জিনের আসর এবং মানসিক চিকিৎসা

ইতিহাসে এমএ, তাই স্বাস্থ্য নিয়ে কিছু লিখতে গেলে খুবই বিব্রত বোধ করি। তবু লিখি বাস্তবে যখন কোনো একটা পরিস্থিতির সম্মুখীন হই, আর অপেশাদার দৃষ্টিভঙ্গি থেকে যখন মনে হয় এর সমাধান ততটা দুরূহ নয়।

কিশোরগঞ্জ জেলার পাকুন্দিয়ার এক মহিলা আমার বাসায় গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করেন। তাঁর দুই ছেলেমেয়ে, স্বামী তাঁকে ছেড়ে বিভিন্ন স্থানে আরও দু–একবার বিয়েশাদি করেছেন। সম্পূর্ণ দায়িত্বজ্ঞানহীন, ছেলেমেয়েরা কী খাবে–পরবে, তা নিয়ে তাঁর কোনো দুশ্চিন্তা নেই। বাচ্চা দুটো বিধবা নানির কাছে থাকে, গ্রামে। মহিলা যা বেতন পান, তার প্রায় সবটা মাকে পাঠিয়ে দেন। দুই নাতি–নাতনিসহ মোটামুটি খাওয়া–পরা চলে যায় তাদের।

এভাবেই চলছিল, গ্রামের স্কুলেও যায় বাচ্চা দুটো। সমস্যা দেখা দিল ১১ বছরের মেয়েটার ওপর যখন জিনের আসর পড়ল। রাতের বেলা ঘর থেকে বের হয়ে যায়, সন্ধ্যায় গাছে উঠে বসে, অপরিষ্কার থাকে, হঠাৎ গ্রামের আরেক মাথায় উধাও হয়ে যায়, তখন খুঁজতে বেরোতে হয়। যখন বিষণ্ন মনে আমার স্ত্রীকে জানাল ঘটনাটা, তিনি বললেন অবিলম্বে ডাক্তার দেখাতে। এটা মানসিক রোগ, ওষুধ দিলে ভালো হয়ে যাবে। গ্রামের মুরব্বিরা এ কথা শুনে হেসেই বাঁচেন না। জিনে ধরেছে, ডাক্তার কী করবে! তাঁরা সিদ্ধান্ত দিলেন, কবিরাজের কাছে যেতে হবে, ঝাড়ফুঁক করে জিন তাড়িয়ে দেবে।

আমি গ্রামের মানুষ, তাই ঝাড়ফুঁকের নামে কী হয়, সে বিষয়ে কিছু জ্ঞান আছে। বিষয়টা আমার গোচরে এলে বললাম, কবিরাজের কাছে নিতে পারে, তবে মেয়েটার গায়ে যদি হাত তোলা হয়, সেই কবিরাজ এবং যে লোক মেয়েটাকে নিয়ে যাবে, দুজনের বিরুদ্ধেই আইনি ব্যবস্থা নিশ্চিত করব আমি। কবিরাজি নির্যাতন থেকে মেয়েটা রক্ষা পেয়েছে। বলা বাহুল্য, ঝাড়ফুঁকে কোনো কাজ হয়নি।

স্বাভাবিক অবস্থায় একটু কষ্ট করে হলেও ঢাকায় এনে মেয়েটাকে মনোরোগ বিশেষজ্ঞ দেখানো যেত। বর্তমান পরিস্থিতিতে সেটা কঠিন। কিশোরগঞ্জে আমার পরিচিত কেউ নেই। অগত্যা স্থানীয় এমপি নূর মোহাম্মদ সাহেবের শরণাপন্ন হলাম। আমার ধারণা ছিল জেলা হাসপাতালে নিশ্চয়ই একজন মনোরোগ বিশেষজ্ঞ থাকবেন, না হলে মেডিকেল কলেজে তো অবশ্যই। তাঁকে ফোন করলাম সেই ডাক্তার সাহেবের ফোন নম্বরটা আমাকে দিতে, আর তাঁকে একটু বলে দিতে মেয়েটাকে নিয়ে গেলে যেন ভালোভাবে দেখে চিকিৎসা দিয়ে দেন। উত্তরে এক অবিশ্বাস্য তথ্য পেলাম।

৩০ লাখ লোকের বাস যে জেলায় (এবং যে জেলা থেকে পরপর দুজন রাষ্ট্রপতি পেয়েছে বাংলাদেশ), সেখানে একজনও মনোরোগ বিশেষজ্ঞ নেই! তিনটা মেডিকেল কলেজ আছে জেলায়, খাতায় নিশ্চয়ই কোনো মনোরোগ বিশেষজ্ঞের নামও আছে (নইলে স্বীকৃতি থাকবে না), কিন্তু বাস্তবে কেউ নেই। মানসিক রোগের চিকিৎসা হয় ঝাড়ফুঁক, নয়তো সাধারণ চিকিৎসকের (জেনারেল ফিজিশিয়ান) ব্যবস্থাপত্র। এমপি সাহেবের সহায়তায় যেটুকু করা গেল, একজন সিনিয়র ডাক্তার বাচ্চা মেয়েটিকে দেখলেন এবং ফোনে ঢাকায় অধ্যাপক আহসানুল হাবিবের সঙ্গে পরামর্শ করে ব্যবস্থাপত্র দিলেন। ঘটনাটার বিবরণ দিলাম শুধু বোঝাতে যে আমাদের চিকিৎসাব্যবস্থার যা কিছু দোষত্রুটি, সীমাবদ্ধতা, সে তো আছেই, তার মাঝেও মানসিক চিকিৎসাব্যবস্থা আরও কত বেশি অবহেলিত।

