মাদকাসক্ত, সে হিসাবে নিজেদের আত্মীয়স্বজনের মধ্যে মাদকাসক্ত নেই, এই রকম একজন মানুষও খুঁজে পাওয়া যাবে না।
আমাদের ছেলেমেয়েরা কি বই পড়ছে?
সব মা-বাবাই চান ছেলেমেয়ে মানুষ হোক। আমার সন্তান অমানুষ হোক, এটা কোনো মা-বাবা বলবেন? আবার সব মা-বাবাই চান, আমার সন্তান যেন থাকে দুধেভাতে। সমস্যাটা এখানেই—দুধভাতে উৎপাত। আমরা চাই, আমাদের ছেলেমেয়েরা ডাক্তারি পড়ুক, ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ুক, কিংবা পড়ুক ব্যবসা-শিক্ষা। দুধেভাতে থাকুক। সে জিপিএ-৫ পাক। তা পাওয়ার জন্য স্কুল থেকে বেরিয়ে ছুটতে হচ্ছে কোচিং সেন্টারে। পরীক্ষার আগে শিক্ষামন্ত্রীর ঘুম হারাম, এই বুঝি প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়ে গেল!
আমরা কেবল ভোগবাদী হয়ে উঠছি না, আমরা লুণ্ঠনবাদীও হয়ে উঠছি। কিন্তু কেবল ভালো ফল কি ভালো ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার তৈরি করতে পারবে? এফ আর খানের (১৯২৯-১৯৮২) কথা বলব। এই বাংলাদেশি-আমেরিকান প্রকৌশলীকে বলা হয় স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের আইনস্টাইন। শিকাগো শহরে তাঁর নকশা করা সিয়ারস টাওয়ারের নিচে আছে এফ আর খান লেন। সেই লেনে এফ আর খানের আবক্ষ ভাস্কর্যের নিচে উৎকীর্ণ আছে তাঁর একটা উক্তি—‘একজন প্রযুক্তিবিদের অবশ্যই আপন প্রযুক্তিতে লীন হয়ে যাওয়া উচিত নয়, তাকে অবশ্যই জীবনকে উপভোগ করতে পারতে হবে এবং জীবন হলো শিল্প, নাটক, সংগীত এবং সবচেয়ে বড় কথা, জীবন হলো মানুষ।’
বিল গেটস সম্পর্কে দুটো কথা প্রচলিত আছে। বিল গেটস নাকি বলেছিলেন, ‘আমি হার্ভার্ডে কয়েকটা বিষয়ে ফেল করেছিলাম। আমার একটা বন্ধু সব বিষয়ে সর্বোচ্চ নম্বর পেয়েছিল। আমার সেই বন্ধুটি এখন আমার প্রতিষ্ঠান মাইক্রোসফটে সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারের চাকরি করে।’ বিল গেটসের এই উক্তির সত্যতা সম্পর্কে আমি সন্দিহান, তবে এই উক্তিটি নির্ভেজাল বলে মনে
হয়, ‘ছোটবেলা থেকেই আমার ছিল প্রচুর স্বপ্ন, আর আমি মনে করি সেই সব স্বপ্ন আমি পেয়েছি বই থেকে।’
কাজেই আমাদের প্রচুর বই পড়তে হবে। ছোটদের হাতে বই তুলে দিতে হবে। আমাদের ভরসার জায়গা কিন্তু বিশাল বাংলাদেশের গ্রামগঞ্জে স্কুলে যাওয়া শিশু-কিশোররাই। ড. দীপঙ্কর তালুকদারের কথা আমাদের প্রেরণা দেবে। আইনস্টাইনের অভিকর্ষ তরঙ্গ প্রমাণের দুনিয়া-কাঁপানো গবেষণক দলের একজন এই বিজ্ঞানীর জন্ম বরগুনায়। তিনি পাঠ শুরু করেছেন বরগুনার পাঠশালায়, তারপর বরগুনা প্রাথমিক বিদ্যালয়, বরগুনা জিলা স্কুল, বরগুনা সরকারি কলেজ, সেখান থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। এরপর ওয়াশিংটন
স্টেট ইউনিভার্সিটি, সেখান থেকে জার্মানির আইনস্টাইন ইনস্টিটিউট।
আমাদের প্রেরণা দেবেন অধ্যাপক সেলিম শাহরিয়ার। তিনি পড়েছেন পাবনার বেড়ার স্কুলে। বাবা ছিলেন বেড়ার বিপিনবিহারী স্কুলের গণিতের শিক্ষক। সেই স্কুলে পড়ে আজ তিনি নেতৃত্ব দিচ্ছেন যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয়ে নর্থ ওয়েস্টার্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষক দলের, যারা কিনা কাজ করে চলেছেন অভিকর্ষ তরঙ্গ শনাক্তকারী যন্ত্র আবিষ্কারে আর তার সংবেদনশীলতা বাড়ানোর কাজে। যাঁর প্রবন্ধ বেরিয়েছে ফিজিক্যাল রিভিউ পত্রিকায়। তার মানেটা হলো, আমরাও পারব। তার মানেটা হলো, আমাদের গ্রামগঞ্জে বাংলা মাধ্যমের স্কুলে যারা যাচ্ছে, তারাও অনেক বড় হবে, তাদের মধ্য থেকেই বেরিয়ে আসবে অনেক বড় গবেষক, বিজ্ঞানী, শিল্পী, সাহিত্যিক। যেমন বাংলা ভাষার অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি জীবনানন্দ দাশ এসেছেন বরিশাল থেকে, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম এসেছেন বর্ধমানের গ্রাম থেকে।
অন্যদিকে প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাইল ফারমিয়ন কণা আবিষ্কার করেছেন যে এম জাহিদ হাসান, তিনি কিন্তু ছাত্রাবস্থাতেই বই লিখেছেন—এসো ধূমকেতুর রাজ্যে, যখন তাঁর বয়স মাত্র ১৬। ওই বই তিনি উৎসর্গ করেছেন ‘এ দেশের স্বাধীনতাসংগ্রামের লাখো শহীদের পুণ্য স্মৃতির স্মরণে’। যেমন এফ আর খান আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশের পক্ষে ব্যাপক কাজ করেছেন যুক্তরাষ্ট্রে বসেই। আবার আমরা এফ আর খানের ছবি দেখি, তিনি হারমোনিয়াম নিয়ে বসে গান করছেন।
বলতে চাইছি, ভালো প্রকৌশলী কিংবা বিজ্ঞানী হতে হলেও বই পড়তে হবে, সংস্কৃতিচর্চা করতে হবে, মানুষকে নিয়ে ভাবতে হবে এবং ভাবতে হবে দেশ নিয়ে। আমাদের তরুণ প্রজন্ম বই পড়ে না, এটা আমি বিশ্বাস করি না। বইমেলায় যারা বই কেনে, তারা তরুণ। তারা জিনসও পরে বইও পড়ে। আমি হতাশ হচ্ছি না। কাজেই বলব, নতুন প্রজন্ম বই পড়ে না বলে তাদের গালি না দিয়ে আসুন আমরা তাদের হাতে বই তুলে দিই। যে কাজটা আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যার করে যাচ্ছেন।
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।