আমেরিকান সাইকিয়াট্রিক অ্যাসোসিয়েশন ১৯৬২ সালে সিদ্ধান্তে আসে যে প্রতি ১০ হাজার মানুষের জন্য একজন মনোরোগ বিশেষজ্ঞ প্রয়োজন, অর্থাৎ প্রতি লাখে ১০ জন। পরবর্তীকালে অবশ্য এ সংখ্যাও অপ্রতুল বলে তারা অভিমত দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে এ সংখ্যা এখন প্রতি লাখে ১৪। ইউরোপের অধিকাংশ দেশে প্রতি লাখে ২০ জনের বেশি (সুইজারল্যান্ডে ৫১)। আমাদের অঞ্চলে একটা প্রচলিত বিশ্বাস আছে যে পশ্চিমা দেশগুলোতে মানসিক রোগের প্রকোপ বেশি। এ বিশ্বাসের ভিত্তি কতটা শক্ত, তা আমার জানা নেই। যদি তা হয়েও থাকে, তবু বিভিন্ন সূত্র থেকে দেখলাম যে প্রতি লাখ লোকসংখ্যায় অন্তত তিনজন মনোরোগ বিশেষজ্ঞ দরকার। দক্ষিণ এশিয়ার কোনো দেশেই এ সংখ্যা নেই। তার মধ্যেও অবশ্য বাংলাদেশের অবস্থা সবচেয়ে শোচনীয়।

১৮ কোটি লোকের দেশে মোট ২৬০ জন মনোরোগ বিশেষজ্ঞ আছেন, প্রতি সাড়ে ছয় লাখ মানুষের জন্য একজন, প্রতি লাখে শূন্য দশমিক ১৪ জন। এমনকি আফগানিস্তানেও এই সংখ্যা শূন্য দশমিক ২৩, শ্রীলঙ্কায় শূন্য দশমিক ২৫, নেপালে শূন্য দশমিক ৩৬। পাকিস্তানের অবস্থা অবশ্য আমাদের কাছাকাছি, প্রতি লাখে শূন্য দশমিক ২০ জন। ভারতের পরিস্থিতি তুলনামূলকভাবে ভালো, সেখানে ৯০০০ মনোরোগ বিশেষজ্ঞের সঙ্গে প্রতিবছর যুক্ত হচ্ছেন ৭০০ জন নতুন বিশেষজ্ঞ। প্রতি লাখ মানুষের জন্য মনোরোগ বিশেষজ্ঞ আছেন শূন্য দশমিক ৭৫ জন।

এত যে দুরবস্থা আমাদের, তারপরও কিন্তু সমহারে বিতরণ করা হলে কিশোরগঞ্জের ৩০ লাখ লোকের ভাগে অন্তত ৪ জন মনোরোগ বিশেষজ্ঞ পড়তেন, যেখানে নেই একজনও। ধরে নিলাম অনেকেই, বিশেষত যাঁরা অবসর নিয়েছেন তাঁরা ঢাকা বা চট্টগ্রামে থিতু হয়েছেন। তবু ২৬০ জনের মাঝে কর্মরত অন্তত ৬০ জন যাতে ৬০টি জেলা সদরে অবস্থান করেন, তার কি ব্যবস্থা করা যায় না? কেন যায় না?

এখানেই এসে যায় সুশাসন আর বিকেন্দ্রীকরণের প্রশ্ন। আমাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ার মতোই সব সুযোগ-সুবিধা ঢাকা শহরে কেন্দ্রীভূত। এই কেন্দ্রের বাইরে থাকতে চান না​ কেউই। এককালে জেলার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা পরিবার নিয়ে জেলা শহরেই থাকতেন, তাঁদের ছেলেরা জেলা স্কুলে পড়ত, মেয়েরা ভালো গার্লস স্কুলটাতে। এখন প্রায় সবার পরিবার থাকে ঢাকায়। দেশের উত্তর–পশ্চিমে অবস্থিত এক সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য তো নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে ঢাকায় বসেই বিশ্ববিদ্যালয় চালাচ্ছেন। ডাক্তাররাই–বা ব্যতিক্রম হবেন কেন?

গ্রামের কথা বাদই দিলাম, অন্তত জেলা সদর পর্যন্ত সেবা পৌঁছাতে হলে মনোরোগ বিশেষজ্ঞের সংখ্যা বাড়িয়ে একটা সহনীয় পর্যায়ে আনার ব্যবস্থা করতে হবে নিশ্চয়ই। তবে আরও দুটো কাজ করতে হবে বলে আমার মনে হয়। এক, তাঁরা যাতে সম্মানের সঙ্গে, সুযোগ-সুবিধার সঙ্গে জেলা শহরে থাকতে পারেন, তার ব্যবস্থা করতে হবে। আর দুই, ক্ষমতাবান মানুষদের ধরাধরি করে যাতে সংখ্যাতিরিক্ত অস্থায়ী পদ সৃষ্টি করে ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে ‘সংযুক্ত’ থাকতে না পারেন, সেদিকেও নজর রাখতে হবে।

মো. তৌহিদ হোসেন সাবেক পররাষ্ট্রসচিব